Advertisement
E-Paper

আলোর সমুদ্রে বিষাদের ঢেউ

কানের কাছে এখনও বেজে চলেছে ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার শব্দটা! মারাকানা থেকে কোপাকাবানা বিচ বেশ খানিকটা দূরে। তবুও সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ল স্টেডিয়ামে। মানুষ আর আলোর জাদুতে।

রতন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৬ ০৩:৫৯

কানের কাছে এখনও বেজে চলেছে ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার শব্দটা!

মারাকানা থেকে কোপাকাবানা বিচ বেশ খানিকটা দূরে। তবুও সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ল স্টেডিয়ামে। মানুষ আর আলোর জাদুতে।

ব্রাজিলের অনেকখানি জুড়েই রয়েছে ঘন বন। সেই বিশাল সবুজ সাম্রাজ্যকে আবিষ্কার আর বাড়িয়ে তোলার দৃশ্যগুলো আলোয় যখন ফুটে উঠল মাঠ জুড়ে, দর্শকদের চোখে-মনে তখন কেমন যেন মায়াবী ঘোর! সবুজ, মাঠ জুড়ে শুধুই সবুজ। মনে হচ্ছিল ঢুকে যাই মায়াবী বনে।

পর্তুগিজ সাম্রাজ্য বিস্তার, ফুটবলের দেশের বেড়ে ওঠা। নাবিকের নোঙর করা থেকে কেমন করে সাম্বার দেশের মানুষ গড়ে তুলেছেন দেশকে, ছয় হাজার ছেলে-মেয়েকে দিয়ে সেটা তুলেও ধরা হল।

দূষণমুক্ত বিশ্বের জন্য মাঠেই গাছ পোঁতা হল। আরও বড় চমক ছিল মার্চপাস্টের সময়। প্রতিটি দেশের পতাকা-বাহকদের সঙ্গে একজন করে ছোট বাচ্চা হাঁটল হাতে একটা করে গাছ নিয়ে।

সাম্বা ছিল, গার্ল ফ্রম দ্য ইপানেমার মিউজিকের সঙ্গে বিশ্বের এক নম্বর সুপারমডেল জিসেল বুন্দচেনের ক্যাটওয়াকও হল ঐতিহাসিক স্টেডিয়ামে। তিনি বিবসনা হননি ঠিকই। কিন্তু স্টেডিয়ামের সব আলো কেড়ে সোনালি রংয়ের গাউনে ছন্দ তুলে যতক্ষণ হাঁটলেন জিসেল, মনে হচ্ছিল শরীরী আবেদনের উদ‌্‌যাপনই চলছে।

তবু, এত কিছু সত্ত্বেও রিও-অলিম্পিক্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান টেক্কা দিতে পারল না, লন্ডন বা তার আগের বেজিংকে।

জনতার জোরে আর অর্থের আতিশয্যে আট বছর আগে অলিম্পিক্স উদ্বোধনে অবিশ্বাস্য একটা প্যাকেজ হাজির করেছিল চিন। আর লন্ডনে ড্যানি বয়েল-জাদুতে মুগ্ধ হয়েছিল গোটা দুনিয়া। ব্রিটিশদের গর্ববোধ তুলে ধরা হয়ছিল সেখানকার সংস্কৃতি মেনে। ব্রাজিল সেটা অনুসরণ করল ঠিকই, কিন্তু কোথায় যেন একটা না পাওয়ার বেদনা আর আগের দু’বারের সঙ্গে তুলনায় যেতে গিয়ে থমকে যেতে হচ্ছে।

দুপুর থেকে রিও শহর বন্ধ। জাতীয় ছুটি ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছিল। হাজার-হাজার সেনা, পুলিশ, বম্ব স্কোয়াড আর পুলিশ কুকুর নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল রাস্তায়। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল মারাকানা স্টেশনের একটা দিক। চূড়ান্ত অব্যবস্থা আর নিরাপত্তার কড়াকড়িতে মনে হচ্ছিল যুদ্ধক্ষেত্র। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট-সহ অনেকেই ছিলেন মাঠে। তবে জঙ্গি আক্রমণের আশঙ্কায় যা হচ্ছিল তা বাড়াবাড়ি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সংবাদমাধ্যমও রেহাই পায়নি। অন্য দর্শকদের মতোই প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে বাস থেকে নামানোর পর লাইনে দাঁড় করিয়ে তল্লাশি চলল। বহু দর্শক উদ্বোধন শুরু হওয়ার অনেক পর মাঠে ঢুকেছেন। প্রায় আশি হাজার দর্শক ছিলেন মাঠে। আর বাইরে প্রায় তিন হাজার মানুষ বিক্ষোভ দেখিয়েছেন অলিম্পিক্স বিরোধী স্লোগান দিতে দিতে। কেন এই মন্দার বাজারে আড়াই ঘণ্টার অনুষ্ঠানে এত খরচ, তা নিয়ে সরব তাঁরা। নীল আলো আর নানা রংয়ের ঝর্নাধারায় সেজে ওঠা মায়াবী মারাকানার বাইরে পোস্টার হাতে গান করতেও দেখা গেল তাণদের। গ্যালারিতে বসে থাকা মাঠের দর্শকদের মতো।

এখানকার সরকার আগেই ঘোষণা করেছিল, সংযত ভাবে অর্থ খরচ হবে। লন্ডনের আগের অলিম্পিক্সের খরচের দশ শতাংশও খরচ করা হবে না। পুরো অনুষ্ঠানে সেটা প্রমাণিত। থ্রি ডি আলোর জাদুতে যেটুকু করা যায় তা-ই হল। তাতেও হয়তো অনুষ্ঠান অসাধারণের মর্যাদা পেত যদি পেলে মশাল জ্বালাতেন। কিন্তু তিনি তো মাঠেই এলেন না। পঁচাত্তর বছরের ফুটবল সম্রাট পেশির ব্যথা আর আসুস্থতার জন্য আসতে পারবেন না জানিয়ে দিয়েছিলেন শুক্রবার দুপুরেই। নিজের ঘনিষ্ঠ এক চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে। বলে দিয়েছিলেন, ‘‘কোনও স্পনসর বা কারও চাপে সরে দাঁড়াচ্ছি না। আমার শরীর এতটাই খারাপ যে মাঠে বসে থাকা এবং মশাল প্রজ্বলন অসম্ভব ব্যাপার। একমাত্র ঈশ্বর-ই জানেন কবে সুস্থ হব।’’

ব্রাজিলের বিশ্ব-দূতের মাঠে না থাকাটা অবশ্যই বড় ধাক্কা। সেটা স্বীকার করে নিয়েছেন সংগঠকরা। কারণ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ এই অনুষ্ঠান দেখেছেন। পেলের বদলে শেষ মূহূর্তে মশাল জ্বালানোর জন্য ডাক পড়ে ২০০৪-এ ব্রাজিলের হয়ে ম্যারাথনে ব্রোঞ্জজয়ী ডি লামার। প্রয়াত মহম্মদ আলির মতো কিংবদন্তি যদি শত অসুস্থতা সত্ত্বেও জ্বালাতে পারেন মশাল, তা হলে পেলে এলেন না কেন, এই প্রশ্নে অবশ্য তোলপাড় চলছে সংবাদমাধ্যমে।

পেলে তো ছিলেনই না, উসেইন বোল্টও ছিলেন না মার্চ পাস্টে। তিনি নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন! পরে নিজেই বলেছেন, ‘‘আমার দোষ। ঘুম থেকে উঠে দেখি সবাই চলে গিয়েছে।’’ তবে বোল্ট না থাকলেও আর এক কিংবদন্তি মাইকেল ফেল্পস হাঁটলেন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা নিয়ে।

ভারতের পতাকা বয়ে নিয়ে এলেন অভিনব বিন্দ্রা। অসম্ভব উজ্জ্বল, গৌরব মাখা একটা হাসিতে উদ্ভাসিত দেখাচ্ছিল পাঁচবারের অলিম্পিয়ান আর দেশের একমাত্র ব্যক্তিগত সোনাজয়ীকে। ভারতের আগে মাঠে ঢুকেছিলেন আরও চুরানব্বই দেশের অ্যাথলিটরা। ছিলেন পারফর্মাররা। সেই ভিড়ে অভিনবর পিছনে ভারতের কারা কারা আছেন আর নেই, সবটা স্পষ্ট দেখা গেল না। দীপা কর্মকার, দীপিকা কুমারি, হিনা সিন্ধুর সঙ্গে গগন নারাঙ্গদের দেখা গেল। ভারতীয় হকি দল আসবে না জানাই ছিল। পরের দিন ম্যাচ বলে সানিয়া মির্জাও ছিলেন না। তবে ছিলেন লিয়েন্ডার পেজ। ভারতীয় কোচ জিশান আলির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাঁটলেন মারাকানায়। প্রতি চার বছর অন্তর মার্চ পাস্টে নতুন নতুন দেশের দেখা পাওয়া যায়। এখানেও পাওয়া গেল। কত নতুন দেশ হাঁটল মার্চপাস্টে। কারও সদস্য দুই, কারও তিন। কত দেশ যে ভাঙছে।

রিও-তে আগামী চোদ্দো দিনে কত নতুন তারকা উঠে আসেন, কত রেকর্ড ভাঙা-গড়া হবে এখন সেটাই দেখার।

Rio Olympics
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy