Advertisement
০৭ মে ২০২৪
মুম্বই কাঁটা উপড়ে প্লে-অফ দৌড়ে নাইটরা
IPL 2021

IPL 2021: নতুনদের হাত ধরেই ফিরছে হারানো স্বপ্ন

২৯ বল বাকি থাকতে সাত উইকেটে জয় মহামূল্যবান দু’পয়েন্ট দিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নেট রানরেটেও ভিটামিন যোগ করে গেল।

আগ্রাসী: ৩০ বলে ৫৩ রান করলেন বেঙ্কটেশ। বৃহস্পতিবার। পিটিআই

আগ্রাসী: ৩০ বলে ৫৩ রান করলেন বেঙ্কটেশ। বৃহস্পতিবার। পিটিআই

সুমিত ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৬:০১
Share: Save:

মায়ের ঠেলাঠেলিতে চরম অনীহা নিয়েও ক্রিকেট খেলতে শুরু করা এক যুবক। তেমন কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না, স্রেফ মজা করতে মাঠে যাওয়া। মেধাবী ছাত্রের বরং স্বপ্ন ছিল চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়ে উচ্চপদস্থ চাকুরিজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া।

ক্রিকেটীয় স্বপ্ন না দেখা সেই বেঙ্কটেশ আয়ারই এখন কলকাতা নাইট রাইডার্সের নতুন স্বপ্ন। উনিশ বছর বয়স হওয়ার আগে পর্যন্ত যাঁর জীবনে ক্রিকেট সে ভাবে প্রবেশই করেনি, ভারতে হওয়া প্রথম পর্বের আইপিএলেও যাঁকে কেউ চিনত না, স্কোর বলতে যিনি রান নয় ম্যানেজমেন্ট পরীক্ষার মার্কশিট বুঝতেন, তিনিই এখন তরোয়াল হাতে নির্ভীক নাইট যোদ্ধা! উদ্দাম ঘোড়া ছুটিয়ে একের পর এক মহাতারকার দলকে ধরাশায়ী করে যাচ্ছেন। প্রথম ম্যাচে বিরাট কোহালির রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর লুটিয়ে পড়েছিল। বৃহস্পতিবার রক্তাক্ত হল রোহিত শর্মার মুম্বই ইন্ডিয়ান্স। সেই মুম্বই ইন্ডিয়ান্স, যারা কি না আইপিএলের জন্মলগ্ন থেকে কেকেআরের নিশি-আতঙ্ক!

কেকেআর শুধু জিতল না, চাবুক মেরে জিতল। ২৯ বল বাকি থাকতে সাত উইকেটে জয় মহামূল্যবান দু’পয়েন্ট দিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নেট রানরেটেও ভিটামিন যোগ করে গেল। প্লে-অফের সাপলুডোর খেলায় পরের দিকে যা খুবই কাজে আসতে পারে। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সকে হঠিয়ে টেবলে চার নম্বরে উঠে এল কেকেআর। নেট রানরেট প্লাসে রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছিল, কেউ যেন জাদুকাঠির স্পর্শে দু’টো দলকে পাল্টাপাল্টি করে দিয়েছে। দু’শহরের দ্বৈরথে এত কাল ধরে কুঁকড়ে থাকা কলকাতাকে করে দিয়েছে টগবগে মুম্বই। আর মুম্বইকে করে
দিয়েছে রক্তাল্পতায় ভোগা কলকাতা।

ওয়াংখেড়েতে সেই উদ্বোধনী বছরে ৬৭ অলআউট থেকে শুরু করে বৃহস্পতিবারের আগে পর্যন্ত ২৮ বারের সাক্ষাতে ২২ বার হারের স্মৃতি এতটাই দগদগে যে, শোনা যায় এই ম্যাচে মাঠে আসার ঝুঁকিটুকুও আর নেন না শাহরুখ খান। গিয়েই তো দেখতে হবে কেকেআর ২৫-৩ ধুঁকছে বা মুম্বই ইন্ডিয়ান্স বিনা উইকেটে ৭০। তার পরে সেই তো মাথা নিচু করে ফিরে আসা। মুম্বইয়ের বাদশা তিনি, অথচ আইপিএল গ্রহে নিজের শহরের কাছেই বারবার লজ্জিত হওয়ার দৃশ্য ফিরে আসে! কে ভেবেছিল, ‘অ্যালেক্সা সুইচ অন করো’-র মতো কেউ বৃহস্পতিবার বলে উঠবে, বেঙ্কটেশ আয়ার আনো, রাহুল ত্রিপাঠী আনো আর কেকেআর মালিকও মুম্বই ম্যাচের ‘দেবদাস’ থেকে ‘বাজিগর’ হয়ে উঠবেন! ৩০ বলে ৫৩ করে যশপ্রীত বুমরার স্লোয়ারে ফিরে গেলেন বেঙ্কটেশ। তত ক্ষণে বর্তমান কোচ ব্রেন্ডন ম্যাকালামের ভঙ্গিতে তিনি ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছেন মুম্বইয়ের তারা-ঝলমলে বোলিংকে। ইনিংসে চারটি চার, তিনটি ছক্কা। যার প্রত্যেকটিতে ভয়ডরহীন ক্রিকেটের ছাপ। ট্রেন্ট বোল্টের প্রথম ওভারেই চতুর্থ বলে যে ভাবে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে পুল করে ছক্কা মারলেন বাঁ-হাতি ওপেনার, কে বলবে মাত্র দ্বিতীয় ম্যাচ খেলছেন আইপিএলে! উল্টো দিকে দেশকে বিশ্বকাপ ফাইনালে তোলা পেসার! অবিশ্বাস্য! হরভজন পর্যন্ত ডাগআউটে লাফিয়ে উঠলেন! পাশে ম্যাকালাম। চোখেমুখে গুরুদক্ষিণা পাওয়ার তৃপ্তি।

চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের মোহ শেষ মুহূর্তে ছেড়ে ক্রিকেটে আসা বেঙ্কটেশ। আর বাইশ গজে মুম্বই-বধে তাঁর সঙ্গী কাশ্মীরে ভারত-পাক সীমান্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাইন পরিষ্কার করতে থাকা এক কর্নেল-পুত্র। তিনি, রাহুল ত্রিপাঠী— ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুণ ভাবে নজর কেড়েও জীবন থমকে গিয়েছিল একটি ট্রান্সফারে। সংসদে জঙ্গি হানার পরে বাবার পোস্টিং হয় শ্রীনগরে। রাহুল-সহ গোটা পরিবারকেই অশান্ত সীমান্তে চলে যেতে হয়। ‘অপারেশন পরাক্রম’-এ ব্যস্ত থাকা বাবা সারা দিন শ্রীনগরের রাস্তায় ভারতীয় সৈন্যদের জন্য পেতে রাখা মাইন খুঁজে নিষ্ক্রিয় করতেন। রাহুলদের মাথায় তখন আর ক্রিকেট ঘুরত না। শুধু অপেক্ষা চলত বাবা কখন নিরাপদে বাড়ি ফিরবেন। প্রায় চার বছর শ্রীনগরেই ক্রিকেটহীন কেটে গিয়েছিল। তার পরেও প্রত্যাবর্তন ঘটিয়ে আইপিএলের মতো মঞ্চে ফুল ফোটাচ্ছেন। গত বার তাঁর ম্যাচ জেতানো ইনিংস দেখে শাহরুখ মরুশহরের গ্যালারি থেকে বলে উঠেছিলেন সেই বিখ্যাত সংলাপ— ‘রাহুল, নাম তো সুনা হি হোগা!’ এ দিন তিন নম্বরে নেমে বুমরা, বোল্টদের পেতে রাখা মাইন নিষ্ক্রিয় করলেন। বেঙ্কটেশ এবং রাহুল ৫২ বলে ৮৮ রান যোগ করে ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিয়ে গেলেন। ৪২ বলে ৭৪ নট আউট থেকে জিতিয়ে, তবেই মাঠ ছাড়লেন রাহুল। কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরাটা যে শ্রীনগরে থাকতে নির্ভীক, দায়বদ্ধ কর্নেলের থেকে শিখে নেওয়া!

কেকেআরের ঘরে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ আরও আছে। বিস্ময় স্পিনার সি ভি বরুণ। এক ওভারে সাত রকম বল করতে পারেন। গুগলি, ক্যারম বল, অফস্পিন, লেগস্পিন, স্লাইডার কী নেই! তিনিও ক্রিকেটে এসেছেন অনেক দেরিতে। বেঙ্কটেশ যেমন সিএ ডিগ্রি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তেমন বরুণ ছিলেন ‘আর্কিটেক্ট’। টুকটাক স্থানীয় ক্রিকেট খেলতেন চেন্নাইয়ে। তামিলনাড়ু প্রিমিয়ার লিগ থেকে উত্থান। বন্ধুদের থেকে খোঁজ পেয়ে কলকাতার নেটে ডেকে আনেন দীনেশ কার্তিক। আর ফিরে তাকাতে হয়নি। নাইটদের দ্বিতীয় পর্বের আইপিএল অভিযানকে আরও বেশি করে আলোকিত করে দিচ্ছে নতুন মুখদের দুর্ধর্ষ এই সব জীবনকাহিনি।

সঙ্গে সুনীল নারাইন, আন্দ্রে রাসেলের অভিজ্ঞতা এবং নৈপুণ্য। নারাইন ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে ভাল বোলিং করে এসেছেন। তার ছোঁয়া দেখা গেল এ দিন। রোহিত শর্মাকে ফিরিয়ে তিনিই দিলেন ‘টার্নিং পয়েন্ট’। ৯.২ ওভারে রোহিত-কুইন্টন ডি’কক ৭৮ তুলে ফেলেছিলেন। তখন মনে হচ্ছিল, অন্তত ১৮০ তুলবে মুম্বই। কেকেআর ড্রেসিংরুম থেকে অভিনব সব সঙ্কেত আসতে দেখা গেল। রিমোট কন্ট্রোলে মাঠের ক্যাপ্টেন্সিও পরিচালিত হচ্ছে আজকাল। তার জন্য বিশেষজ্ঞ কোচও আনা হয়েছে। বরুণ, নারাইন, লকি ফার্গুসন মিলে লড়াইয়ে ফেরালেন কলকাতাকে।

প্রথম পর্বেও যে দলটাকে খাঁচায় বন্দি পাখি মনে হচ্ছিল, তারাই যেন মুক্ত বিহঙ্গের মতো আকাশে উড়ছে। তাতে অবশ্যই ব্রেন্ডন ম্যাকালামের হাত। তাঁর আগ্রাসী ক্রিকেটের মন্ত্রেই খেলছে দল। ১৫৫ তাড়া করতে নেমে শুরু থেকেই আক্রমণে যান শুভমন গিল, বেঙ্কটেশ আয়ার। আর গিয়ার পাল্টায়নি নাইটরা। যা ইঙ্গিত, এ বারে ড্রেসিংরুমের কর্তৃত্বও শীর্ষ কর্তার থেকে সরিয়ে তুলে দেওয়া হয়েছে কোচের হাতে। যার ফলে ক্রিকেটীয় মস্তিষ্করা দল চালাচ্ছেন এবং ডাগআউটে সবাই পণ্ডিত নয়। নতুন মুখের কেকেআর শুধু নয়, নতুন মন্ত্রের কেকেআরও। যেখানে ফের জোরে বাজছে ‘করব, লড়ব, জিতব রে’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

IPL 2021 kolkata knight riders KKR Venkatesh Iyer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE