মাঝরাত্তির পেরিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। ক্লাবহাউসের দিকে ফাটা কনফেটির টুকরোগুলো ছড়িয়ে আছে বিস্তীর্ণ ভাবে। তাঁকে, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে দূর থেকে দেখছি সেখানে দাঁড়ানো।
জয়ী টিম মাঠ ছাড়বে কী, এই তো সবে পায়ের ওপর পা তুলে গনগনে সাংবাদিক সম্মেলন শেষ করলেন মার্লন স্যামুয়েলস! ডারেন স্যামির চার উইকেটে বিশ্বজয়োত্তর বক্তৃতা এই কিছুক্ষণেই ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। তা নিয়েও ক্লাবহাউস মাঝরাত্তিরে সরগরম। মনে হচ্ছে যেন বিজয়ী ছক্কাগুলোর পরেও ফাইনাল শেষ হয়নি। অনেক ডেলিভারি এখনও বাকি!
কাপ ফাইনালে শেষ ওভারে টানা চার বলে চারটে ছক্কা পৃথিবীতে কেউ কখনও দেখেনি। ভাবেওনি। চুরাশি বছরের ইডেন ইতিহাস হতে দেখল, কথাটা তাই ভুল। বিশ্ব ক্রিকেটই যেখানে এমন বিচিত্র কিছু প্রথম প্রত্যক্ষ করল!
শেষ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জেতার জন্য ১৯ রান চাই। বোলার বেন স্টোকস। ব্যাটসম্যান কার্লোস ব্রেথওয়েট। ওয়েস্ট ইন্ডিজ হেরে গেলে কেউ এতটুকু আশ্চর্য হবে না। সবাই মর্গ্যানের হাতে মনে মনে কাপ দেখছে। ঠিক এই সময় চারটে বিশাল ছক্কা মারলেন ব্রেথওয়েট। কোনওটার দৈর্ঘ আশি মিটার। কোনওটার পঁচাত্তর। কোনওটা পঁচাশি। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল জাভেদ মিয়াঁদাদের শেষ বলে শারজার ছক্কা এর পর থেকে ক্রিকেটের স্কুলছাত্রদেরই কেবল পড়ানো হবে। ধোনির ছয়গুলো? ব্রেথওয়েটের এক্সট্রা লার্জ হিটিংয়ের পাশে ধোনিরগুলো আজকের পর স্মল সাইজ দেখাচ্ছে!
ইডেনের কাপ ফাইনাল থেকে ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন মাইক গ্যাটিং। কেউ তাঁর যুক্তি শুনতে চায়নি যে, রিভার্স সুইপ আমি ভাল মারতাম। ওয়ান ডে ক্রিকেটের এটা আধুনিকতম শট, যা না খেললেই নয়। তা ছাড়া ফাইনালে আউট হওয়ার আগেও এই স্ট্রোক খেলে আমি ৩ রান পেয়েছি। তা গ্যাটিং যেমন ইডেন-শাপে গত ঊনত্রিশ বছর ক্রুশবিদ্ধ, আজ থেকে স্টোকসও তাই।
কিন্তু আজকের ফাইনাল-কাহিনি তো শুধু ব্যাট, বল আর রিভার্স সুইপের নয়। ভারত না থেকেও এটা ইডেনে আজ অবধি সবচেয়ে মোহগ্রস্ত অভিজ্ঞতা। যখন ফাইনাল, না ফাইনালের আগে-পরের ঘটনা কোনটা লেখা হবে চূড়ান্ত গুলিয়ে যাচ্ছে? একই দিনে কী কী সব অদ্ভুতুড়ে দৃশ্য চোখের সামনে ফাস্ট ফরোয়ার্ড হতে লাগল। কোনটা ছাড়ি, কোনটা লিখি ফাইনাল শেষ হওয়ার দু’ঘণ্টা বাদেও বিভ্রান্ত লাগছে।
দুপুর তিনটে নাগাদ ক্লাবহাউসের আপার কেবিনে দেখলাম সৌরভ একটু আপসেট হয়ে বসা। কারণ পোস্তায় ফ্লাইওভার ভেঙে মৃতদের জন্য নীরবতা পালন করতে রাজি হচ্ছে না আইসিসি। এমনকী তারা বলে পাঠিয়েছে, জগমোহন ডালমিয়ার ওপর সিএবি-নির্মিত তথ্যচিত্র চার মিনিট থেকে ছেঁটে দেড় মিনিটে নামাতে হবে। তাদের নাকি এত সময় নেই।
এর পরের এক ঘণ্টা সৌরভ তদারকি করলেন উইকেটের। ডিনার কুপন কী ভাবে কার কাছে বিলি করা হবে সেটা ঠিক করে দিলেন। আর উঁকি মেরে মেরে বারবার দেখলেন কেউ ভুল করে টাওয়ারের আলো আগেই জ্বালাচ্ছে না তো? সৌরভের মোবাইলে একটা অদ্ভূত ভিডিও। যেখানে সিসিটিভি দেখাচ্ছে আগের দিন গোলাপি শার্ট পরা একজন মানুষ কী ভাবে ম্যাচ চলাকালীন আলো নিভিয়ে দিচ্ছেন। সৌরভ আজ তাই ফেলুদার মতো ওঁত পেতে থাকা। আবার যদি কোনও অপরাধী আসে। মুখ্য ম্যাচ সংগঠক লাইটের প্রতি মুহূর্তের তদারকি করছে, এমন আজব দৃশ্য থেকেই হয়তো আন্দাজ পাওয়া উচিত ছিল গোটা খেলা এবং তার পরের অংশ ক্রিকেট-মননকে আজ কেমন ঘেঁটে দিতে পারে।
জয়ীদের হাতে বিশ্বকাপ তুলে দেওয়ার কথা আইসিসি প্রেসিডেন্ট জাহির আব্বাসের। জীবনে কখনও দেখিনি কাপ হাতে নেওয়ার আগেই শ্যাম্পেনের বোতল খোলা হয়। কিন্তু গেইল তো তাই করলেন। কাপ ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়কের হাতে উঠেছে কী না, শ্যাম্পেনের ফেনা ভরে গেল তার ওপর। জাহির খেলোয়াড়জীবনে যেমন দ্রুত বাউন্সার ছাড়তেন। বাঁ পা-টা টেনে সরে এলেন। কিন্তু এ তো কিছুই না। জেতার পর ইডেন পিচের ওপর রেগে আর ক্যালিপসো মিশিয়ে তাঁদের আধুনিকতম নাচটা শুরু করে দিলেন ক্যারিবিয়ানরা। ইডেন অনেক কিছু দেখেছে, এমনকী সোবার্সের ম্যাচে আগুনও। কিন্তু উইকেটের ওপর দাঁড়িয়ে বিদেশিদের দলবদ্ধ নাচ দেখেনি।
কিছু পর মাঠের মধ্যে এমিরেটসের পোশাকে বিমানসেবিকাদের সঙ্গে নাচতে শুরু করল ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিম। ক্রিকেট যতই রমরমা টি-টোয়েন্টি যুগে থাক, আদতে রক্ষণশীল। বিজয় উৎসবে মাঠের মধ্যেই পুরুষ-নারী নাচছে, প্যাকার ক্রিকেটও এমন দৃশ্য কখনও দেখেনি।
কিন্তু সে তো প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ তীব্র আক্রোশে ট্রফি তাঁর এক নম্বর সমালোচককে উৎসর্গ করছে, এমন দৃশ্যও দেখেনি। মার্লন স্যামুয়েলস তো তাই করলেন। ৬৬ বলে ম্যাচ জেতানো অপরাজিত ৮৫-তেও যে ইনিংস ডিক্লেয়ার করেননি বোঝা গেল যখন তিনি খেতাবটা সটান উৎসর্গ করলেন শেন ওয়ার্নকে। ওয়াংখেড়ে সেমিফাইনালের পর নাকি ওয়ার্ন তাঁর সম্পর্কে অসম্মানজনক কিছু বলেছিলেন। এর পর স্যামি তাঁর বক্তব্য রাখলেন পুরস্কার বিতরণে। যা বক্তব্য তো নয়, কাঁদতে কাঁদতে স্মারক বক্তৃতা। ক্রিকেটের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোনও ক্যাপ্টেন বিজয়ীর মঞ্চে এমন প্রতিক্রিয়া দেয়নি।
স্যামি বললেন কত অপমান তাঁরা সহ্য করেছেন সেই সব কাহিনি। জো রুটের ব্যাট-বলে অলরাউন্ড দক্ষতা। গেইলের আবার নকআউট ম্যাচে ব্যর্থতা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাপ ফাইনালে স্পিনার দিয়ে আক্রমণ শুরু করা। সব কিছু তখন তার পাশে মলিন লাগছে।
স্যামি বললেন তাঁদের দেশের বোর্ড কোনও ইউনিফর্মের পর্যন্ত ব্যবস্থা করেনি। দুবাই থেকে কলকাতা এসে পৌঁছনোর পর কোনওক্রমে তাঁরা নিজেদের ব্যবস্থা করেন। বিশেষজ্ঞরা তাঁদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে গিয়েছেন। মার্ক নিকোলাস লিখেছেন, বুদ্ধিহীনের দল। এখানে ফাইনালে ওঠার পরও ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোনও বড় রাজনীতিবিদ তাঁদের শুভেচ্ছা জানাননি। চোখের জলে এই বক্তৃতা ওয়েস্ট ইন্ডিজের আজকের রাতকে যেন আরও অমর করে দিয়ে গেল। একটা সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিম ভিভের নেতৃত্বে এককাট্টা হত শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে। নতুন যুগে স্যামিদের দেখা গেল নতুন মোটিভেশন। বিপক্ষে খোদ নিজের দেশের বোর্ড কর্তারা। এটাও নজিরবিহীন।
বিরাট কোহালি ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট হলেন প্রভূত জল্পনার মধ্যে যে, আজকের ম্যাচটা কি আদৌ তিনি দেখছিলেন? না যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়ে আরও দুঃখের দাবানল এড়াতে টিভিই খোলেননি? তাঁর টিমকে নিয়ে অবশ্য আজকের পর শোকতাপের কারণ নেই। বিজিত ইংল্যান্ড যে লড়াই দিয়েছে, তা অসামান্য। ভারত মোটেও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আজকের মতো সংগ্রামী করতে পারেনি।
মাঠেও একটা অদ্ভূত জিনিস ঘটল যা ক্রিকেটে আর কখনও হয়েছে বলে জানি না। স্যামুয়েলসের বিরুদ্ধে কট বিহাইন্ডের আবেদনে আম্পায়ার আউট দিয়েছিলেন। থার্ড আম্পায়ারের কাছে পাঠানো টিভি রিপ্লেতে দেখা যায়, বল আগেই মাটিতে পড়ে গিয়েছে। নিয়ম হল থার্ড আম্পায়ার সিদ্ধান্ত জানানোর আগে ব্যাটসম্যান প্লেয়িং এরিনা ছাড়বে না। এক বার বেরিয়ে গেলে আর তাকে ফেরানো যায় না। কিন্তু ফাইনালের উত্তেজনায় আগেই মাঠে ঢুকে পড়েন পরের ব্যাটসম্যান রামদিন। শুধু ঢোকাই না, পিচের কাছে চলে যান। স্যামুয়েলস টিভি রিপ্লেতে নট আউট ঘোষিত হলে রামদিন আবার ফিরে যান ডাগআউটে। মাঠে এতটা ঢুকেও ব্যাট হাতে বাইরে বেরিয়ে আসা অভাবনীয়।
একসঙ্গে এত সব নজিরবিহীন নজিরের কোলাজ এক দিনে ঘটতে পারে, ভাবাই যায় না। অবশ্য এটাই বা কে ভেবেছিল যে, ডালমিয়ার উত্তরসূরি হিসেবে দিন আর রাত এক করে এত সফল বিশ্বকাপ সংগঠন দেখাবেন সৌরভ? পাকিস্তান ম্যাচের ঘূর্ণি পিচ এত দিনের যত্ন আর পরিশ্রমে টুর্নামেন্টের সেরা পিচের চেহারা নেবে। যার ওপর দাঁড়িয়ে দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের এ বারের রিক্রুট ব্রেথওয়েট এক-একটা ছক্কার ফুলঝুরি উড়িয়ে দেবেন ইডেনের আকাশে। উফ, সম্মোহনী ২৪ রান! এখনও মনে হচ্ছে, সত্যি বোধহয় দেখিনি।
শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের অমর রাতই নয়। যত দিন ইডেন থাকবে, এই শেষ ওভারটাও থাকবে। ভুল, ভুল। যত দিন ইডেন থাকবে, ওই ছক্কা আর তার পরের উত্তেজক উৎসবের অংশগুলো থাকবে।
সিএলআর জেমস, আজ ইডেনে থাকলে সত্যিই আপনার মনে হত কী অসাধারণ লাইনটা সেই কবে লিখেছিলেন। ‘তারা ক্রিকেটের কী বোঝে যারা শুধুই ক্রিকেট বোঝে!’
সংক্ষিপ্ত স্কোর: ইংল্যান্ড ১৫৫-৯ (রুট ৫৪, বদ্রী ২-১৬), ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৬১-৬ (স্যামুয়েলস ৮৫ ন.আ., ব্রেথওয়েট ৩৪ ন.আ.)।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy