তাঁকে দীর্ঘ দিন ধরে কভার করে আসছেন, সারা দেশের এমন জনা পঞ্চাশেক সাংবাদিককে মঙ্গলবার রাতে ব্যক্তিগত ডিনারে ডেকেছিলেন সচিন তেন্ডুলকর। সেখানে তাঁদের নানা অন্তরঙ্গ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ছাড়াও তিনি নিজের বইয়ের কিছু অংশ পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে দেখালেন। বিশ্ব ক্রিকেটে তেন্ডুলকরের অজস্র রেকর্ডের সঙ্গে এটাও বোধহয় যোগ হল!
প্রশ্ন: সারা জীবন আমরা আপনাকে বিতর্ক এড়াতে ব্যস্ত দেখেছি। হঠাত্ কী ঘটল যে আপনি শুধু ফ্রন্টফুট নয়, এই বইটা লেখার সময় একেবারে স্টেপ আউট করে ফেললেন!
সচিন: যখন ক্রিকেট খেলতাম তখন ক্রিকেটেই মন রাখতে চেয়েছি। আমার এবং আমার পরিবারের এটা সিদ্ধান্ত ছিল যে, যা-ই ঘটুক না কেন, আমি কোনও প্ররোচনায় পা দেব না। ওটা আমার মনকে ক্রিকেট থেকে বিক্ষিপ্তই শুধু করবে। লম্বা লম্বা লেখা বেরোবে। লম্বা লম্বা রান আসবে না। তার মধ্যে গিয়ে লাভ কী?
কিন্তু এখন যখন আমি প্রাক্তনদের দলে, যখন ক্রিকেট ব্যাট আমার থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, তখন অবিতর্কিত থাকার কোনও দায় নেই আমার। আমি যা সত্যি বলে মনে করি তাই অসঙ্কোচে বলতে পারি।
প্র: এত দিন মারার বলেও ডেড ডিফেন্স করে হঠাত্ স্টেপ আউট করতে অসুবিধে হচ্ছে না?
সচিন: না। মুখ বন্ধ থাকাটা বরঞ্চ অনেক কঠিন ছিল!
প্র: গ্রেগ চ্যাপেল বলেছেন, আপনার অভিযোগ অসত্য। মোটেও উনি ভারত অধিনায়ক হওয়ার প্রস্তাব আপনাকে দেননি।
সচিন: আমি যা সত্যি, তাই লিখেছি। উনি যা বলার বলেছেন। এটুকু বলতে পারি, উনি যখন অফারটা আমাকে দেন পাশে অঞ্জলি ছিল। আমার মতো ও-ও অবাক হয়ে যায়।
প্র: গ্রেগ আপনার সঙ্গে কেন খারাপ ব্যবহার করতেন?
সচিন: নো আইডিয়া। আমি যদি ওঁর মনটা পড়তে পারতাম তো ভাল হত। কিন্তু আমি কোনও দিনই ওঁকে বুঝিনি। ইন ফ্যাক্ট, গ্রেগ দায়িত্ব নেওয়ার পরপর দুটো ট্যুরে আমি টিমেও ছিলাম না। জিম্বাবোয়ে আর শ্রীলঙ্কা। যখন টিমে ফেরত আসি, বাসে করে আমরা মোহালি থেকে দিল্লি আসছিলাম। বোধহয় চ্যালেঞ্জার্স খেলে। বাসে অনেকে ছিল। যুবরাজ, জাহির, ভাজ্জি। ওরা বলতে শুরু করে গ্রেগ এই করছে, ওই করছে। আমি তখন ওদের বুঝিয়েছিলাম, একজন এত বড় ক্রিকেটার, তা-ও বিদেশি, তিনি আমাদের এখানে এসেছেন। তাঁকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য আর একটু সময় আমাদের দেওয়া উচিত। এত তাড়াতাড়ি ওপিনিয়ন ফর্ম করাটা ঠিক হবে না। পরে অবশ্য বুঝলাম প্লেয়াররা সে দিন ঠিকই বলেছিল!
প্র: বিশ্বকাপের আগে চার নম্বরে খেলা নিয়েও তো আপনার সঙ্গে গ্রেগ-রাহুলের মতবিরোধ হয়েছিল?
সচিন: হ্যাঁ, বিশ্বকাপের দু’মাস আগে হঠাত্ করে আমাকে বলা হয় চারে খেলতে। যেখানে বলতে গেলে আজীবন আমি প্রায় ওপেন করে এসেছি। আর টিমের অনেক বেশি কাজে এসেছি। আমি এই লজিকটা আজও বুঝিনি। সব ক’টা টিম যেখানে বিশ্বকাপের দশ মাস আগে থাকতে তৈরি হচ্ছিল, সেখানে আমরা হঠাত্ কেন দু’মাস আগে পরীক্ষা শুরু করলাম, আমার মাথায় ঢোকেনি। আমাদের ড্রেসিংরুমের অবস্থাও তখন অসহনীয় ছিল।
প্র: গ্রেগের দাদাও তো আপনাকে ২০০৭ বিশ্বকাপের পর খেলা ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘এন্ডুলকর। এখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করো, আমি কি এখনও খেলা চালিয়ে যাওয়ার উপযুক্ত?’
সচিন: ইয়ান চ্যাপেলকে আমি ধরেছিলাম ২০১১-এ ডারবানে। মনে হয়েছিল সব কিছু ছেড়ে দেওয়া যায় না। ডারবানে হেল্থ ক্লাব থেকে বেরোচ্ছি। উনি ঢুকছেন। সে বার আমি আইসিসির ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার। দু’বছর ধরে প্রচুর রান করে যাচ্ছি। ইয়ান আমাকে জিম থেকে বেরোতে দেখেই বললেন, এ বার বুঝছি এটাই তা হলে সাফল্যের উত্স। নিজেকে তুমি বদলেছ। আমি বললাম, এতটুকু বদলাইনি। যা ছিল তা-ই আছে খেলা। বদলান আপনার মতো লোকেরা। আজ এ দিকে তো কাল ও দিকে। আয়নার সামনে আপনার দাঁড়ানো উচিত আর নিজেকে জিজ্ঞেস করা উচিত, আমি কি ঘন ঘন রং বদলাই?
প্র: আপনার অধিনায়কত্বের সময় ভারতীয় ক্রিকেটে অনেক রহস্যজনক ঘটনা ঘটেছে। সেগুলো সম্পর্কে কী লিখেছেন?
সচিন: আমি এই বইয়ে এমন কিছু লিখিনি যা সম্পর্কে আমি একশো ভাগ নিশ্চিত নই। যেগুলো মনে করা হচ্ছে অথচ প্রমাণ নেই, সেগুলো আপনি কী করে লিখবেন? সেটা তো লুজ কথা হয়ে যাবে। আর আমি লুজ কিছু লিখতে চাইনি। আমি সেগুলোই বইয়ে লিখেছি যার প্রমাণ আছে। যে দাবিটা প্রমাণ করতে পারব না, সেগুলো লিখিনি। আপনি হয়তো কিছু জানেন। কিন্তু জানাটা তো যথেষ্ট নয়। লোকে বলবে প্রমাণ কোথায়? আমি আর আমার সহ-লেখক বোরিয়া এই ব্যাপারে শুরু থেকে খুব পরিষ্কার ছিলাম।
প্র: কোচ আচরেকর তো বইয়ের অনেকটা জায়গা জুড়ে নিশ্চয়ই আছেন?
সচিন: নিশ্চয়ই। মনে আছে, আমার বয়স তখন এগারো কী বারো। স্কুলের হয়ে খেলি। অথচ কাগজে কিছুতেই নাম বেরোয় না। কারণ কাগজের জন্য ৩০ রান দরকার। আমি সেটা করতে পারছি না। এক দিন ২৪ করার পরে স্কোরার বলল, ঠিক আছে এক্সট্রা থেকে ছ’রান তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি। এক্সট্রাটা কমিয়ে দেব। তা হলে কাগজে নাম বেরোবে। তা-ই হল। স্যরের কী সন্দেহ হল, পরের দিন আমাকে ডাকলেন, তুমি কত করেছ কাল? বললাম, ২৪। তা হলে কাগজে ৩০ কোথা থেকে এল? যখন শুনলেন, শুনে কী ধমক। সেই প্রথম কাগজে নিজের অন্যায় ভাবে নাম তোলা নিয়ে প্রচণ্ড বকলেন। বললেন, ২৪ করে জীবনে কিছু হবে না। এত বড় বড় রান করো যে, কাগজ তোমাকে নিয়ে লিখতে বাধ্য হয়। আমাকে স্যর অন্যদের খেলা দেখতেও যেতে দিতেন না। বলতেন, তুমি ম্যাচ খেলে যাবে অনবরত। তুমি অন্যদের খেলা দেখবে না। আমি চাই অন্যরা ভিড় করে এসে তোমার খেলা দেখবে। আর ও দিকে ছিল অজিত। রেস্টুরেন্টে ডাক খেতে দিত না। পাছে মাঠে ডাক করি। জীবনের শেষ ইনিংসে আউট হওয়ার পরেও আমাকে বকছে, ওমুকটা ঠিক কর। ও বোধহয় ভুলে গিয়েছিল, আমি আর সেকেন্ড ইনিংস খেলব না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy