Advertisement
০৬ মে ২০২৪

সালেহর কেরামতি দেখে অবাক দেশ

১৯৯৩ সাল। কবাডিতে জেলা চ্যাম্পিয়ন আবু সালেহ তখন মাধ্যমিকের ছাত্র। রায়বেঁশে দল নিয়ে তাঁর গ্রামে এসেছেন বড়ঞার কল্যাণপুরের শক্তিকুমার দলুই। তাঁর খেলা দেখে রায়বেঁশের প্রেমে পড়ে গেলেন সালেহ। বাকিটা ইতিহাস। তাঁর সঙ্গে কথা বললেন অনল আবেদিনতখন ১৯৯৩ সাল। কবাডিতে জেলা চ্যাম্পিয়ন আবু সালেহ মাধ্যমিকের ছাত্র। তাঁর গ্রামে এসেছেন বড়ঞার কল্যণপুরের রায়বেঁশে দল নিয়ে শক্তিকুমার দলুই। তাঁর খেলা দেখে রায়বেঁশের প্রেমে পড়ে গেলেন সালেহ। গুরু শক্তিকুমারের কাছে আর্জি জানালেন তিনি।

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৮ ০১:৩৮
Share: Save:

দিন সাতেক আগের কথা। সে দিন ছিল সোমবার, ১৯ নভেম্বর। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর জন্মদিন। ‘ইন্দিরা গাঁধী মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ দিল্লির এক নম্বর আকবর রোডে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। সেখানে তাঁরা বাঁশ-লাঠি, হাতা-খুন্তি নিয়ে বিমুগ্ধ করেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি ও কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী প্রমুখকে। ওই রায়বেঁশে শিল্পীদের বাড়ি খড়গ্রাম থানার প্রত্যন্ত গ্রাম গঙ্গারামপুরে। দেশের পাঁচটি রাজ্য থেকে পাঁচটি লোকনৃত্যের দলকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন রাহুল গাঁধী। ওড়িশা, গুজরাত, মণিপুর ও রাজস্থানের মতো ৪টি রাজ্যের লোকদলের সঙ্গে জায়গা করে নিয়েছিল এ রাজ্যের এক মাত্র ‘মুর্শিদাবাদ রায়বেঁশে আকাদেমি’। তার প্রায় পুরো কৃতিত্বই ওই আকাদেমির কর্ণধার আবু সালেহর। দর্শনে এমএ। ৪২ বছরের সালেহ মাত্র কয়েক গাছা বাঁশ-লাঠি, গ্লাস-হাঁড়ি সম্বল করে জম্মু-কাশ্মীর বাদে দেশের সব রাজ্য চষে বেড়িয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারে ‘পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র’-এর ব্যবস্থাপনায় আর মাস দু’য়েক পরে তাঁরা বিদেশেও পাড়ি দেবেন।

তখন ১৯৯৩ সাল। কবাডিতে জেলা চ্যাম্পিয়ন আবু সালেহ মাধ্যমিকের ছাত্র। তাঁর গ্রামে এসেছেন বড়ঞার কল্যণপুরের রায়বেঁশে দল নিয়ে শক্তিকুমার দলুই। তাঁর খেলা দেখে রায়বেঁশের প্রেমে পড়ে গেলেন সালেহ। গুরু শক্তিকুমারের কাছে আর্জি জানালেন তিনি। গুরুও মেনে নিলেন নতুন শিষ্যের আবদার। উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক স্তরের পড়ার ফাঁকে গুরুগৃহে গিয়ে তালিম নেন তিনি। একদা জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনী রায়বেঁশে খেলত। সেই নৃত্যক্রীড়ায় দক্ষ হয়ে উঠলেন একনিষ্ঠ শিষ্য সালেহ। নিজের উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রয়োগ করে সামন্তযুগের লোকশিল্পকে সাম্প্রতিক কালের উপযোগী করে গড়ে তোলেন তিনি। ইতিমধ্যে তিনি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। এলাকার বিয়ে ও ক্লাবের অনুষ্ঠানগুলোতে তাঁর রায়বেঁশের দলের ডাক পড়ে। যাতাযাতের খরচটুকু তখন পেতেন তাঁরা। তাঁর বেশ মনে আছে, ২০০৫ সালের ১০ এপ্রিলের ঘটনা। খড়গ্রাম থানার পুলিশের উদ্যোগে এড়োয়ালি গ্রামে চলছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানে রায়বেঁশে দেখিয়ে তৎকালীন মুর্শিদাবাদ জেলার পুলিশ সুপার সঞ্জয় সিংহকে তাক লাগিয়ে দেন। পুলিশ সুপারের নজরে পড়েন তিনি।

সরাসরি পুলিশের চাকরির প্রস্তাব দেন সঞ্জয় সিংহ। আবু সালেহও রাজি। চাকরি হল না বয়সের কারণে। পুলিশের চাকরির বয়ঃসীমার থেকে তাঁর বয়স তখন কয়েক মাস বেশি হয়ে গিয়েছিল। অবশেষ সঞ্জয় সিংহের দৌলতে তাঁর একটি দোনলা বন্দুক জুটল। সেই বন্দুক সম্বল করে বেসরকারি বহুজাতিক ব্যাঙ্কে নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি জোটে সালেহর। কলকাতা ও বহরমপুরে পর পর ৩টি বেসরকারি বহুজাতিক ব্যাঙ্কে নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি করেন তিনি। ইতিমধ্যে লোকসংস্কৃতি গবেষক শক্তিনাথ ঝা-এর নজরে পড়েন তিনি। শক্তিনাথ ঝায়ের কাছ থেকে একদিন ডাক এল। তাঁর উদ্যোগে একটি বাংলা টিভি চ্যানেলের বিনোদনমূলক প্রতিযোগিতায় যোগ দিল আবু সালেহর দল। সালেহ বলেন, ‘‘বিচারক ছিলেন বাংলা সিনেরমার দুই নায়ক চিরঞ্জিত ও প্রসেনজিৎ। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন মৌলি গঙ্গোপাধ্যায়। তিন বিচারেকের রায়ে আমার দল প্রথম হয়।’’ তার পরে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

মুম্বইয়ের একটি হিন্দি চ্যানেল থেকে তাঁর দল ডাক পায়। সেখানেও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের প্রতিযোগিতা। সারা দেশের ১৮০টি দল প্রতিযোগিতায় যোগ দেয়। সালেহ বলেন, ‘‘ওই প্রতিযোগিতার বিচারক ছিলেন সলমান খান, ফারহা খান ও অনু মালিক। তিন জুরির বিচারে সারা দেশের ১৮০টি দলের মধ্যে আমাদের দল প্রথম হয়। পুরস্কার হিসাবে পেলাম ১০ লক্ষ টাকা।’’ ২০১৩ সালে কেরলে আন্তর্জাতিক লোকউৎসবের প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে শ্রীলঙ্কা, কম্বোডিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার লোকদলকে পরাস্ত করে ‘মুর্শিদাবাদ রায়বেঁশে আকাদেমি’ প্রথম পুরস্কার জিতে নেয়। কেরলের মুখ্যমন্ত্রী নিজের আমাদের পুরস্কার তুলে দেন।’’ এ ভাবে ২০১০ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত দেশের ৮টি টিভি চ্যানেলের প্রতিযোগিতায় নেমে ৮ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তাঁর দল। পূর্বতন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এক সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তখন থেকে প্রতি বার দুর্গাপুজোর সময় প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বীরভূমের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তাঁর দল রায়বেঁশে প্রদর্শন করে।

আজ পিছন ফিরে তাকালে তিনি নিজেই হতবাক হয়ে যান। স্কুল জীবনে কবাডি খেলার সময় তাঁর একটি হাঁটু ভেঙে যায়। তিনি বলেন, ‘‘সেই সময় ভেবেছিলাম, আর বুঝি কোনও খেলাধুলো করতে পারব না!’’ সেই ভাঙা হাঁটু জোড়া লেগেছে। মাটিতে শুয়ে সেই হাঁটুতে ভর দিয়ে পা দু’টিকে উপর দিকে তুলে ধরেন তিনি। সেই পায়ের উপর রাখা হয় কাঠের তৈরি গরুর গাড়ির চার চারটে চাকা। সেই পায়েই শূন্যে তুলে ধরা হয় আরোহী- সহ মোটর বাইক। তাঁর মাথার উপর কাঁচের গ্লাস, তার উপরে সাইকেলের রিম। সেই রিমের উপরে বসে থাকে কিশোর। এই রকম ব্যালান্সের খেলায় পারদর্শী তিনি ও তাঁর দল। দু’ চোখ ময়দা দিয়ে বন্ধ। তার উপরে পুরু কাপড়ের কয়েকটি পাক দিয়ে বাঁধা হয়েছে। সামনে শুয়ে আছেন এক জন। চোখ বাঁধা অবস্থায় শুয়ে থাকা লোকের শরীরের চার পাশে নিখুঁত ভাবে ছোরা গাঁথার খেলায় তিনি ও তাঁর দলের সদস্যেরা দক্ষ। কাঁধে, মাথায়, হাতে ৮-১০ জনকে তিনি ঝুলিয়ে রাখতে পারেন।

তাঁর ‘মুর্শিদাবাদ রায়বেঁশে আকাদেমি’তে তিনিই বয়সে সবার বড়। ১২ বছর থেকে ৪২ বছরের সবাইকে নিয়ে মোট ১৫ জন সদস্যের দল। তিনি কেবল নিজের দল গড়েই কর্তব্য শেষ করেননি। লোকশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে তিনি বিভিন্ন এলাকায় প্রশিক্ষণ দিয়ে রায়বেঁশের দল গড়ে দিয়েছেন।

কয়েক বছর আগের কথা। নওদা থানার ওসি তাঁকে বলেন, ‘‘ক্লাবের ছেলেরা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। তাদের রায়বেঁশে শেখালে কেমন হয়?’’ আমতলা-বালি হিতৈষী ক্লাব’-এর ছেলেদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তিনি রায়বেঁশের দল গড়ে দিয়েছেন। সালেহ বলেন, ‘‘একই রকম ভাবে কান্দিতে একটি ও ভগবানগোলা গার্লস হাইস্কুলে ছাত্রীদের নিয়ে আরও একটি রায়বেঁশে দল গড়েছি।’’ পুরুষালি সেই লোকনৃত্য মকসো করে ভগবানগোলা গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রীদের রায়বেঁশের দল স্কুল পর্যায়ের রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় গত বছর প্রথম হয়েছিল।

গরুর গাড়ির চাকা, সাইকেলের রিম, বাঁশের মই, বাঁশ, মাটির কলসি, পাথর, শাবল, রণপা, বাতিল টিউব লাইট, ছোরা, তলোয়ার, ইট, মোটর বাইক, কাচের লম্বা বোতলের মতো মামুলি সামগ্রী নিয়ে আবু সালেহ সারা দেশ জয় করে ফেলেছেন। এখন তাঁর চোখ সমুদ্র পারের বিদেশের দিকে।

ছবি: গৌতম প্রামাণিক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Stunt Stuntman Abu Saleh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE