রোহিত শর্মাকে আমি কবে থেকে চিনি, জানেন? যখন ও সবে মুম্বইয়ের অনূর্ধ্ব ১৯ টিমে ঢুকেছে, সেই দিন থেকে ছেলেটার সঙ্গে আমার পরিচয়। প্রায় দশ বছর হয়ে গেল ওর কেরিয়ার দেখে চলেছি। একটা সময় যখন আমি মুম্বইয়ের প্রধান নির্বাচক ছিলাম, আরও ভাল করে ওর খেলার খুঁটিনাটি দেখার সুযোগ হয়েছিল। বললে আপনারা বিশ্বাস করবেন না, রোহিতকে ঘিরে একটা অনুভূতিই সবচেয়ে বেশি হয়েছে আমার। সেটা হল— প্রচণ্ড রাগ!
দেখুন, রোহিতের প্রতিভা, ওর ক্ষমতা নিয়ে প্রথম দিন থেকেই আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম। ক্রিকেটটা ওর খুব সহজে আসে। কিন্তু ওর সবচেয়ে বড় দোষ হল ধারাবাহিকতার অভাব। যেটা হয় কারণ রোহিত বেশিক্ষণের জন্য ফোকাস ধরে রাখতে পারে না। বড্ড তাড়াতাড়ি কনসেনট্রেশন হারিয়ে ফেলে। মুম্বই টিমে খেলার সময় কত বার দেখেছি, ভাল শুরু করেও বড় রান পেল না রোহিত। কেন? ওই যে বললাম, ইনিংসের মাঝপথে যাওয়ার আগেই ফোকাস হারিয়ে ফেলত। এ রকম একটার পর একটা ওর ইনিংস দেখতাম আর কোনও রকমে নিজের রাগ সামলাতে চেষ্টা করতাম।
আসলে আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না যে, রোহিতের সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে। লোকাল ট্রেনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাতায়াত করে যে ছেলেটা ক্রিকেট শিখতে আসত, সে এত ভাল সুযোগ পেয়েও সেটাকে কী ভাবে নষ্ট করছে? চোখের সামনে একটা জলজ্যান্ত প্রতিভা নষ্ট হতে দেখলে কার রাগ হবে না বলুন? শট খেলার জন্য ও এত সময় আদায় করে নেয়, এত রকম শট মারতে পারে, তবু নিজের মনটাকে লাগামছাড়া করে ফেলেছিল রোহিত। আর তাই ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সেই ক্ষমতার প্রতি সুবিচার করতে পারছিল না।
আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন, আজ রোহিতের সাফল্যের দিনে এ সব পুরনো রাগের প্রসঙ্গ কেন টেনে আনছি। আসলে রোহিতকে নিয়ে কথা বলতে গেলে আপনাআপনিই ওই সব দিনের কথা মনে পড়ে যায়। তাই বলে ভাববেন না অত পুরনো রাগ আজও পুষে রেখেছি! এমসিজিতে ওর ইনিংস দেখে আমি সত্যিই অভিভূত। ও যে জাতের প্লেয়ার, তাতে বিশ্বকাপ নকআউট ম্যাচটা ওর পারফরম্যান্সের একদম সঠিক মঞ্চ। আর ওর ইনিংসের যে ব্যাপারটা আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে সেটা হল, সেঞ্চুরি করার পরেও কিন্তু প্রায় শেষ পর্যন্ত ক্রিজে ছিল রোহিত। উল্টোপাল্টা শট খেলে আউট হয়ে যায়নি।
রোহিতের এই ইনিংস ওর দলের যতটা কাজে এল, ততটাই সাহায্য করবে রোহিতকে। বলছি কেন। বড় ম্যাচে রান পেলে সেই রানগুলো প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস দেয় এক জন ব্যাটসম্যানকে। তার মানসিক অবস্থানটাই পাল্টে দেয়। ব্যাটসম্যান আরও বেশি পজিটিভ ভাবে নামতে পারে। তার ফুটওয়ার্ক অনেক উন্নতি করে। শরীর-মনের কোঅর্ডিনেশনটাও প্রচণ্ড বেড়ে যায়। অবশ্য এত থিওরি দিয়ে আপনাদের বোর না করে একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা আরও ভাল ভাবে বুঝে যাবেন।
সুরেশ রায়নার কথা বলছি। এই বিশ্বকাপে রায়নার পারফরম্যান্স খুব দারুণ কিছু ছিল না। কিন্তু জিম্বাবোয়ে ম্যাচের সেঞ্চুরিটার পর আজ দেখলেন তো, ওর খেলায় কী রকম আত্মবিশ্বাস চলে এসেছে? আমি জানি ওই ম্যাচটা গুরুত্বহীন ছিল। বিপক্ষের নামও ভয় ধরানোর মতো ছিল না। কিন্তু হাজার হলেও সেটা বিশ্বকাপের মঞ্চ। যেখানে একটা বড় ইনিংস ব্যাটসম্যানের মনে বাড়তি অক্সিজেন যোগাতে বাধ্য। ওই ম্যাচটায় রায়নার ব্যাটিং দেখে তখন ভাবছিলাম, আমচি মুম্বইয়ের রোহিতই একমাত্র ভারতীয় ব্যাটসম্যান যে এই বিশ্বকাপে এখনও বড় রান পেল না। তা আজ সেই না-পাওয়ার হতাশাটাও কাটিয়ে দিল রোহিত। কিন্তু পাশাপাশি ওকে একটা পরামর্শ দিতেও ইচ্ছে করছে। বলতে ইচ্ছে করছে-- রোহিত, নিজের মনে কিন্তু আত্মতুষ্টিকে একদম ঢুকতে দিও না। মনে রেখো, বরাবর ওটাই তোমাকে টেনে নামিয়েছে।
যাই হোক, সেমিফাইনালে ওঠার দিন এ সব নিয়ে বেশি শব্দ খরচ করতে ইচ্ছে করছে না। তার চেয়ে আসুন, বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত টিম ইন্ডিয়ার অসাধারণ দৌড় নিয়ে একটু কথা বলি। টানা সাতটা ম্যাচে জয়, সত্তরটা উইকেট নেওয়া, একের পর এক টিমকে স্রেফ উড়িয়ে দেওয়া এই টিমটা কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হয়ে যেতে পারে। ত্রিদেশীয় সিরিজের সময় বলা হচ্ছিল বোলিংটা আমাদের কমজোরি। তো সেটাও এখন দুর্দান্ত ছুটছে। এই যে জয়ের অভ্যেস তৈরি হয়ে গিয়েছে টিমে, এটা কিন্তু ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে বড় কথা হল, এই টিমটা এক বা দু’জনের উপর নির্ভর করে নেই। এখানে কিন্তু আইসিসিকে একটা থ্যাঙ্ক ইউ বলতেই হচ্ছে। প্রথম ম্যাচটাই পাকিস্তানের সঙ্গে ফেলার জন্য! চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে কাপ অভিযানের শুরুতেই ও রকম দুর্ধর্ষ একটা জয় গোটা টিমের জন্য টনিকের কাজ করে দিয়েছে। সেখান থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
এই সপ্তাহটা কাটতে না কাটতে সিডনিতে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। সে দিন ভারতের সামনে কারা পড়বে, জানা যাবে শুক্রবারই। অস্ট্রেলিয়া খুব শক্তিশালী টিম, অন্যতম ফেভারিটও। কিন্তু সীমিত ওভারের ক্রিকেটে আগে থেকে কিছু বলা কঠিন। তা ছাড়া আবার আমার অভিজ্ঞতা আছে কাপ ফেভারিটদের হারানোর। তাই এ সব কথায় আমি বিশেষ পাত্তা দিই না।
কিন্তু তবু আমি চাইব, সামনের বৃহস্পতিবার ধোনির সঙ্গে টস করতে আসুক মিসবা উল হক। আর তাই আজ, শুক্রবার, আমি পাকিস্তানের জয়ের আশা নিয়ে টিভির সামনে বসব।
জীবনে এই প্রথম!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy