সব ঠিক আছে। কিন্তু রেউড়ি কেন? এটা আবার কী নাম?
“আরে, এত মিষ্টি স্বভাবের বলে ছোট থেকে ওকে ওই নামে ডাকতাম। আসলে আমাদের এখানে এক রকম মিষ্টি পাওয়া যায়, যাকে রেউড়ি বলে। তাই,” বলার সময় হাসতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত তা আর পারেন না। মনে পড়ে যায়, পুরনো দিনগুলোর কথা। মনে পড়ে যায়, ঠিক এক বছর আগের এক সেপ্টেম্বরের কথা।
উত্সবের নয়। দুঃখের। আনন্দের নয়। যন্ত্রণার সেপ্টেম্বর।
স্বভাবসিদ্ধ ছটফটে ‘রেউড়ি’ তখন কেমন যেন গুম হয়ে থাকত। কিছু বললে-টললে দুমদাম রেগে যেত। দিদি ক্রিকেট নিয়ে কিছু বলতে গেলে নাকি পাল্টা ধমকে উঠে বলত, “তুই থাম তো। দিদি, দিদির মতো থাক। কোচ হতে যাস না।” গোটা দিনের মধ্যে অধিকাংশ সময় নাকি পড়ে থাকত জামনগর ক্রিকেট অ্যাকাডেমির মাঠে। কিছু কিশোর যেখানে খেলতে আসে। কিছু অনামী কোচ যেখানে আসতেন। ‘রেউড়ি’ সেখানে নাকি প্র্যাকটিস করত ঘণ্টার পর ঘণ্টা, একা-একা।
টেস্ট টিমে তো তাকে ফিরতেই হবে!
“আজ ওর পাঁচ উইকেটের খবরটা শোনার পর হঠাৎ একবার গত বছরটা মনে পড়ে গেল। শ্রীলঙ্কা সফরের টিম থেকে বাদ পড়ে চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল,” বলে চলেন নয়না। অদ্ভুত গল্পও শোনা গেল একটা। দুঃসময় চলাকালীন জাডেজা নাকি একবার ওই কাছের মন্দিরে নিজেই চলে যান। খালি পায়ে। বাড়ি ফেরার পর দিদি তাঁকে ‘কী চাইলি ঈশ্বরের কাছে’ জিজ্ঞেস করলে নাকি বলেন, ‘কিছু চাইনি। আমার যদি কপালে থাকে আবার টেস্ট খেলা, খেলব। না থাকলে আর হবে না!’
আসলে শ্রীলঙ্কা সফরে বাদ পড়া নয়। তার পর দেশের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ফিরে ভাল করার পরেও পরের টেস্ট সিরিজে আবার বাদ। কিছু দিন আগের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের প্রথম দু’টো টেস্টে তো ডাক পাননি। তৃতীয়টা খেলেন এবং দু’ইনিংস মিলিয়ে মাত্র তিনটে উইকেট নেন। যে কারণে চতুর্থ টেস্টের টিম থেকে আবার বাদ। “খুব খারাপ সময় যাচ্ছিল আমাদের। ওয়েস্ট ইন্ডিজে খেলল মাত্র একটা টেস্ট। কার ভাল লাগে বলুন, টিম থেকে বাদ পড়তে? আমি কখনও ওকে বকতাম। কখনও বোঝাতাম যে, তুই পারবি। তুই তো আগেও পেরেছিস। পারফর্ম কর। একবার রঞ্জিতে রান করতে পারলে, উইকেট নিতে পারলে দেখবি নির্বাচকরা আবার ডাকবে। বোর্ড চাইবে তুই আবার খেলিস।” শুনে কী বলতেন রবীন্দ্র? “হুঁ বলে উঠে যেত। বলত, দেখে নিস অন্তত খাটুনিতে ফাঁকি দেব না।” নয়নাকে জিজ্ঞেস করা গেল, ‘রেউড়ি’ পারলেন শেষ পর্যন্ত। কোনও উপহার চাইবেন কি না? শুনে তিনি উত্তর দেন, “ধুর। ওকে রাতে ফোন করে বলব যে, যা উপহার দিলি আজ যথেষ্ট। ওটা শুধু রিপিট করে যা। আমার আর কী চাওয়ার থাকতে পারে?”
ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো রবীন্দ্র জাডেজাকে মেলানো যায় এর সঙ্গে? বিশ্বাস হয়, নিজের বিয়ের ‘সঙ্গীতে’ ইনিই তরোয়াল ঘুরিয়েছিলেন বনবন করে?
বরং পাকানো গোঁফ, গালভর্তি দাড়ি আর সানগ্লাসে ঢেকে থাকা চোখের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আর এক ‘স্যর জাডেজা’কে পাওয়া যায়। যিনি প্রচারের ঝাড়বাতির তলায় থেকেও কোথাও গিয়ে এখনও সেই ‘স্মল টাউন বয়’। দিদির ধমক এখনও যিনি হজম করেন অনায়াসে। যিনি মাঝেমধ্যে কাউকে কিছু না বলে খালি পায়ে হেঁটে চলে যান মন্দির, কী চাইলেন বলতে চান না অতীব প্রিয়জনকেও। যাঁকে সাফল্যের দিনে আত্মহারার বদলে আত্মভোলার মেজাজে পাওয়া যায়। সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁর এত মারাত্মক আর্ম বল নিয়ে প্রশ্ন গেলে সরল উত্তর আসে, “ছোট থেকে আন্ডারপ্রিপেয়ার্ড সব উইকেটে খেলেছি তো। ওখানে খেলতে খেলতে শিখে গিয়েছি কী করে টার্নারে ও রকম আর্ম বল করতে হয়!” নিউজিল্যান্ড ব্যাটসম্যানদের নিয়ে অবলীলায় মজা করে যিনি বলে দিতে পারেন, “আরে, ওরা আমাদের স্পিন বুঝতে বুঝতেই তো অলআউট হয়ে গেল! ঠিক করেছিলাম, লাঞ্চ পর্যন্ত গোটা সত্তর রানের বেশি দেব না। আর জুটিটাকে ভাঙব। হল। ব্যস, তার পর কাম খতম!”
এক দিক থেকে দেখলে তাই প্রাপ্তি আজ দু’টো। পাঁচ উইকেট আর হ্যাটট্রিক চান্সের জাডেজা, অবশ্যই। কিন্তু ‘রেউড়ি’-র সঙ্গে পরিচয় হওয়াও কি কম কিছু?