প্রথম সেট দেখে মনে হয়েছিল, ফেলিক্স অগার আলিয়াসিমেকে উড়িয়ে ইউএস ওপেনের ফাইনালে উঠবেন ইয়ানিক সিনার। কিন্তু টেনিসে যে প্রতিটি সেটে খেলার ছবি বদলে যায় তা দেখল আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়াম। পিছিয়ে পড়েও লড়াই করলেন আলিয়াসিমে। সিনারকে এক সেটে হারালেনও। এক বারের জন্য হলেও হারের আশঙ্কা ভর করেছিল বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়ের মাথায়। চোটের সমস্যাও ভোগাল সিনারকে। কিন্তু সেরাদের জন্য একটি সুযোগই যথেষ্ট। সেই সুযোগটাই দিলেন আলিয়াসিমে। চতুর্থ সেটে ডবল ফল্ট করে নিজের সার্ভিস খোয়ালেন। তার খেসারত দিতে হল কানাডার খেলোয়াড়কে। লড়েও হারতে হল। ৩ ঘণ্টা ২১ মিনিটে চার সেটের লড়াই (৬-১, ৩-৬, ৬-৩, ৬-৪) জিতে ফাইনালে সিনার। সেখানে তাঁর অপেক্ষায় কার্লোস আলকারাজ়। চলতি বছর ফরাসি ওপেন ও উইম্বলডনের পর আরও এক গ্র্যান্ড স্ল্যামের ফাইনালে সিনার বনাম আলকারাজ়। আরও এক বার দেখা যাবে এক বনাম দুইয়ের লড়াই।
এক দিকে সিনারের সামনে ছিল টানা পাঁচ গ্র্যান্ড স্ল্যামের ফাইনাল খেলার হাতছানি। এই ম্যাচের আগে হার্ড কোর্টে টানা ২৬টি ম্যাচ জিতেছিলেন তিনি। অন্য দিকে আলিয়াসিমে প্রথম বার কোনও গ্র্যান্ড স্ল্যামের ফাইনাল খেলার লক্ষ্যে নেমেছিলেন। প্রতিপক্ষ সিনার হলেও পরিসংখ্যান ছিল তাঁর পক্ষে। দু’জনের মধ্যে এর আগে তিন বারের সাক্ষাতে দু’বার জিতেছেন আলিয়াসিমে। ফলে কেরিয়ারের দ্বিতীয় সেমিফাইনাল খেললেও তিনি যে লড়াই করবেন সেই ইঙ্গিত ছিল। কিন্তু তিনি সিনারকে এতটা বেগ দেবেন তা বোঝা যায়নি।
খেলার শুরুটা বিশ্বের এক নম্বরের মতোই শুরু করেছিলেন সিনার। প্রথম সেটের দ্বিতীয় গেমেই আলিয়াসিমের সার্ভিস ভাঙেন তিনি। আবার ষষ্ঠ গেমে এক ছবি। সিনারের সার্ভিস ও তাঁর পাওয়ার গেমের সামনে অসহায় দেখাচ্ছিল বিশ্বের ২৫ নম্বরকে। প্রথম সার্ভিসে বেশি পয়েন্ট না পেলেও সিনারের দ্বিতীয় সার্ভিস ভোগাচ্ছিল আলিয়াসিমেকে। সিনারের দু’টি সার্ভিস দু’ধরনের। প্রথম সার্ভিস তিনি করে গায়ের জোরে। দ্বিতীয় সার্ভিসের সময় জোরের থেকে বেশি থাকে টপ স্পিন। সেই স্পিন সামলাতে পারছিলেন না কানাডার খেলোয়াড়। আলিয়াসিমেকে দাঁড় করিয়ে প্রথম সেট জেতেন সিনার।
আরও পড়ুন:
কিন্তু দ্বিতীয় সেটে বদলে গেল খেলা। হঠাৎ করেই সিনারের সার্ভিস নিষ্প্রভ দেখাতে শুরু করল। উল্টে আলিয়াসিমে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী শট খেলা শুরু করলেন। আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়ামের দর্শকেরা ছিলেন আলিয়াসিমের দিকে। তাঁর প্রতিটি পয়েন্টের পর যে ভাবে চিৎকার হচ্ছিল, তাতে বোঝা যাচ্ছিল, সিনার দর্শকদের সমর্থন বিশেষ পাবেন না। কিন্তু চ্যাম্পিয়নেরা তো আর দর্শকদের সমর্থনের উপর নির্ভর করেন না। তবে এ ক্ষেত্রে সিনার সমস্যায় পড়লেন। প্রথম তিনটি সার্ভিস ধরে রাখলেও তাঁর চতুর্থ সার্ভিস ভাঙলেন আলিয়াসিমে। পরের গেমে নিজের সার্ভিস ধরে রেখে সেটও জিতে গেলেন।
দ্বিতীয় সেটে সিনারের প্রথম সার্ভিস খুব খারাপ হয়। তাঁর সার্ভিসের গতি এক ধাক্কায় অনেকটা কমে যায়। বোঝা যাচ্ছিল, কোথাও সমস্যা হচ্ছে। উল্টোদিকে আলিয়াসিমে ধারাবাহিক ভাবে প্রথম সার্ভিস থেকে পয়েন্ট তুলছিলেন। দ্বিতীয় সেটের পর মেডিক্যাল বিরতি নিলেন সিনার। নোভাক জোকোভিচের মতো কোর্টে নয়, লকার রুমে চলে গেলেন তিনি। মিনিট তিনেক পরে ফিরলেন। ধারাভাষ্যকারেরা জানালেন, পেটে স্ট্র্যাপ বেঁধে ফিরেছেন ইটালির তারকা। পেটের পেশিতে টান ধরায় সার্ভিসে সমস্যা হচ্ছিল তাঁর।
ফিরে এসে সিনার আবার পুরনো মেজাজে। আগের মতো সার্ভিস করতে শুরু করলেন। তবে তত ক্ষণে আলিয়াসিমেও আত্মবিশ্বাস পেয়েছেন। তাই তিনিও লড়াই করলেন। এ বার আর প্রথম সেটের মতো একপেশে খেলা হল না। তবে তার মাঝেই আলিয়াসিমের সার্ভিস ভাঙলেন সিনার। গ্র্যান্ড স্ল্যামের সেমিফাইনালে একটি ব্রেক পয়েন্টই তফাত গড়ে দেয়। তৃতীয় সেটেও তাই হল। নিজের সার্ভিস ধরে রেখে সেট জিতে নিলেন সিনার।
তৃতীয় সেটের পর এ বার মেডিক্যাল বিরতি নিলেন আলিয়াসিমে। ধারাভাষ্যকারেরা বলছিলেন, রাতের দিকে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। সঙ্গে বাড়ছে আপেক্ষিক আর্দ্রতা। ফলে খেলোয়াড়দের সমস্যা হচ্ছে। অনেক বেশি ঘাম হওয়ায় শরীরে জলের অভাব হচ্ছে। সেখান থেকেই পেশিতে টান ধরছে। সেই কারণেই দুই তারকাকেই মেডিক্যাল বিরতি নিতে হল।
খেলা যত গড়াল তত র্যালি লম্বা হল। প্রতিটি গেম জিততে সময় বেশি লাগল। কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়ছিলেন না। প্রতিটি পয়েন্টের জন্য লড়াই হচ্ছিল। চতুর্থ সেটের চতুর্থ গেম চলল প্রায় ১২ মিনিট। তিন বার সিনারের সার্ভিস ভাঙার সুযোগ পান আলিয়াসিমে। তিন বারই ফেরেন সিনার। ‘এস’, ফোরহ্যান্ড, ব্যাকহ্যান্ড, ডাউন দ্য লাইন রিটার্ন কিছুর অভাব ছিল না। এক বারও দেখে মনে হয়নি, সিনারের থেকে ২৪ ধাপ পিছনে রয়েছেন আলিয়াসিমে। দেখে মনে হচ্ছিল, দুই সেরা একে অপরের বিরুদ্ধে নেমেছেন। আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়ামের দর্শকেরা সেই লড়াই উপভোগ করলেন।
পঞ্চম গেমে ভুল করলেন আলিয়াসিমে। মোক্ষম সময়ে ডবল ফল্ট করলেন তিনি। সিনারের সেই সুযোগটাই দরকার ছিল। তিনি তা কাজে লাগালেন। আলিয়াসিমের সার্ভিস ভাঙলেন। এক বার এগিয়ে যাওয়ার পর তাঁকে আটকানো কঠিন ছিল। সেটাই হল। নিজের সার্ভিস ধরে রেখে ম্যাচ জিতে গেলেন তিনি। তবে যে ভাবে সিনারকে প্রতিটি পয়েন্টের জন্য লড়তে হল, যে ভাবে পরিশ্রম করে জিততে হল, তার জন্য প্রশংসা প্রাপ্য আলিয়াসিমের। ম্যাচ হারলেও মন জিতলেন তিনি। পরাজিত খেলোয়াড়ের জন্য দর্শকেরা যে ভাবে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিলেন তাতে পরিষ্কার, আগামী দিনে তারকা হওয়ার সব মশলা রয়েছে আলিয়াসিমের মধ্যে।