Advertisement
১৬ অক্টোবর ২০২৪

মেলবোর্নের মন নেই ক্রিকেটে

রবিবাসরীয় দুপুরে এমসিজি পাড়া দিয়ে হাঁটতে গিয়ে গুলিয়ে যাচ্ছিল, জায়গাটা ঠিক কোথায়? ভিক্টোরীয় স্থাপত্যের এক-একটা পুরনো বাড়ি। মাথার ওপর মেঘলা আকাশ। অবিরাম হাওয়া। আর যে কোনও সময় বৃষ্টি নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা। এ তো গ্রীষ্মকালের ইংল্যান্ড! রোববার দুপুরে এই রকমই আবহাওয়ায় একটা রাজসিক আলস্যের মধ্যে যে আরাম করে ব্যাকস্ট্রোক কাটে। ভ্রম দ্রুত কেটে যাবে শব্দদূষণে। গাড়ির তীব্র আওয়াজে। স্থানীয় মেলবোর্নিয়ান বুঝিয়ে দেবেন, ওই যে ফর্মুলা ওয়ানের আওয়াজ পাচ্ছেন?

গৌতম ভট্টাচার্য
মেলবোর্ন শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৫ ০৩:১৮
Share: Save:

রবিবাসরীয় দুপুরে এমসিজি পাড়া দিয়ে হাঁটতে গিয়ে গুলিয়ে যাচ্ছিল, জায়গাটা ঠিক কোথায়? ভিক্টোরীয় স্থাপত্যের এক-একটা পুরনো বাড়ি। মাথার ওপর মেঘলা আকাশ। অবিরাম হাওয়া। আর যে কোনও সময় বৃষ্টি নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা।

এ তো গ্রীষ্মকালের ইংল্যান্ড! রোববার দুপুরে এই রকমই আবহাওয়ায় একটা রাজসিক আলস্যের মধ্যে যে আরাম করে ব্যাকস্ট্রোক কাটে।

ভ্রম দ্রুত কেটে যাবে শব্দদূষণে। গাড়ির তীব্র আওয়াজে। স্থানীয় মেলবোর্নিয়ান বুঝিয়ে দেবেন, ওই যে ফর্মুলা ওয়ানের আওয়াজ পাচ্ছেন?

এমসিজি চত্বর থেকে বেশ খানিকটা দূরে ইভেন্টটা হচ্ছে। এটা বরং শেন ওয়ার্নের পুরনো ক্লাবের কাছাকাছি অ্যালবার্ট পার্কে। তবু এমসিজির উল্টো দিকে হিল্টন অন দ্য পার্ক হোটেল থেকে দুপুর-দুপুর কম্পিটিশনের ব্যাজ লাগিয়ে বার হচ্ছেন ইভেন্ট ম্যানেজার বা স্বেচ্ছাসেবকেরা।

আর গোটা বিশ্বকাপের মতোই মেলবোর্নে কোয়ার্টার ফাইনালকে স্বাগত জানাতে কোনও রকম প্রচার নেই। না কোনও পোস্টার। না কোনও বিলবোর্ড। মেলবোর্ন শহরের পুরসভা যে অন্তত বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল ঘিরে উত্তেজিত হচ্ছে না, সেটা শহরটা খানিক ঘুরে বেড়ালেই বোঝা যায়! তারই মধ্যে আবার চার দিন ধরে ফর্মুলা ওয়ানের অতিথিরা। অকল্যান্ড থেকে নেমে বোঝাই যাচ্ছিল না যে, আরও একটা ক্রিকেটীয় শহরে ঢুকলাম!

ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার অফিস একেবারে মাঠের গায়েই। তারা তখনও জানে না যে, সরফরাজ আহমেদ আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানের নতুন নায়ক হিসেবে উত্থিত হয়ে এই টুর্নামেন্টকে আরও রংবাহারি করে দেবেন। ম্যাচের পর অবশ্য ফোনে পাওয়া গেল এবং ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার পদস্থ অফিসারেরা উচ্ছ্বসিত। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা আর বাংলাদেশ এরা প্রত্যেকে কোয়ার্টার ফাইনালে মানে তো গোটা উপমহাদেশই তাদের পুরো জনসমর্থন নিয়ে বিশ্বকাপের বাণিজ্যিক আঙিনায় ঢুকে পড়ল! এই টুর্নামেন্টের আর কী দরকার? ফোনে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার মুখপাত্র বললেন, এ বারের বিশ্বকাপে প্রমাণ হল, ক্রিকেট এখন দক্ষিণ এশীয় ক্রীড়া। এই টুর্নামেন্টে যা যা প্রভাবশালী ঘটনা, সবেরই মূলে দক্ষিণ এশিয়া।

ক্রিকেট অস্ট্রেলীয় কর্তারা একটা মোদ্দা কথা অবশ্য টের পেয়ে গিয়েছেন, যে সাফল্য দেখা যাচ্ছে, সেটা ভারতীয় সমর্থকদের আবেগের। তাঁদের নিজেদের লোক মোটেও মাঠ ভেঙে আসেনি। তাই টিকিটের দাম কম করে বিগ ব্যাশের (অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেট প্রতিযোগিতা) দামে রাখা হচ্ছে। বক্সিং ডে টেস্ট ম্যাচের টিকিট যেখানে চল্লিশ থেকে ষাট ডলার হয়, সেখানে এখানে বিগ ব্যাশের বেশির ভাগ টিকিটের দাম কুড়ি ডলার আর বাচ্চাদের জন্য পাঁচ ডলার। তবে এতেও কর্তাদের সন্দেহ কাটছে না যে, সিডনিতে ভারত-অস্ট্রেলিয়া সেমিফাইনাল সত্যিই হলে উইক ডে-তে কত সংখ্যক অস্ট্রেলীয় মাঠে আসবেন? মুখপাত্রটি বললেন, “সে দিন মনে হওয়া বিচিত্র নয় যে, অস্ট্রেলিয়া বিদেশে সেমিফাইনাল খেলছে!”

ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার কর্তারা বৃহস্পতিবার ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচে জমকালো দর্শক উপস্থিতি আশা করছেন। পরিবেশ উৎসাহব্যঞ্জক নয়, সেই ছবি তো চোখের সামনে দেখছি। কিন্তু অন্তর্জগতে উৎসাহী সমর্থকের ঘড়ি ঠিক অ্যালার্ম দিয়ে রাখা! হালকা বৃষ্টিবিক্ষত মহানগরী দেখে চটপট এঁরা গুগ্লে এমসিজি কোয়ার্টার ফাইনালের সম্ভাব্য আবহাওয়া দেখে নিচ্ছেন। ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

যেমন তাচ্ছিল্যে খেলোয়াড় জীবনে ভারতকে উড়িয়ে দিয়ে আগাম ঘোষণা করতেন, সিরিজ ৩-০ মারব, সে ভাবেই রাতের টিভিতে গ্লেন ম্যাকগ্রা বলে দিলেন, “ইন্ডিয়া টু স্ট্রং ফর বাংলাদেশ।” এ বারে মন দিয়ে যাঁরা তামিমদের প্রত্যেকটা খেলা দেখেছেন, তাঁরা একেবারেই একমত হবেন না। নিউজিল্যান্ডকেই যে ভাবে তাদের বেছে নেওয়া উইকেটে প্রায় হারিয়ে দিচ্ছিল বাংলাদেশ, সেটা দেখার পর বরং ভারতের সতর্ক হওয়া উচিত। টাইগারদের হালকা ভাবে নেওয়ার মানসিকতা নিয়েছ কি মরেছ! কিন্তু তখনকার মতো মনে হচ্ছিল, আম বাংলাদেশ কি ম্যাকগ্রার কথা শুনল? শুনে কী ভাবে সেটা নিল?

কোনও কোনও বিশেষজ্ঞের ওপর এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সমর্থকেরা প্রচণ্ড খেপে রয়েছেন। যেমন রামিজ রাজা। রামিজের নাকি এই মুহূর্তে বডিগার্ড ছাড়া ঢাকার রাস্তায় চলাফেরা করা বিপজ্জনক হতে পারে! কারণ ইংল্যান্ড ম্যাচে মাশরফিদের দ্রুত দু’উইকেট পড়া দেখে রামিজ তীব্র তাচ্ছিল্যে বলে বসেছিলেন, ‘ওহে বাংলাদেশ দেখো, বড় ক্রিকেট খেলতে হলে কী দরকার’!

রোববার সিডনি থেকে ফোনে ভারতের প্রথম বিদেশি কোচ বললেন, বিশ্বকাপের আদ্ধেক খেলা দেখেননি। কিন্তু এমসিজি কোয়ার্টার ফাইনাল দেখবেন বলে ভেবে রেখেছেন। ওটা যে পেশাদারিত্বের সঙ্গে স্পিরিটের লড়াই হবে। বক্তার নাম ববি সিম্পসন। অনেকের তাই মনে হচ্ছে, রামিজ প্রজাতি দ্রুতই হয়তো সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়ে দেখা দেবেন!

দুটো টিমের কেউ অবশ্য এমসিজি-র ঘাসে এ দিন পা রাখেনি। বাংলাদেশ ছুটি দিয়ে দেয় প্লেয়ারদের। যা তাঁদের অবশ্যই প্রাপ্য। হ্যামিল্টনে প্রায় মাঝরাত অবধি মাঠে থেকে যে ভাবে ভোরবেলা বাসে করে তাঁদের অকল্যান্ড এনে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মেলবোর্নের বিমানে চড়ানো হয়েছে, সেটা আইসিসিতে দেশের জায়গাটা শক্তপোক্ত থাকলে সম্ভব ছিল না। কোথাও না কোথাও প্রতিবাদ হতোই।

ভারত যেমন মুহূর্মুহূ সূচি বদলায়! কথা ছিল, অকল্যান্ডে খেলা শেষ করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তারাও মেলবোর্নের প্লেনে উঠবে। ঠিক সাকিবদের মতো। সেই মতো ভারতীয় সাংবাদিককুলও প্লেনের টিকিট বুক করে রাখেন। কেউ প্লেয়ারদের প্লেনে। কেউ তার কাছাকাছি সময়ের ফ্লাইটে। কিন্তু আগের দিন ম্যাচের পর হঠাৎ মিডিয়া ম্যানেজারের ই-মেল আসে যে, টিম নিউ জিল্যান্ড থেকে রোববার নয়, সোমবার আসবে। ঠিক সিদ্ধান্ত যে, নিউ জিল্যান্ডে থাকলেই বিশ্রামটা সম্ভব।

কিন্তু সেটা কি ম্যাচের পর নেওয়া হয়েছিল, যখন তা জানানো হল? কখনও হতে পারে? এতগুলো বিজনেস ক্লাস টিকিট একসঙ্গে দুম করে পাওয়া যায় নাকি আগে বুক না করলে? জাতীয় মিডিয়াকে নির্ঘাত পরে জানানো হয়েছে, যাতে অত রাতে তাদের আর টিকিট বদলানোর সুযোগ না থাকে!

বাংলাদেশ যেমন শুয়ে-বসে হোটেলে গোটা দিন ছুটির মেজাজে কাটাল। সৌম্য সরকার দু’একজন কর্তার সঙ্গে ফর্মুলা ওয়ান দেখতে গেছিলেন। অকল্যান্ডে ভারতের কে কী করলেন, জানার সুযোগ কম। প্রেসের প্রায় পুরো ঝাঁকটা যে সকালে মেলবোর্ন চলে এসেছে!

কে বলতে পারে, লাঞ্চের সময় এই জন্য বিশেষ প্রশংসাও কুড়োননি মহেন্দ্র সিংহ ধোনি! ক্যাপ্টেন, কাল তোমার পুল মারার চেয়েও ভাল হয়েছে এই শটটা! মাস্টারস্ট্রোক!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE