Advertisement
১১ মে ২০২৪

রাজ্য টিটির দুর্নীতি নিয়ে সরব পৌলমীরা

টাকা দিলে রাজ্য টেবল টেনিস টিমের হয়ে জাতীয় প্রতিযোগিতায় খেলার সুযোগ পাওয়া যায়, আনন্দবাজারে বুধবার প্রকাশিত এই খবরে তোলপাড় বাংলার টিটি মহল।

রতন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৫৮
Share: Save:

টাকা দিলে রাজ্য টেবল টেনিস টিমের হয়ে জাতীয় প্রতিযোগিতায় খেলার সুযোগ পাওয়া যায়, আনন্দবাজারে বুধবার প্রকাশিত এই খবরে তোলপাড় বাংলার টিটি মহল।

নেতাজি ইন্ডোরে বেঙ্গল অলিম্পিক্স অ্যাসোসিয়েশন থেকে ময়দানের বিভিন্ন ক্লাব তাঁবুতে বুধবার সারা দিন আলোচনার বিষয় এবং তর্কাতর্কি ছিল রাজ্য টিটি সংস্থার এই নজিরবিহীন নিয়ম নিয়ে। রাজ্যের প্রায় সব নামী টিটি খেলোয়াড় তাঁদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এই খবর শেয়ার করেছেন। অনেকে সঙ্গে করেছেন নানা তির্যক মন্তব্যও। যা থেকে স্পষ্ট, রাজ্য সংস্থার ‘খেলোয়াড় নির্বাচন কেলেঙ্কারি’-র এই খবর শেষ পর্যন্ত প্রকাশ্যে এসে পড়ায় কতটা খুশি তাঁরা।

সাত বারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন পৌলমী ঘটক থেকে অলিম্পিয়ান মৌমা দাস, ভারতীয় দলের প্রাক্তন কোচ জয়ন্ত পুশিলাল থেকে প্রাক্তন তারকা খেলোয়াড় নূপুর সাঁতরা—সবাই টাকা নিয়ে বাংলা দলে সুযোগ করে দেওয়ার নিয়মের বিরুদ্ধে সরব।

ইন্দু পুরীর রেকর্ড ছুঁতে চাওয়া অলিম্পিয়ান পৌলমী এ দিন যেমন বলে দিলেন, ‘‘যোগ্যতার ভিত্তিতে বাংলা দল নির্বাচন হোক এটাই চাইব। আর খেলোয়াড় বা তার বাবা-মা কেন ছেলে-মেয়েরা সুযোগ পাওয়ার পর টাকা দেবেন রাজ্য সংস্থাকে? ব্যাপারটা কেমন যেন লাগছে!’’ পাতিয়ালার জাতীয় শিবিরে রয়েছেন টেবল টেনিসে বাংলার আর এক মুখ মৌমা দাস। তাঁর এক বন্ধুর হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো প্রকাশিত খবর দেখার পর পাঁচ বারের জাতীয় চ্যাম্পিয়নের ফোনে মন্তব্য, ‘‘৯৯-এর পর আমি বাংলার হয়ে খেলিনি। তবে এটুকু বলতে পারি, যে কোনও টুর্নামেন্ট সংগঠনের জন্য টাকা দেবেন স্পনসররা। খেলোয়াড়দের বাবা-মায়েরা কেন টাকা দেবেন? প্লেয়াররা নিজেদের যোগ্যতায় খেলবে। তাদের পারফরম্যান্সই সব কিছু।’’

বিতর্ক থেকে দূরে থাকতে অভ্যস্ত দেশের অন্যতম সেরা টিটি কোচ পুশিলালও সরব ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর। বললেন, ‘‘এ রকম ঘটনার কথা মাঝেমধ্যে শুনতে পাই। অনেকে নাকি সুযোগ পেতে টাকা দেয়। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।’’ পৌলমী-জয়ন্তরা সামান্য রাখঢাক করলেও নূপুর চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ করছেন রাজ্য সংস্থার কর্তাদের। ‘‘অনেক দিন ধরে এ ভাবে টাকা নিয়ে বাংলা টিমে খেলোয়াড় ঢোকানো চলছে। বাচ্চা বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের বাবা-মাকে বলে দেওয়া হচ্ছে এই টাকা দিতে হবে সুযোগ পেতে হলে। সবাই এটা জানে। কিন্তু শাস্তির ভয়ে কেউ এত দিন মুখ খোলেনি। এত দিন পরে এটা প্রকাশিত হওয়ায় ওদের মুখোশ খুলে গিয়েছে। বাংলার টিটির স্বার্থে এখনই তিনটে অ্যাসোসিয়েশনকে এক করা দরকার।’’

বুধবারের প্রকাশিত খবরে লেখা হয়েছিল, বাংলা টিটি দলের এক থেকে আট নম্বর পর্যন্ত খেলোয়াড় র‌্যাঙ্কিং অনুযায়ী বাছাই হন। তারা এ জন্য কোনও টাকা দেন না। এর পর নয় থেকে বারো নম্বর পর্যন্ত যে চার জন খেলোয়াড়কে জাতীয় প্রতিযোগিতায় পাঠানো হয় তাদের থেকেই নেওয়া হয় হাজার হাজার টাকা। রাজ্য টিটি সংস্থার প্রেসিডেন্ট প্রাক্তন লোকসভা স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় এ দিন এর প্রতিবাদে আনন্দবাজারে পাঠানো চিঠিতে লিখেছেন, ‘‘আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ছয় সদস্যের নির্বাচক কমিটির অনুমোদন নিয়ে সবাইকে বাছা হয়।’’

সোমনাথবাবু এ কথা লিখলেও নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান রথীন বসু আবার তা মানতে চাননি। অসুস্থ এবং গত চার মাস হাসপাতালে থাকা সোমনাথবাবুর জায়গায় আপাতত সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংস্থার সভা পরিচালনা করেন রথীনবাবুই। এ দিন বাংলার জাতীয় জুনিয়র টিটির দল নির্বাচনের সভা ছিল রাজ্য সংস্থায়। সেই সভার পর রথীনবাবু বললেন, ‘‘পয়েন্ট এবং র‌্যাঙ্কিংয়ের নিয়ম মেনে আমরা প্রথম আট জনকে বাছাই করি। আজও তো আট জন করে সব বিভাগের খেলোয়াড় বাছলাম। এর বাইরে যারা যায় বা যারা যাবে তাদের আমরা বাছি না।’’ কিন্তু যারা টাকা দিয়ে দলে ঢোকে বলে অভিযোগ উঠেছে সেই নয় থেকে বারো নম্বর খেলোয়াড়দের বাছা হয় কী ভাবে? ‘‘সেটার কোনও নিয়ম নেই। কেউ যেতে চেয়ে আবেদন করলে আমরা সর্বভারতীয় ফেডারেশনের কাছে অনুমতি চাই। ওরা অনুমতি দিলে পাঠানো হয়। গত বারই তো সিনিয়র জাতীয় টিটিতে হুগলির একটা ছেলেকে পাঠানো হল যার র‌্যাঙ্কিং অনেক কম ছিল। আপনাদের কাগজে তাঁর নাম (তমোজিৎ নাথ) দেখলাম।’’ উল্লেখ্য, এই তমোজিৎকে এ জন্য কুড়ি হাজার টাকা দিতে হয়েছিল ডোনেশন হিসেবে বলে অভিযোগ উঠেছে।

রথীনবাবুর কথাতেই পরিষ্কার, যাবতীয় গণ্ডগোলের মূলে প্রতি বিভাগের বারো জনের মধ্যে শেষ চার জন। যাঁদের নির্বাচনের কোনও মাপকাঠি নেই। এঁরাই টাকা দেন বাংলা দলে সুযোগ পাওয়ার জন্য। তাঁরা যে বাংলা দলে সুযোগ পাওয়ার বদলে টাকা দেন সেটা মেনে নিচ্ছেন সোমনাথবাবুর কমিটির কোষাধ্যক্ষ শর্মি সেনগুপ্তও। প্রথমে ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চাইলেও পরে প্রাক্তন খেলোয়াড় শর্মি বললেন, ‘‘যত দূর মনে পড়ছে গত বার ক্যাডেট এবং সাব জুনিয়রে পরে যারা সুযোগ পেয়েছিল চারটে ইভেন্টের সেই ষোলো জন, সবাই ছয় হাজার বা তার বেশি টাকা দিয়েছিল ডোনেশন হিসেবে। এক লাখের বেশি কিছু টাকা উঠেছিল। এ বার শিলিগুড়িতে যারা পরে সিলেকশন পেয়েছে তাদেরও পাঁচ হাজার টাকা করে ডোনেশন দিতে বলা হয়েছে। কাল-পরশুর মধ্যে ওরা সবাই তা দিয়ে দেবে।’’

শর্মির সংস্থার সচিব দেবীপ্রসাদ বসু আবার মনেই করতে পারছেন না এক বছর আগে কী হয়েছিল টিম পাঠানোর সময়! সংস্থার প্রেসিডেন্ট সোমনাথবাবুর জামাইকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, র‌্যাঙ্কিং অনেক নীচে থাকা সত্ত্বেও কেন টাকা নিয়ে সৌরভ বসু, তমোজিৎ নাথদের সিনিয়র দলে সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল? দেবীবাবু বললেন, ‘‘এক বছর আগের ব্যাপার। ঠিক মনে নেই। কাগজপত্র দেখতে হবে। ক্যাডেট বা সাব জুনিয়র থেকে কত টাকা উঠেছিল তা-ও মনে করতে পারছি না।’’ যা থেকে স্পষ্ট, দল নির্বাচনের কেলেঙ্কারি থেকে বাঁচতে দেবীবাবুর ঢাল ‘ভুলে যাওয়া’।

আবেগদীপ্ত কন্ঠে রাজ্য টিটি সংস্থার প্রেসিডেন্ট সাতাশি বছরের সোমনাথবাবু এ দিন বলেন, ‘‘কখনও কোনও দুর্নীতি বা অন্যায়ের সঙ্গে আপস করিনি। প্রশ্রয় দিইনি।’’ সোমনাথবাবুর সততা নিয়ে কারও কোনও প্রশ্ন নেই। কেউ তুলছেনও না। কিন্তু তিনি যে এখন দীর্ঘ অসুস্থতার জন্য রাজ্য সংস্থার সব ব্যাপারে খোঁজ রাখতে পারেন না, এটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে নানা দুর্নীতির ঘটনায়। নাম কা ওয়াস্তে তাঁকে প্রেসিডেন্ট রেখে অন্যরা ‘অন্যায়’ করে যাচ্ছেন। যা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট!

সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিবাদপত্র

....বুধবার আপনার বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের আঠারোর পাতায় প্রকাশিত, ওয়েস্ট বেঙ্গল টেবল টেনিস অ্যাসোসিয়েশন টাকা নিয়ে টুর্নামেন্টের জন্য খেলোয়াড় নির্বাচন করছে —এই প্রতিবেদন পড়ে আমি মর্মাহত।

আমি স্পষ্ট ভাবে বলতে চাই, এই প্রতিবেদন পুরোটাই সাজানো। যার পিছনে আছে কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি। যারা আপনার পত্রিকাকে ব্যবহার করে শুধু অপপ্রচারই করছে না, জনগণকে ওয়েস্ট বেঙ্গল টেবল টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের সততা এবং নিষ্ঠা সম্পর্কে সন্দিহান করে তুলছে। যে সংস্থার প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকতে পেরে আমি গর্বিত।

ডব্লিউবিটিটিএ-র হয়ে যে সব খেলোয়াড় বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলতে যান, তাঁদের বেছে নেওয়ার দায়িত্ব সংস্থারই নির্বাচন সাব-কমিটির। ওই কমিটি কোনও অভিভাবকের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্লেয়ার নির্বাচন করেছে বলে যে অভিযোগ প্রতিবেদনে তোলা হয়েছে, তেমনটা কখনই হয়নি। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনের পুরোটাই উদ্দেশ্যমূলক। কারণ এ রকম কোনও কিছুই হয়নি। এটা অবিশ্বাস্য যে, নির্বাচন কমিটির ছয় সদস্যই কোনও অভিভাবকের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে টুর্নামেন্টের জন্য খেলোয়াড় নির্বাচন করছেন। ডব্লিউবিটিটিএ-র দলে কোনও খেলোয়াড় টাকা দিয়ে ঢুকছে— এই অভিযোগ আমি স্পষ্ট ভাবেই অস্বীকার করছি। কখনও কখনও কোনও অভিভাবক ডব্লিউবিটিটিএ-র তহবিলে অনুদান দিয়ে থাকেন। কিন্তু সেটা কখনওই টিমে ঢোকার যোগ্যতামান নয়। কারণ প্রতিটি আর্থিক অনুদানই আমরা চেকে নিই। আর তার জন্য রসিদও দেওয়া হয় সংস্থার তরফে।

ডব্লিউবিটিটিএ-র প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি অত্যন্ত সম্মানিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত গত এক বছর ধরে আমার শরীর খারাপ থাকায় বাড়ি কিংবা হাসপাতালেই থাকতে হয়েছে বেশির ভাগ সময়। ফলে ডব্লিউবিটিটিএ-তে এখন কী হচ্ছে, সে ব্যাপারে আমি অবহিত নই। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে, সংস্থার সব দায়ভার আমার। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনও অযোগ্য খেলোয়াড়কে অর্থের বিনিময়ে ডব্লিউবিটিটিএ নির্বাচন করেছে— এটা আমি দৃঢ় ভাবে অস্বীকার করছি।

আমাদের সংস্থার পদাধিকারী কর্তাদের উপরে আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে যে, টেলিফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। কিন্তু আমি স্পষ্ট ভাবে জানাতে চাই যে, আমাকে কোনও ফোন করা হয়নি। আমার মোবাইল ফোন আমার সঙ্গেই থাকে। প্রতিবেদক অভিযোগ করেছেন, তিনি আমাকে ফোন করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত এটি সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়।

নানা অসুবিধা, রসদের অভাবের মধ্যেও ডব্লিউবিটিটিএ-র কাজকর্ম দেখভাল করা হয়। কখনও কখনও খেলোয়াড়দের অভিভাবক বা জেলার কোনও শুভাকাঙ্ক্ষী সংস্থার তহবিলে অর্থ দিয়ে সাহায্য করে থাকেন। কিন্তু এটা ফের বলতে হচ্ছে, টাকা দিয়ে কেউ রাজ্য দলে খেলেননি বা খেলবেও না। ফের বলছি, এই অভিযোগ পুরোটাই সাজানো।

আশা রাখি, এই চিঠির বক্তব্য পুরোটাই আপনার বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রে প্রকাশ করবেন। যাতে জনগণের মন থেকে ভুল ধারণা দূর হয়ে সকলের কাছে সত্য প্রকাশিত হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

State Table Tennis Corruption Poulomi Ghatak
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE