Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
badminton

Pullela Gopichand: তাঁর জ্বালানো সলতে আজ মশাল, ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের সাফল্যের পিছনে নিরলস সাধক গোপীচন্দই

গোপীচন্দ চেয়েছিলেন, সচিন-দ্রাবিড় ভুলে ভারতীয় জনতা সাইনা-সিন্ধুর নামে জয়ধ্বনি দিক। তাঁর সেই স্বপ্ন অবশেষে সফল হয়েছে। এখন মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছেন কিদম্বি শ্রীকান্ত, লক্ষ্য সেন, এইচএস প্রণয়রা। রবিবারের পর থেকে হয়তো গৃহস্থ বাড়ির রান্নাঘরে আরও বাড়বে ব্যাডমিন্টন নিয়ে আলোচনা।

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ

অভীক রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০২২ ১৯:৫৯
Share: Save:

সলতেটা জ্বলা শুরু করেছিল ১৮ বছর আগে। দীর্ঘ ঝড়-ঝাপ্টা, বাধা-বিপত্তি, উত্থান-পতন পেরিয়ে সেই সলতে আজ পরিণত হয়েছে মশালে। সেই সলতেটা যিনি পাকানো শুরু করেছিলেন, রবিবারের এই ঐতিহাসিক দিনে তিনি যেন আশ্চর্য রকমের শান্ত। হয়ত ভিতরে ভিতরে ফুটছেন। কিন্তু বাইরে কিছুতেই তা প্রকাশ হতে দিচ্ছেন না। শুধু বলে দিয়েছেন, রবিবার ভারতীয় ব্যাডমিন্টন দল যে কৃতিত্ব অর্জন করে দেখাল, তা ১৯৮৩ সালে কপিল দেবের নেতৃত্বাধীন দলের বিশ্বকাপ জয়ের থেকেও বড়। সমালোচনা ধেয়ে আসতে সময় নেয়নি। কিন্তু তিনি অটল। ঠিক যেমন ছিলেন ১৮ বছর আগে। এক কঠোর প্রশিক্ষক, যিনি প্রতিভা অন্বেষণে ব্রতী। একটাই স্বপ্ন দেখেছিলেন, ভারতের প্রতিটি ঘরে ঘরে ব্যাডমিন্টন পৌঁছে যাক। সেই কাজে ইতিমধ্যেই সফল। রবিবারের পর থেকে গৃহস্থ বাড়ির রান্নাঘরে ব্যাডমিন্টন নিয়ে আলোচনা আরও বাড়বে।

২০০১ সালে গোটা ভারতবর্ষকে মার্চের এক দুপুরে আন্দোলিত করে দিয়েছিলেন। সুদূর ইংল্যান্ড থেকে খবর ভেসে এসেছিল, অল ইংল্যান্ড ব্যাডমিন্টন জিতেছেন হায়দরাবাদের পুল্লেলা গোপীচন্দ নামে একটি ছেলে। বছর আঠাশের সেই ছেলেটিকে তখনও গোটা দেশ ভাল করে চেনেই না। সঙ্গে সঙ্গে খোঁজ খোঁজ রব পড়ে গেল। তখনকার সময়ে হাতের সামনে নেটমাধ্যম ছিল না। দরকার পেলেই ফোনে কারওর নাম টাইপ করে সার্চ করে নেওয়ার সুযোগ ছিল না। ফলে পর দিন সংবাদপত্রে গোপীচন্দের সম্পর্কে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন হায়দরাবাদের পুত্র। এর আগে সৈয়দ মোদী, প্রকাশ পাড়ুকোন, নান্দু নাটেকর, বিমল কুমাররাও ছিলেন। কিন্তু গোপীচন্দ অল্প সময়েই ভারতীয় ক্রীড়াপ্রেমীদের মনে আলাদা জায়গা করে নিলেন।

তবে অল্প কিছু দিন যেতেই গোপীচন্দ বুঝতে পেরেছিলেন, কেরিয়ারের সায়াহ্নে এসে পড়েছেন তিনি। যা বয়স হয়েছে, তাতে বেশি দিন এই ছন্দ টিকিয়ে রাখা যাবে না। মনে একটা আকাদেমি তৈরি করার বাসনা অনেক দিন ধরেই ছিল। অল ইংল্যান্ড জেতার তিন বছরের মধ্যে তৈরি করে ফেললেন নিজের অ্যাকাডেমি। কাউকে পাশে পাননি, একমাত্র মা-কে ছাড়া। তাঁর খেলোয়াড় হয়ে ওঠার পিছনে মায়ের যতটা অবদান ছিল, কোচ হওয়ার পিছনে বোধ হয় তার থেকে বেশি অবদান রয়েছে। সম্প্রতি এ শহরে একটি অনুষ্ঠানে এসেও তিনি সে কথা স্বীকার করেছেন। অ্যাকাডেমি তৈরি করার পরেও কিছু দিন খেলা চালিয়ে যান গোপীচন্দ। ২০০৮ সাল থেকে পাকাপাকি কোচিংয়ে নেমে পড়েন। শুরু হয় সলতে পাকানো, অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্ম তুলে আনার কাজ।

সিন্ধুর অলিম্পিক্স পদকের পিছনে রয়েছে গোপীচন্দের নিরলস সাধনা।

সিন্ধুর অলিম্পিক্স পদকের পিছনে রয়েছে গোপীচন্দের নিরলস সাধনা।

কাজটা নিঃসন্দেহে কঠিন ছিল। ব্যাডমিন্টন নিয়ে এ দেশে কোনও দিনই উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তা তৈরি হয়নি। আগেকার দিনে ফুটবল এবং হকি, পরের দিকে ক্রিকেটেরই একচেটিয়া আধিপত্য। গোপীচন্দ বুঝতে পেরেছিলেন কাজটা কঠিন। তত দিনে আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টনে তাঁর বিপুল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা হয়ে গিয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার জোরে গোপীর বুঝতে অসুবিধে হয়নি ভারতীয় ব্যাডমিন্টনকে ‘আধুনিক’ করতে গেলে কী কী দরকার। সবার আগে দরকার নিজেকে পাল্টানো। খেলোয়াড় হওয়ার সুবাদে অনুশাসন ছোটবেলা থেকেই তাঁর ছিল। সেই অনুশাসন আরও বাড়িয়ে তোলেন কোচ হিসেবে। গোপীচন্দের দিন শুরু হয় ভোর সাড়ে তিনটেয়। আকাদেমিতে চলে আসেন চারটে-সাড়ে চারটের দিকে। বেলা পর্যন্ত চলে অনুশীলন। মাঝের সময় কিছুটা বিরতি। আবার দুপুর থেকে সন্ধে পর্যন্ত অনুশীলন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এই নিয়মের অন্যথা হয়নি। খেলোয়াড়দের এক সময় বিরক্তি লাগত। কিন্তু তাঁরাও বুঝতে পেরেছিলেন, এই বিনিয়োগ ভবিষ্যতে ফসল ফলাবে। তাই হয়েছে।

বিভিন্ন শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ক্রিকেট-ফুটবল আকাদেমিগুলির মতো নয়, একটা আস্ত আকাদেমি গড়ে তুলতে যা যা প্রয়োজন, তার সবই ধাপে ধাপে নিজের আকাদেমিতে নিয়ে আসেন গোপীচন্দ। এখন ১৭টি ব্যাডমিন্টন কোর্ট, ১০০টি থাকার ঘর, জিমন্যাসিয়াম, সুইমিং পুল, আইস বাথ-স্টিম বাথ নেওয়ার ঘর, দৌড়নোর ট্র্যাক, যোগ-এয়ারোবিক্স স্টুডিয়ো সবই রয়েছে। এর সঙ্গে গোপীর সংসারে রয়েছেন তিন জন সিনিয়র কোচ, তিন জন কোচ, দু’জন সহকারী কোচ, এক জন ফিটনেস ট্রেনার, সাইয়ের এক জন কোচ, পাঁচ জন ফিজিয়োথেরাপিস্ট, তিন জন ফিটনেস ট্রেনার, এক জন ম্যাসিয়োর। শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক কালে খেলোয়াড়দের টেকনিকে উন্নতি করতে বিদেশ থেকে নামকরা প্রশিক্ষকদের নিয়ে আসেন। সম্প্রতি গোপীচন্দের আকাদেমিতে কাজ করে গিয়েছেন মুল্যো হান্দোয়ো এবং কিম জি হিউনের মতো কোচ।

সাইনাকে দেশ চেনে গোপীচন্দের কারণেই।

সাইনাকে দেশ চেনে গোপীচন্দের কারণেই।

এর পরেও গোপীচন্দ বুঝতে পারেন, শুধু বিশ্বমানের আকাদেমি তৈরি করলেই হবে না, আসল হল ব্যাডমিন্টনের জনপ্রিয়তা বাড়ানো। কী ভাবে তা সম্ভব হবে, সেটিও ভেবে ফেলেন তিনি। মাথায় ঢুকিয়ে নেন, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে না পারলে খেলার জনপ্রিয়তা বাড়বে না। ২০০৪ সাল থেকে প্রতি বছর হায়দরাবাদে একটি করে আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা হয়েছে। ২০০৯ সালে ব্যাডমিন্টনের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ হয়েছে। পুরোটাই হয়েছে গোপীর উদ্যোগে। পাশে পেয়েছেন অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্য সচিব এলভি সুভ্রমণিয়মকে।

২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিক্সে সাইনা দেশকে ব্রোঞ্জ এনে দেন। কিন্তু সে বার ভারত অন্য খেলাতেও এতগুলি অলিম্পিক্স পদক পায়, সাইনার ব্রোঞ্জ কিছুটা হলেও চাপা পড়ে যায়। তবে গোপীকে ভাবতে হয়নি। কারণ তত দিনে তাঁর অ্যাকাডেমি জন্ম দিয়ে ফেলেছে আর এক জনের— পুসারলা ভেঙ্কট সিন্ধু।

সিন্ধু, সাইনা ছাড়াও গোপীর আকাদেমি থেকে ভারত পেয়েছে কিদম্বি শ্রীকান্ত, পারুপাল্লি কাশ্যপ, এইচএস প্রণয়, সাই প্রণীত, সমীর বর্মাদের। এ যেন বার্সেলোনার ফুটবলার তৈরির কারখানা লা মাসিয়া। ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের এই লা মাসিয়ায় ঘুরে গিয়েছেন ক্যারোলিনা মারিন, তৌফিক হিয়াদাত, লি চং ই, লিন ডান, পিটার গেড, ওয়াং জিন, সিক্সিয়ান ওয়াং, রতচানক ইনতাননের মতো বিশ্বমানের খেলোয়াড়। ভারতীয় ব্যাডমিন্টন যত সাফল্য পাচ্ছে, যত তার জনপ্রিয়তা বাড়ছে, তত আগ্রহ বাড়ছে গোপী আর তাঁর লা মাসিয়া নিয়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE