আইএসএল ধামাকার প্রস্তুতি। এই মঞ্চেই থাকছে আজ প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার চমক। শনিবার যুবভারতীতে তারই প্রস্তুতি। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
হুদহুদের প্রভাব দেখা গেল গণেশ পুজোর প্রসাদ বিতরণের পরেই!
ভারতীয় ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধামাকার নেপথ্যে মগজাস্ত্র যাঁর, সেই নীতা অম্বানী শনিবার যখন যুবভারতীতে ঢুকলেন, কালো মেঘের সৌজন্যে তখন আগাম সন্ধ্যা নেমেছে স্টেডিয়ামে। ইন্ডিয়ান সুপার লিগ বোধনের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি দেখতে জনা পনেরো ব্ল্যাক ক্যাট নিয়ে সটান মাঠে ঢুকে পড়লেন টুর্নামেন্টের চেয়ারপার্সন। অ্যাথলেটিক ট্র্যাকের উপরই শুরু করে দিলেন গণেশ পুজো!
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল এর পরেই। তাতেও অবশ্য থমকাল না উদ্বোধন যজ্ঞের শেষ বেলার রিহার্সাল। বিশাল মূল মঞ্চকে ঘিরে তৈরি আটটা আলাদা-আলাদা মঞ্চে আট রাজ্যের আট সেরা বাদক বিক্রম ঘোষ, শিবামণিদের বিভিন্ন ধরনের ঢাকে বেজে উঠল দ্রিম দ্রিম! বাঁশির মূর্চ্ছনা, মাদলের আওয়াজ ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ফিরল স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে। মনে হচ্ছিল, বিশ্ব ফুটবলের প্রেক্ষাপটে একেবারে শিশু হয়ে থাকা এ দেশের ফুটবলে নতুন ফুত্কার উঠল— ‘আমরাও আসছি’ আওয়াজ দিয়ে।
রবিবার বিকেলে উদ্বোধন ঘটতে চলা সাতশো কোটির আইএসএল কি সত্যিই বদলে দেবে ভারতীয় ফুটবলের চালচিত্র?
লা লিগা, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, সেরি এ, বুন্দেশলিগা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ নিয়মিত দেখা এ দেশের ফুটবলপ্রেমীরা কি এই কর্পোরেট টুর্নামেন্ট নিয়ে আগ্রহী হবেন? মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, নেইমার, ইব্রাহিমোভিচদের চেটেপুটে দেখার পর প্রায় অবসর ও অবসর নিয়ে ফেলা দেল পিয়েরো, রবার্ট পিরেস, মাতেরাজ্জিদের ফ্র্যাঞ্চাইজি ম্যাচ দেখতে ভিড় করবেন? টিভির সামনে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করবেন? বার্সোলোনা বনাম রিয়াল মাদ্রিদের পাশে আটলেটিকো দে কলকাতা বনাম দিল্লি ডায়নামোসের খেলা নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনায় তর্কের তুফান ছোটাবেন রকের আড্ডায়?
এটা ঘটনা যে, আইএসএলের আট ফ্র্যাঞ্চাইজিতে আইকন ফুটবলার হিসাবে যাঁরা এসেছেন সেই বিশ্বকাপার, ইউরো চ্যাম্পিয়নরা বিগত যৌবনা। আট বছর আগে ইতালিকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন দেল পিয়েরো আর মাতেরাজ্জি। টুর্নামেন্টের সবচেয়ে দামি ফুটবলার দেল পিয়েরো গত বছর সিডনি এফসি-র মতো ক্লাবে খেলেছেন। যে ক্লাবের বিশ্ব ফুটবলে তেমন কোনও নম্বর নেই। সেখান থেকে ভারতে। আর জিদানের ঢুঁসো খাওয়া মাতেরাজ্জি অবসর নিয়েছেন তিন বছর হয়ে গেল। তিনি এ বার চেন্নাইয়ান্সের প্লেয়ার-কাম-কোচ। উদ্বোধনী ম্যাচে মাঠে নামা মুম্বই এফসি-র আনেলকা অবশ্য গত বছর ইপিএলে খেলেছেন ওয়েস্ট ব্রমের হয়ে। স্প্যানিশ বিশ্বকাপার লুই গার্সিয়া-ও কলকাতায় খেলতে এসেছেন অবসর নিয়ে। নর্থইস্টের কাপদেভিয়া বিশ্বকাপ জেতার পর দেশের জার্সি তুলে রেখেছিলেন। তবে ছাড়েননি ক্লাব ফুটবল। গত বছর খেলেছেন বার্সেলোনার প্রতিবেশী ক্লাব এসপ্যানিয়লে। জীবনপঞ্জীগুলো দেখলেই মালুম হবে, নিজেদের সোনার সময়টা ওঁরা পেরিয়ে এসেছেন।
মানুষের পছন্দের চোখ কালের নিয়মেই বদলে যায়। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে। এক সময় দেল পিয়েরো বা রবার্ট পিরেসদের দেখতে বিশ্বকাপের গ্যালারি মাতোয়ারা হত। তাদের নিয়ে তৈরি গান বেঁধে মেক্সিকান ওয়েভ উঠত স্টেডিয়ামে। কিন্তু এখন সেই দর্শকদের পছন্দের দৃষ্টি সরে গিয়েছে মেসি-নেইমার-রোনাল্ডোদের দিকে। শুধু বাংলায় নয়, তাবত্ ভারতীয়ের ঘরের দেওয়ালে এখন ওঁদের পোস্টার দেখা যায়। রোনাল্ডোদের চুলের স্টাইল থেকে বান্ধবী, খেলার খুঁটিনাটি আলোচনা হয় লাঞ্চ অথবা ডিনার টেবিলে। সেখানে ‘ফিরিয়ে দাও’ থিম নিয়ে মাঠে নামা নতুন লিগের সংগঠকরা কতটা সফল হবেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
পাল্টাও যুক্তি অবশ্য আছে। “মেসির খেলা দেখতে যুবভারতীতে যা লোক হয়েছিল, মারাদোনাকে শুধু চোখের দেখা দেখতেও তেমনই ভিড় হয়েছিল,” শনিবার রাতে দাবি করছিলেন সংগঠকদের এক প্রভাবশালী কর্তা। তাঁর দাবি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ জিকোর জাপানকে দেখতেও কিন্তু কয়েক বছর আগে ভর্তি ছিল সল্টলেক স্টেডিয়াম। সেই জিকোই তো এফসি গোয়া টিমের দায়িত্বে নিয়ে এই টুর্নামেন্টে। ‘লেটস ফুটবল’ স্লোগান নিয়ে মাঠে নামা বিশ্বের অন্যতম ধনী শিল্পপতি মুকেশ অম্বানীর স্ত্রী নীতা বলে দিলেন, “এটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। সময় বলবে টুর্নামেন্ট সফল হল কি না। তবে এই চেষ্টায় তৃণমূল স্তরের ফুটবল উপকৃত হবে। যাতে লাভবান হবে ভারতীয় ফুটবলই।”
আর সেই ভাবনা থেকেই একটা বড় ধামাকা দিয়ে আইএসএল শুরু করতে চাইছে আইএমজি-রিল্যায়ান্স গ্রুপ। এবং তা এতটাই জমকালো যে স্বয়ং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত যুবভীরতাতে ঢুকে এ দিন অবাক হয়ে গিয়েছেন। “আরে, এ তো ইডেনের মতো দেখাচ্ছে যুবভারতীকে! সল্টলেক স্টেডিয়ামকে এ রকম দেখবো কখনও ভাবিনি।” সত্যিই গত এক মাসে বদলে গিয়েছে স্টেডিয়ামের ভুগোল। আলো ঝলমলে। টিভি ক্রুদের দৌড়োদৌড়ি। দেশ-বিদেশের কুশীলবদের মুখ। লেজার শো-এর আলোর দাপাদাপি রঙিন আর মোহময় করে তুলেছে লক্ষাধিক দর্শকাসনের বিশাল স্টেডিয়ামকে। আঠাশ মিনিটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে নিখুঁত বুননে বাঁধা হয়েছে। এ তো হয় বিশ্বকাপে! অলিম্পিকে! ক্রিকেট আইপিএলে! মান্ধাতার আমলের ভারতীয় ফুটবল কর্তাদের ব্যর্থতা, ধ্যানধারণা বদলে দিতে দিন-রাত পরিশ্রম করছেন কর্পোরেট কর্তারা।
মিনিট ধরে ধরে সাজানো হয়েছে অনুষ্ঠান। উদ্বোধন করতে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কতক্ষণ বক্তৃতা দেবেন সেটা ছাড়া সবই ঢুকে গিয়েছে নিয়মের মধ্যে। ম্যাচ কমিশনারের চেয়ার তুলে দিয়ে সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর জন্য চেয়ার বসানো এবং পুলিশের শেষ মুহূর্তের নানা নির্দেশ ছাড়া সব কিছুই চলছে ঠিকঠাক। তবে রক্তচক্ষু দেখাচ্ছে ঘূর্ণিঝড় হুদহুদ। আবহাওয়াবিদরা জানাচ্ছেন, রবিবার অন্ধপ্রদেশে আছড়ে পড়বে ঝড়। তার প্রভাবে কলকাতায় দফায় দফায় বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা। ফুটবলপ্রেমীরা অবশ্যই সেটা চাইছেন না। কারণ ফুটবল ঘিরে এই অবাক যজ্ঞের সাক্ষী থাকতে চাইছেন তাঁরা।
সেটা কেমন? শনিবার রাতে যে রিহার্সাল হল, আসল ক্ষেত্রে তা চমকে দেবে বলেই মনে হয়। ১৬০ জন বাদক একসঙ্গে বাজাবেন একই সুর। আট রাজ্যের আট দল মিউজিশিয়ান যখন নিজেদের সেরা সৃষ্টি— বিহু থেকে বাউলে মাতাবেন স্টেডিয়াম, তখন নিজেদের আইকন ফুটবলারদের নিয়ে মঞ্চে উঠবেন ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকরা। মেরি কম-খ্যাত বলিউড নায়িকা প্রিয়ঙ্কা চোপড়া নিজে পারফর্ম করা ছাড়াও পরিচয় করিয়ে দেবেন মালিক আর তাঁর টিমের আইকনদের। বিশাল ইন্ডিয়ান সুপার লিগ সত্যিই নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির শতাব্দীপ্রাচীন ভারতীয় ফুটবলে!
আজ টিভিতে
আটলেটিকো দে কলকাতা : মুম্বই সিটি এফসি
(সন্ধ্যা ৭-০০, স্টার স্পোর্টস ২ ও স্টার নেটওয়ার্কে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy