বিজয়ী-মেজাজ। সোমবারের শামি। বিশাখাপত্তনমে। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
বিশাখাপত্তনমে ভারতের টেস্ট জয়ের কারণ বাছতে বললে, এমনিতে দু’টো নাম বেরিয়ে আসবে। বিরাট কোহালি এবং রবিচন্দ্রন অশ্বিন। এটা ঘটনা যে, কোহালি আর অশ্বিনের পারফরম্যান্স ছাড়া এই টেস্ট জিতত না ভারত। কিন্তু এঁরা দু’জন ছাড়াও আমি আরও একজনকে প্রাপ্তির লিস্টে রাখতে চাইব।
মহম্মদ শামি।
দেখুন, অশ্বিন-বিরাট দু’জনেই এখন অন্য একটা লেভেলে ক্রিকেটটা খেলছে। রাজকোট টেস্টটা ভাল যায়নি অশ্বিনের। কিন্তু বিশাখাপত্তনমে আবার ও পুরনো ফর্মে। কখনও ইনিংসে পাঁচটা, কখনও তিনটে— পুরনো অশ্বিন আবার ফিরে এসেছে। এখানে আরও একটা ব্যাপার দেখলাম। বিশাখাপত্তনম উইকেট থেকে যে অশ্বিন মারাত্মক কিছু টার্ন পেয়েছে, তা নয়। বরং যে ক’টা উইকেট ও এখানে পেল, তার বেশির ভাগই সোজা বলে। দুর্দান্ত ড্রিফট করাচ্ছিল অশ্বিন। বলের শাইনটাকে খুব ভাল ব্যবহার করছিল। এতেই পরিষ্কার, উইকেটে টার্ন না হলেও কোনও সমস্যা নেই। ভারতীয় অফস্পিনার ঠিক উইকেট তুলে বেরিয়ে যাবে।
বিরাটের ক্ষেত্রেও একই কথা আমি বলব। উইকেট কেমন, সেখানে বল সিম করছে না টার্ন— এ সব ভারত অধিনায়কের কাছে আর গুরুত্ব পায় না। প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরির পর দ্বিতীয় ইনিংসে অসাধারণ ৮১ রানের একটা ইনিংস খেলে গেল। দেখে মনে হচ্ছিল, বিরাট একটা ম্যাচ খেলছে। যেখানে প্রতিপক্ষ বলে কিছু নেই। আর বাকি টিমটা আর একটা ম্যাচ খেলছে। যেখানে স্টুয়ার্ট ব্রড, জিমি অ্যান্ডারসন নামের কেউ কেউ ব্যাটসম্যানদের প্রবল ঝামেলায় ফেলে দিচ্ছে। একটা উদাহরণ দিই। গত কাল স্টুয়ার্ট ব্রডের স্পেলটা মনে করুন। যেখানে অজিঙ্ক রাহানে, অশ্বিনকে ও তুলে নিল। রাহানের মতো টেকনিকসম্পন্ন ব্যাটসম্যানকেও দেখলাম, ব্রডকে খেলতে পারছে না। কিন্তু বিরাটের টেকনিকে একটা আঁচড়ও কাটতে পারল না ব্রড। রাহানে যখন গায়ে বল খাচ্ছে, বিরাটকে দেখলাম দিব্যি কভার ড্রাইভে ব্রডকে বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে!
ঘটনা হল, এরা দু’জন রোজ খেলছে, রোজ জেতাচ্ছে। এটা তাই নতুন ব্যাপার নয়। নতুন বরং লাগল, শামিকে। বিশেষ করে ক্রিজের ব্যবহার। এ জিনিসটা এর আগে শামিকে কখনও এত ভাল ভাবে করতে দেখিনি।
জো রুটের আউটটার কথাই ধরা যাক। রুটকে যে বলটায় আউট করল, ওটা বাদ দিচ্ছি। আসল হল, সেট আপ। প্রথম দু’টো বল উইকেটের কোণা থেকে এসে করল। রুট বিট হল। পরেরটা করল উইকেটের পাশে এসে। রুট ড্রাইভ মারতে গিয়েও পারল না। তার পর একটা ইয়র্কার। এবং শেষে আউটের বলটা। লেট ইনসুইং। জো রুটের মতো ব্যাটসম্যান বুঝতে পারছিল না শামি কখন কোন বলটা করবে। এত ভেতরে-বাইরে, ভেতরে-বাইরে রেখে যাচ্ছিল শামি। মাঝে মাঝেই চোট-আঘাতে ভোগে ছেলেটা। তার উপর দেশের মাঠে এ বছর বেশির ভাগ টেস্ট খেলছে বলে, উইকেট থেকে দারুণ কিছু সাহায্যও পায় না। কিন্তু এ সব উইকেটে যা দরকার হয়, তা ঠিক খেটেখুটে বার করে ফেলেছে শামি। ঘণ্টায় একশো চল্লিশ কিলোমিটার গতিতে রিভার্স সুইং। সাধারণত আমরা জানি যে, বল পুরনো হলে তবে রিভার্স হয়। কিন্তু আজ দেখলাম, বল সাত-আট ওভার পুরনো হতে না হতে শামি রিভার্স করাতে শুরু করে দিয়েছে। স্ট্রাইড কমিয়ে রান আপ এখন অনেক ভাল। প্লাস যা বললাম। ব্যাটসম্যানের মগজ নিয়ে খেলা। ক্রিজকে ব্যবহার করে ব্যাটসম্যানকে বুঝতেই না দেওয়া সে এ বার কোন বলটা খেলতে যাচ্ছে। আদিল রশিদের আউটটা আর একটা উদাহরণ। অফস্টাম্প লাইনে করতে-করতে আচমকা একটা বাউন্সার মেরে দিল। রশিদকে বাধ্য করল ব্যাট ছোঁয়াতে।
নতুন শামি ছাড়াও বেশ কয়েকটা ভাল ব্যাপার দেখলাম। জয়ন্ত যাদব একজন। অভিষেকে ছেলেটা যে ভাবে অলরাউন্ড পারফরম্যান্স দিয়ে গেল, দেখে ভাল লেগেছে। দু’ইনিংস মিলিয়ে চারটে উইকেট তুলল। প্রথমের পর দ্বিতীয় ইনিংসেও গুরুত্বপূর্ণ রান করে গেল। বিশেষ করে শামির সঙ্গে শেষ উইকেটে ৪২ রানের পার্টনারশিপটা। শুনলাম, তখন ব্যাট করতে-করতে শামিকে জয়ন্ত বলেছিল যে, তুমি মারো। যে বলে শট খেলতে চাইছো, খেলো। কিন্তু সব বলে মারতে যেও না। প্লাস, নিজে স্পিনারদের বেশি খেলছিল। রীতিমতো পরিণত মস্তিষ্কের ছাপ।
সবই টুকরো-টুকরো ব্যাপার। কিন্তু সব জুড়লে যে ছবিটা দাঁড়ায়, তা বেশ স্বস্তির। বিরাট কোহালির ভারত আসলে তরুণদের নিয়ে তৈরি একটা টিম। কিন্তু বিশাখাপত্তনম টেস্ট বুঝিয়ে গেল, আর সেটা তরুণ নেই। টিমটা এখন পরিণত হচ্ছে। কোথাও আটকে গেলে টেনশন করছে না। বরং বুদ্ধি খাটিয়ে বাধাকে হঠানোর চেষ্টা করছে।
টেস্ট জয়ের থেকে সেটাও বা কী কম বড় প্রাপ্তি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy