Advertisement
E-Paper

চোকার নয়, প্রমাণ করল ফুটবলের জাদুকর

রাশিয়ায় মেসিহীন বিশ্বকাপের একটা আতঙ্ক গোটা ফুটবল দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। অবিশ্বাস্য, অভাবনীয় হ্যাটট্রিকে মেসি ওর দেশ আর্জেন্তিনাকে তো বিশ্বকাপের মঞ্চে তুলে দিলই।

সুব্রত ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০১৭ ০৪:১৩
ঐশ্বরিক: ইকুয়েডরের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করে রাশিয়া বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন নিশ্চিত করলেন। লিওনেল মেসিকে এমন বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস করতেও দেখা যায় না সচরাচর। ছবি: এএফপি

ঐশ্বরিক: ইকুয়েডরের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করে রাশিয়া বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন নিশ্চিত করলেন। লিওনেল মেসিকে এমন বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস করতেও দেখা যায় না সচরাচর। ছবি: এএফপি

এ যেন এলাম, দেখলাম আর জয় করলাম! বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে ইকুয়েডরের বিরুদ্ধে আর্জেন্তিনার ৩-১ জয় দেখে লিওনেল মেসি সম্পর্কে এই কথাগুলোই মাথায় আসছে।

রাশিয়ায় মেসিহীন বিশ্বকাপের একটা আতঙ্ক গোটা ফুটবল দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। অবিশ্বাস্য, অভাবনীয় হ্যাটট্রিকে মেসি ওর দেশ আর্জেন্তিনাকে তো বিশ্বকাপের মঞ্চে তুলে দিলই। সারা পৃথিবীর অসংখ্য ফুটবলভক্তকেও চিন্তামুক্ত করল। অথচ, ৯ হাজার ফিট উচ্চতায় আর্জেন্তিনার এই ম্যাচটাও শুরু হয়েছিল ঘোর দুর্যোগের মধ্যে। ৪৫ সেকেন্ডের মধ্যে গোল দিয়ে দিল ইকুয়েডর। কিন্তু মেসিকে তখন যতটা না উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি জেদী মনে হল। যেন সতীর্থদেরও বলে দিতে চাইছে, আমরা পারব।

সেই মুখচোখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, অন্য রকম প্রত্যয় নিয়ে নেমেছে মেসি। এমনিতে পন্ডিতরা নানা কথা ওর সম্পর্কে বলেছে, লিখেছে। ব্রাজিল বিশ্বকাপে গত বার হারল জার্মানির কাছে। কোপা আমেরিকার ফাইনালে চিলের কাছে স্বপ্নভঙ্গ। তার পরে বলা শুরু হয়ে গেল, মেসি ‘চোকার’। বড় ম্যাচে নাকি ওর গলা শুকিয়ে আসে।

যে ছেলেটা এত সব বড় ম্যাচ একার কৃতিত্বে, অবলীলায় ক্লাবকে জিতিয়েছে, তার নাকি ফাইনালে গলা শুকিয়ে আসে। সাধে কী আর নিজের দেশের সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল মেসি। ও যে ‘চোকার’ নয় ফুটবলের জাদুকর, সেটাই আবার প্রমাণ করে দিল।

আরও পড়ুন: প্রতি মাসের প্রথম বুধবার মালি দলের ড্রয়িংরুমে হাজির বলিউড

ফুটবল জীবনে আমার কোচ প্রয়াত অমল দত্ত বলতেন, বড় ফুটবলার তাকেই বলে যে আসল দিনে জ্বলে ওঠে। মাঠে নেমে সব প্রতিকূলতাকে সে তার দক্ষতা, আন্তরিকতা, সাহস এবং আবেগ দিয়ে উড়িয়ে দেবে। ইকুয়েডরের বিরুদ্ধে মেসিকে দেখে অমলদার এই কথাটা খুব মনে পড়ছিল। ঠিক যখন সবচেয়ে বেশি করে ওকে দরকার পড়েছিল, মেসি আর্জেন্তিনাকে অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে বের করে আনল। এই না হলে জিনিয়াস!

গত সত্তর বছরে বিশ্ব ফুটবলে অনেক দুনিয়া কাঁপানো তারকার উদয় হয়েছে। দে স্তেফানো, ফেরেঙ্ক পুসকাস, পেলে, গ্যারিঞ্চা, বেকেনবাউয়ার, ইয়োহান ক্রুয়েফ, মারাদোনা, রোমারিও, জিদান, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। কী সব নাম! তুলনায় যেতে চাই না। অনেক কিংবদন্তি কিন্তু বিশ্বকাপ জেতেনি। যেমন পুসকাস, দে স্তেফানো, ক্রুয়েফ বা জর্জ বেস্ট। তবু তাঁরা থেকে গিয়েছেন ‘গ্রেট’।

আমার মনে হয় বিশ্বকাপ না জিতলে তাকে বিশ্বসেরা বলা যাবে না, এই ধারণাটা একটু অতিরঞ্জিতও। বিশ্বকাপ নিশ্চয়ই সেরা অলঙ্কার কিন্তু সেটাই একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে না। মেসিদের যুগে ক্লাব ফুটবলে অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা। লা লিগা, ইপিএল বা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সেরা সব ফুটবলাররা খেলে। বিশ্বকাপে খেলা বা বিশ্বকাপজয়ী দেশের চেয়েও কোনও কোনও ক্লাব দল বেশি শক্তিশালী।

তা ছাড়া দেশের হয়ে সফল নয় মেসি, এটাও তো একটা ভুল ধারণা। এই প্রজন্মের আর্জেন্তিনা দলটা যখনই যা কিছু ভাল করেছে, তার পিছনে মেসির অবদান সবচেয়ে বেশি থেকেছে। এ বারও তো প্রবল চাপের মুখে হ্যাটট্রিক করে দেশকে তুলে দিল বিশ্বকাপে। পুরোপুরি ‘ওয়ান ম্যান শো’। তিনটে গোলই অসাধারণ, কিন্তু তৃতীয়টা জাদুকরি। চলতে চলতেও লব করে গোল করে দিতে পারে যে ফুটবলার, তার সম্পর্কে কোনও বিশেষণই বোধ হয় যথেষ্ট নয়।

মারাদোনাকে টিভিতে দেখেছি। পড়ন্ত ফর্মের পেলের বিরদ্ধে আমি একটা ম্যাচ খেলেছি। এই দু’জনেই খুব আগ্রাসী ড্রিবলার। দু’জনেই একটা ডজ করে দশ গজ এগিয়ে যায়। যেটা এখন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে কিছুটা করতে দেখি। মেসি আগ্রাসী ড্রিবলার নয়। ও হচ্ছে স্কোয়ার ড্রিবলার। ওর আউটসাইড, ইনসাইড ডজ দেখার মতো। মেসি এগিয়ে ওর বডি ব্যালান্সে। কভারিংয়ে। যা ইকুয়েডর ম্যাচেও দেখলাম। পেলে, মারাদোনা, ক্রুয়েফ সবাই বক্সে ঢুকে গোলকিপারকে একটু হলেও সময় দিত। কিন্তু মেসি যদি একবার বক্সে ঢুকে পড়ে, তা হলে গোলকিপারকে সেই সময়টাই দেবে না। মুহূর্তে বল জালে জড়িয়ে দেবে।

পুসকাসের পাশে, জিবর, হিদেকুটি, কক্সিস-রা ছিল। পেলের পাশে ছিল গ্যারিঞ্চা, জাগালো, স্যান্টোস ভাইরা। পরের দিকে রিভেলিনো, টোস্টাও। মারাদোনাও পাশে পেয়েছে অস্কার রুগেরি, আর্দিলেস, বুরুচাগা, ভালদানো-দের। সেখানে মেসির পাশে আছে অ্যাঙ্খেল দি’ মারিয়া, এনজো পেরেজ, লুকাস বিগিলা, দারিও বেনেদিত্তো। বিশ্ব ফুটবলে এরা কেউ খুব ভাল কোনও ক্লাবে নেই। গত এগারো মাসে মেসি ছাড়া আর্জেন্তিনার হয়ে আর কেউ গোল করেনি। এর পরেও কি বলা হবে, ও দেশের হয়ে খেলতে পারে না? সর্বকালের সেরা কে, সেই তর্ক চলতে থাকবে। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে, অতি সাধারণ একটা দল নিয়েই কীভাবে লড়ে গিয়েছিল লিওনেল মেসি!

গত বিশ্বকাপে ফাইনালে হার বা কোপা আমেরিকা ফাইনালে উঠেও জিততে না পারা দিয়ে তাই মেসির বিচার হওয়া উচিত নয়। মেসিকে মাপতে হলে ওর ক্লাব ফুটবলের সাফল্যের সঙ্গে এই সব দিনগুলোর দিকে তাকাতে হবে। যখন একার কৃতিত্বে ও আর্জেন্তিনার ফুটবল ইতিহাসকে ও রক্ষা করে চলেছে।

Lionel Messi Argentina Football Ecuador World Cup Qualifier Russia 2018 লিওনেল মেসি
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy