আরও পড়ুন: ‘রায়ডু দুশ্চিন্তা কাটালেও হতে হবে ধারাবাহিক’
শামির নিজেরও মনে হয়েছিল, মাথায় যেন পৃথিবী ভেঙে পড়ল। মনে হতে থাকে অন্ধকার সুড়ঙ্গে আলোর রেখা বন্ধ হয়ে গিয়েছে তাঁর জন্য। তখনই হঠাৎ ঠিক করেন, আর ক্রিকেটই খেলবেন না। টিম ম্যানেজমেন্টকে তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েও দিয়েছিলেন। শাস্ত্রী তখন তাঁকে একটাই কথা বলেন, ‘‘এক জন খেলোয়াড়ের সব চেয়ে বড় বন্ধু হয় খেলাটাই। ক্রিকেট ছাড়িস না। বরং আরও জোরে তাকে জড়িয়ে ধর। দেখবি, ক্রিকেটও ভালবাসছে।’’
বোলিং কোচ অরুণ বারো-তেরো বছরের বেশি সময় ধরে শামিকে দেখছেন। এক সময়ে তিনি বাংলারও কোচিং করে গিয়েছেন। জাতীয় অ্যাকাডেমিতে দীর্ঘ সময় যুক্ত থাকার দরুণ শামির মতো অনেকের উত্থানের সাক্ষী। অরুণের কোচিংয়ে যেমন টেকনিক্যাল দিক থাকে, তেমনই ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে-বলে তাঁদের মনন ঠিক করার উপরে জোর দেন তিনি। উৎসাহ দিয়ে তিনি শামিকে বলেন, ‘‘এত প্রতিভা আর স্কিল নিয়ে যদি তুমি এখনই এ রকম চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলো, তা হলে খুবই অন্যায় হবে। তার চেয়ে ফিটনেস বাড়িয়ে ফিরে এসো। রাগ হলে হতে দাও। তার পরে সেই রাগটাকে উগরে দাও বিশ্বের সব দলের বিরুদ্ধে, সব ব্যাটসম্যানের বিরুদ্ধে।’’ শাস্ত্রী-অরুণ কার্যত জোর করেই শামিকে বেঙ্গালুরুর জাতীয় অ্যাকাডেমিতে থাকার নির্দেশ দেন। বলে দেন, ট্রেনিংয়ে কোনও ফাঁক না রেখে শারীরিক কসরত করে যাও। দু’মাসের মধ্যে ফল আসতে বাধ্য।
আরও পড়ুন: হার্দিক জন্মগত প্রতিভা, শাস্ত্রীর দাবি বিশ্বকাপের দল প্রায় তৈরি
কোহালি জমানায় ফিটনেস নিয়ে আপসহীন দলীয় নীতিতে অনেক ক্রিকেটারেরই ইয়ো-ইয়োর মরণফাঁসে আটকে জীবন কঠিন হয়ে গিয়েছে। অশ্বিন ওয়ান ডে-র জায়গা হারিয়েছেন, অম্বাতি রায়ডু পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে সিরিজ থেকে বাদ পড়েছেন। শামির মতো ফিটনেসে রাতারাতি এমন অভাবনীয় উন্নতি কেউ ঘটাতে পারেননি। রবিবার এই প্রজন্মের ভারতীয় দলের বিদেশের মাঠে আরও একটি শৃঙ্গ জয়ের রাতে ওয়েলিংটনে ফোন করে জানা গেল, গত বছর জুনে ইয়ো ইয়োতে ১৪.৫ তুলতে পারছিলেন না শামি। তখনই তিনি বাদ পড়েছিলেন দল থেকে। এখন সেখানে নিয়মিত ভাবে ১৮ স্কোর করছেন। মানে ‘যথেষ্ট ভাল’দের দলেও তাঁকে স্বচ্ছন্দে রাখা যায়।
কয়েক দিন আগে বিরাট কোহালিও বলেছেন, শামিকে এতটা ফিট তিনি আগে কখনও দেখেননি। এ দিন ম্যাচের পরে টিভি-তে কথা বলতে আসেন রবি শাস্ত্রী। তিনি এবং নিউজিল্যান্ডের প্রাক্তন ক্রিকেটার সাইমন ডুল একমত হন, এত ফিট এবং এত ফাস্ট শামিকে আর কখনও দেখেননি তাঁরা। নিয়মিত ভাবে ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটারের আশেপাশে গতিতে বল করছেন। শাস্ত্রী বরাবরই শামির বোলিং নিয়ে উচ্ছ্বসিত। আদর করে তাঁকে ডাকেন ‘কলকাতার নবাব’ বলে। মনে করেন, কপিল দেবের পরে এত ভাল ‘সিম পোজিশন’ আর কারও দেখা যায়নি। এই নিউজ়িল্যান্ডেই ২০১৫ বিশ্বকাপের সময়ে কপিল যাঁর সর্বাধিক টেস্ট উইকেটের রেকর্ড ভেঙেছিলেন সেই রিচার্ড হ্যাডলির কাছে শামিকে নিয়ে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমার টিমের সুইং মাস্টার।’’ শাস্ত্রীর কথায় হ্যাডলি অমূল্য সব পরামর্শ দিয়ে যান শামিকে। শুধু ফিটনেস ঠিক রাখার জন্য তাঁর ‘নবাব’কে মাঝেমধ্যে ‘ইঞ্জেকশন’ দিয়ে যেতে হয় হেড কোচকে। ঘরোয়া আড্ডায় যার নামকরণ হয়েছে ‘জাগো বাবা ইঞ্জেকশন’। জনশ্রুতি হচ্ছে, কোনও ক্রিকেটার ঝিমিয়ে পড়ছেন বা ঠিক মতো শারীরিক কসরৎ করছেন না দেখলেই শাস্ত্রী বা অরুণ এই ‘জাগো বাবা ইঞ্জেকশন’ পুশ করবেন।
ইয়ো ইয়ো চ্যালেঞ্জ যে শামিকে ‘খতরো কে খিলাড়ি’ করে তুলেছে, তা পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে। ফিটনেস পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে বাদ পড়ার থেকে তাঁর গ্রাফ শুধুই ঊর্ধ্বমুখী। ইংল্যান্ডে পাঁচ টেস্টে ১৬ উইকেট নিয়ে দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। অস্ট্রেলিয়ায় চার টেস্টে ১৬ উইকেট। দলের তৃতীয় উইকেটশিকারি। ওয়ান ডে-তে তিন ম্যাচে পাঁচ উইকেট। নিউজ়িল্যান্ডে চারটি এক দিনের ম্যাচ খেলে ৯ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেটসংগ্রাহক। আর ইঞ্জেকশনের নমুনা? নিউজ়িল্যান্ড থেকে ফিরে কয়েক দিনের বিশ্রাম নিয়েই জাতীয় অ্যাকাডেমিতে ছোটো। দলের নির্দেশ, এই ফিটনেস ধরে রাখতে হবে।
অবসরের মুখ থেকে ফেরা এক ক্রিকেটার প্রায় বাদ পড়ার মতো অবস্থা থেকে বিশ্বকাপের উড়ানে নবাবি চালেই উঠে পড়ছেন! ভারতীয় ক্রিকেটে সেরা প্রত্যাবর্তন রূপকথায় নতুন নাম মহম্মদ শামি!