সোনালি দাড়ির বছর চব্বিশের যুবককে এক ঝলক দেখলে ব্রেন্ডন ম্যাকালামের উত্তরসুরি বলে ভাবাই যায় না!
রোগাপাতলা চেহারা। ট্যাটুর আধিক্য কোথাও চোখে পড়বে না। চুইংগাম চিবোতে-চিবোতে বোলারের দিকে শীতল দৃষ্টি তুলে তাকাবেন না। মাঠ কেন, মাঠের বাইরেও তাঁর উপস্থিতি নাকি আলাদা করে টের পাওয়া কঠিন। শুধু যতক্ষণ ব্যাটটা হাতে থাকে, তাঁর উপস্থিতি ততক্ষণ।
তিনি কেন উইলিয়ামসন। নিউজিল্যান্ড মিডিয়া এখন যাঁকে ‘রাহুল দ্রাবিড়’ বলে ডাকছে!
ভারত সফর কভার করতে খুব বেশি নিউজিল্যান্ড সাংবাদিক আসেননি কানপুরে। মাত্র একজন। নতুন টেস্ট অধিনায়ক নিয়ে তাঁকে বলতে শোনা গেল যে, বহু দিক থেকে কেন উইলিয়ামসন এক ব্যতিক্রমী নাম। নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক চাইলে দু’হাতে ব্যাট করতে পারেন। ক্রিকেট পৃথিবীতে যা বিরল। আবার ক্যাপ্টেন হিসেবে আসার পরেও এমন একটা কাজ করেছেন, যা অধিনায়কদের খুব একটা করতে দেখা যায় না। অর্থাৎ, টিমে এসে নিজে তিনি কোনও নতুন সংস্কৃতি আমদানির চেষ্টা নাকি করেননি। চেষ্টা করেননি, নিজের দর্শনে টিমকে চালাতে। বরং ধরে রেখেছেন পুরনো দর্শন।
ম্যাকালাম-দর্শন। নিজে দ্রাবিড় ঘরানার হয়েও!
শোনা গেল, ক্রিকেটের বাইরে কোনও তারকাসুলভ দেখনদারিতে খুব একটা বিশ্বাস রাখেন না বর্তমান অধিনায়ক। দামি গাড়ি করে ঘোরেন না। মাঠেও ‘আমি ক্যাপ্টেন’-সুলভ আচরণ নেই। যতটুকু যা ক্রিকেট-সম্পর্কিত। উইলিয়ামসনের ক্রিকেট-সাধনা নিয়ে নাকি প্রচুর লেখা সম্ভব, কিন্তু চরিত্র উইলিয়ামসন নন। যে দিক থেকে তাঁর সঙ্গে দ্রাবিড়ের মিল পায় নিউজিল্যান্ড মিডিয়া। নামটাও সেই কারণে দেওয়া হয়েছে। আর নিজের দর্শন আমদানির চেষ্টাতেই যাননি কারণ তিনি নাকি বুঝে গিয়েছিলেন যে, বর্তমান টিমটার মজ্জায় ম্যাকালামের ‘ফিয়ারলেস ক্রিকেটে’র ব্যাপারটা ঢুকে গিয়েছে। সেটাকে বদলানোর চেষ্টায় গিয়ে লাভ নেই। বরং নিজেকে সেই কাঠামোয় জুড়ে নেওয়া ভাল!
ঠিকই করেছেন বোধহয়। ম্যাকালাম জমানায় উদ্ভুত ‘ফিয়ারলেস ক্রিকেট’-কে তো আজও ভয় পায় প্রতিপক্ষরা। বিরাট কোহালিই এ দিন বলছিলেন যে, নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের একটা ব্যাপার তাঁর বেশ ভাল লাগে। “ওদের মনোভাবটা। ক্রিকেটটা ওদের কাছে জীবন-মৃত্যুর ব্যাপার নয়। ওরা ক্রিকেটকে উপভোগ করতে জানে। ব্রেন্ডন ম্যাকালামই ব্যাপারটা এনেছিল। ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলতে ও-ই শিখিয়েছিল। যা খুব সহজ নয়। মাঠের বাইরে থেকে ক্রিকেটকে উপভোগ করো বলা যত সহজ, মাঠে নেমে সেটা করা তত নয়,” বলছিলেন বিরাট। এবং ভারত অধিনায়ক এটাও ভাল জানেন যে, বর্তমান নিউজিল্যান্ড টিমে কেউ যদি ভয়ডরহীন ক্রিকেটের প্রতিভূ হয়ে তাঁর সামনে টেস্ট সিরিজে দেওয়াল হয়ে দাঁড়াতে পারেন, তিনি বিপক্ষ অধিনায়ক, নিউজিল্যান্ডের ‘দ্রাবিড়’।
রস টেলর আগের মতো ভয়ঙ্কর আর নন আজ। মার্টিন গাপ্টিলের ফর্মের দুর্দশা এতটাই চলছে যে, প্রথম টেস্টটা খেলবেন কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। লুক রঞ্চি ভারত সফরের প্র্যাকটিস ম্যাচে সেঞ্চুরি করে তাঁর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত এবং দুশ্চিন্তায় ফেলার মতো ওই একজনকেই পাওয়া যাচ্ছে। কোহালি, স্টিভ স্মিথ, জো রুটদের সঙ্গে ‘বিগ ফোর’ ক্লাবে এমনি-এমনি তো রাখা হয় না উইলিয়ামসনকে। ৫২ টেস্টে সাড়ে চার হাজারের কাছাকাছি রানের জন্য রাখা হয়। পঞ্চাশের উপর গড়ের জন্য রাখা হয়। প্রয়াত মার্টিন ক্রো-ও এমনি তাঁকে দেখে বলেননি যে, নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানের খোঁজ সম্ভবত পেয়ে গিয়েছে নিউজিল্যান্ড। কোহালি তো একবার উচ্চকিত প্রশংসাও করে ফেললেন।
নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক যতই বাহ্যিক ভাবে চুপচাপ স্বভাবের হন না কেন, চাপা আগুন যে একটা আছে, বোঝা যায়। বোঝা যায় যখন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নাগপুরের টার্নারে নিজেদেরই মারণাস্ত্রে ভারতের মৃত্যু-প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দেওয়ায় বলে ফেলেন, “যদি এখানেও সেটা হয়, আশা করব ফলাফলটা আবার একই রকম হবে! যা-ই হোক, টিমকে বলেছি পিচ নয়, বল দেখে খেলো।”
শান্ত আগ্রাসন বলেও ক্রিকেটে একটা কথা আছে। কোনও এক রাহুল শরদ দ্রাবিড়েরও তো ছিল!