Advertisement
০৪ মে ২০২৪
বঙ্গ লজ্জার প্রতীক মশাল থেকে নৌকো

চার গোলের ধাক্কায় গণ পদত্যাগ

মারগাও থেকে ভাস্কো— চল্লিশ কিলোমিটারের এ দিক-ও দিক গোয়ার দুই শহর রবিবার হয়ে থাকল বাংলার ফুটবলের দুই লজ্জার মুখ! মাঠে এবং মাঠের বাইরে, সকালে এবং বিকেলে দুই কুত্‌সিত ঘটনার জেরে ফেড কাপে মুখ পুড়ল বাংলার দুই ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগানের। যার ধাক্কায় বাগানে আবার ঘটে গেল চরম নাটকীয় ঘটনা। যা ঘটল এ দিনই রাতে কলকাতায়। আড়াই দশক ধরে আগলে রাখা কুর্সি থেকে সরে দাঁড়ালেন বাগানের তিন শীর্ষকর্তা।

কোলাসো। ঘুষি বাগিয়ে চড়াও মিডিয়ার উপর।

কোলাসো। ঘুষি বাগিয়ে চড়াও মিডিয়ার উপর।

রতন চক্রবর্তী
মারগাও শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:৫১
Share: Save:

মারগাও থেকে ভাস্কো— চল্লিশ কিলোমিটারের এ দিক-ও দিক গোয়ার দুই শহর রবিবার হয়ে থাকল বাংলার ফুটবলের দুই লজ্জার মুখ! মাঠে এবং মাঠের বাইরে, সকালে এবং বিকেলে দুই কুত্‌সিত ঘটনার জেরে ফেড কাপে মুখ পুড়ল বাংলার দুই ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগানের। যার ধাক্কায় বাগানে আবার ঘটে গেল চরম নাটকীয় ঘটনা। যা ঘটল এ দিনই রাতে কলকাতায়। আড়াই দশক ধরে আগলে রাখা কুর্সি থেকে সরে দাঁড়ালেন বাগানের তিন শীর্ষকর্তা।

লাল-হলুদ কোচ আর্মান্দো কোলাসোর সাংবাদিকদের উপর চড়াও হওয়ার মতো ভয়ঙ্কর অভব্য আচরণ করেছিলেন সকালে। মারগাওয়ের রায়া স্টেডিয়ামে। কয়েক ঘণ্টা পরে ভাস্কোয় সঞ্জয় সেনের মোহনবাগান সালগাওকরের কাছে বিশ্রী ভাবে পর্যুদস্ত হল। চার গোল হজম করে ফেড কাপের গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হল শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাবকে। ১-৪ হারের পর আরও বড় নাটক হল কয়েক হাজার মাইল দূরে কলকাতায় সনি-বোয়াদের ক্লাবের অন্দরে। নাটকীয় ভাবে পদত্যাগ করলেন নব্বই থেকে ক্লাবের শাসনে থাকা টুটু বসু-অঞ্জন মিত্র। সঙ্গে দেবাশিস দত্তও। কমর্সমিতির সদস্যদের অন্ধকারে রেখে হঠাত্‌-ই।

টানা প্রায় ছয় বছর ট্রফি-খরার দায় কাঁধে নিয়ে সরে যাচ্ছেন বলে পদত্যাগপত্রে লিখেছেন মোহনবাগানের প্রেসিডেন্ট, সচিব, অর্থসচিব (যিনি মূলত ক্লাবের ফুটবল দলের দেখভাল করেন)। বাগানের বিরোধী গোষ্ঠী অবশ্য এটাকে নির্বাচনের আগে চমক হিসাবে দেখছে। তাঁদের দাবি, পিঠ বাঁচাতে এ সব নাটক করা হচ্ছে। নিজেদের মধ্যে পদত্যাগ দেওয়া-নেওয়ার খেলা চলছে।

মোহনবাগান কর্তারা চমকপ্রদ ঘটনা ঘটানোর দিনে, ইস্টবেঙ্গল কর্তারা সমস্যায় তাঁদের কোচের কুত্‌সিত আচরণ নিয়ে। সারদা কাণ্ডের জেরে দুই বড় ক্লাবের দুই অন্যতম শীর্ষকর্তা হাজতে। এমনিতেই টালমাটাল দুই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবই। তার উপর এ দিনের ঘটনায় কোটি কোটি সমর্থকের আবেগের দুই প্রতিষ্ঠানে শুরু হয়েছে আরও বড় ডামাডোল। বেরিয়ে পড়েছে প্রশাসনের কঙ্কালসার চেহারা।

টিমের ব্যর্থতা দেখার পর মোহন সচিব অঞ্জন মিত্র বললেন, “ব্যর্থতার দায় নিয়ে সরে যাচ্ছি। আমি বিপর্যস্ত। আজকের হারের পর আর পদে থাকতে চাই না। অন্য কেউ এসে ক্লাব চালাক।”

অন্য দিকে কোচের ন্যক্কারজনক আচরণে বিরক্ত ইস্টবেঙ্গল ফুটবল সচিব সন্তোষ ভট্টাচার্য বলছেন, “কোচ যা করেছেন তাঁকে সমর্থন করি না। ক্লাবও সমর্থন করছে না।” আর অঞ্জনকে প্রশ্ন করা হয়, আপনারা সরে গেলে ফুটবলারদের পেমেন্ট দেবে কে? কে চালাবে ক্লাব? তেমন জুতসই উত্তর দিতে পারেননি পদত্যাগী সচিব। ধোঁয়াশা ছড়িয়ে বললেন, “ও ঠিক চলে যাবে। মোহনবাগান কারও জন্য আটকে থাকে না। যে চালাতে আসবে তার জন্য শুভেচ্ছা রইল। যেখানে সই করতে বলবে করে দেব।” গুঞ্জন ছড়িয়েছে, গোয়া থেকে ফিরে এলে সনিদের যে টাকা দিতে হবে তা জোগাড় হয়নি এখনও।

আর্মান্দোকে কি ইস্টবেঙ্গল শো-কজ করবে বা ভর্ত্‌সনা করবে? এই প্রশ্নে ফুটবল সচিব বললেন, “ওঁর সঙ্গে আমরা কথা বলব। জানতে চাইব কেন তিনি এ রকম করছেন?” নিজের পাড়া গোয়ার মাঠে তাঁর টিম সমস্যায়। চারদিকে সমালোচনার ঢেউ উঠেছে তাঁর ট্যাকটিক্স আর দল পরিচালনার স্টাইল নিয়ে। এ রকম আবহে এ দিন ইস্টবেঙ্গল অনুশীলনের পর মেজাজ হারান কোচ। স্পোটির্ং ক্লুব দ্য গোয়ার বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের দু’দিন আগে যে ভাবে আর্মান্দো ঘুষি বাগিয়ে বক্সারের মতো চড়াও হলেন সাংবাদিকদের উপর, ধাক্কা দিয়ে সরালেন তাঁকে শান্ত করতে আসা মেহতাব হোসেনের মতো নিজের দলের সিনিয়র ফুটবলারকেও, তা অতীতে দেখেনি ভারতীয় ফুটবল।

ছাপার অযোগ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে বারবার সংবাদমাধ্যমের লোকজনদের দিকে তেড়ে এসে আর্মান্দো বলতে থাকেন, “আমি টিম হোটেলে থাকি না বাড়িতে, তা কেন লেখা হবে? আমার যা ইচ্ছে তাই করব। কেন আমি বলজিত্‌কে শুরুতে খেলাইনি তা নিয়ে কেন সমালোচনা হবে কাগজে? মাত্র দু’টো ম্যাচ খারাপ খেলেছে টিম, তাতেই কেন এত সমালোচনা আমার? আমি তোমাদের মেরে ফেলব। মিডিয়াকে দরকার নেই। তোমরা যা পারো লেখো।”


ম্যাচ শেষে স্তব্ধ সনি। ভাস্কোয় রবিবার।

অনুশীলন কভার করতে আসা সাংবাদিকরা ইস্টবেঙ্গল কোচের আচরণ দেখে হতভম্ব হয়ে যান। ডুডু, র্যান্টি-সহ টিমের ফুটবলারদের মতোই। লাল-হলুদের গোয়ান কোচের রুদ্রমূর্তি এবং মুখের অবয়ব দেখে মনে হচ্ছিল তিনি বোধহয় মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। ডাক্তাররা তাঁকে ইতিমধ্যেই পরামর্শ দিয়েছেন চাপ না নেওয়ার জন্য। পরিবার থেকেও চাপ রয়েছে কোচিং ছাড়ার। তার উপর কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন টিমের এই হাল যেন আর্মান্দোকে আরও দিশাহারা করে তুলেছে। এর আগেও মিডিয়ার সঙ্গে তাঁর কয়েকবার ঝামেলা হয়েছে কলকাতায়। তবে সেটা তর্কাতর্কিতে সীমাবদ্ধ ছিল। হয়তো গোয়া নিজের পাড়া বলেই এমন বিশ্রী আচরণ করার সাহস পেয়েছেন তিনি। প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে কুত্‌সিত আচরণ করে আর্মান্দো সোজা উঠে পড়েন নিজের গাড়িতে। ফের টিম হোটেলে না গিয়ে রওনা হন তিরিশ কিলোমিটার দূরে আগাসাইনে বাড়িতে। কবে, কখন ফিরবেন জানে না কেউ।

লাল-হলুদ কোচ সাংবাদিকদের মারার হুমকি দিয়ে বাড়িতে চলে গিয়েছেন সকালে। বাগান কোচ বিকেলে টিম হোটেলে ফিরলেন ক্লাবের ইতিহাসে আরও একটা চরম অন্ধকার দিন সঙ্গে নিয়ে। বিধ্বস্ত সনি-বোয়া-কাতসুমিরাও। পরপর দু’টো ম্যাচ ভাল খেলার পর এ দিন টুর্নামেন্টের সবচেয়ে গুরুত্বর্পূণ ম্যাচে মুখ থুবড়ে পড়ল মোহনবাগান। যে ম্যাচটা জিতলে শেষ চারের রাস্তা খোলা থাকবে, সেখানেই চূড়ান্ত হতাশ করল তারা।

গতবারের কোচির মতোই ম্যাচের পর সামান্য কান্নাকাটি হল, মুখ গোমড়া করে বসে রইলেন ফুটবলাররা। শিল্টন পাল না থাকলে আরও অন্তত তিন গোল হজম করতে হত বাগানকে। বিশ্বকাপে ব্রাজিলের সাত গোল হজমের ভারতীয় দৃশ্য ফিরতে পারত ভাস্কোর তিলক ময়দানে। কোচ সঞ্জয় বলছেন, “সব দায় আমার। টিমে একজন ব্যর্থ হলে তবু সামলানো যায়। সাত-আটজন হেঁটে হেঁটে খেললে এ রকম বিপর্যয় তো হবেই।”

সনি-প্রীতমরা যখন হোটেলে ফিরছিলেন তাঁদের দেখে মনে হচ্ছিল শবদেহবাহী কোনও শ্মশানযাত্রী। দুঃসহ আবহের মধ্যেই টিম হোটেলে সন্ধের একটু পরেই পৌঁছে যায় ক্লাবের তিন শীর্ষকর্তার একযোগে পদত্যাগের দুঃসংবাদ। হতাশার মধ্যেই শুরু হয়ে যায় ফিসফাস। আড়াই মাসের মাইনে বাকি বেশির ভাগ ফুটবলারের। তা নিয়েই চিন্তিত হয়ে পড়েন সবাই। শিলংয়ের বিরুদ্ধে নিয়মরক্ষার ম্যাচ খেলার জন্য আরও দু’দিন এখানে

মারগাও, ভাস্কো, কলকাতা— তিন শহর জুড়ে রবিবাসরীয় নাটকের পর নাটকে বিরক্ত দুই বড় ক্লাবের সমর্থকরাই। হতাশও। ফেসবুক, টুইটার সোশ্যাল মিডিয়ায় উপচে পড়ছে নানা মন্তব্য। টিপ্পনি। যাঁর ক্যাচলাইন হতে পারে— বাংলার ফুটবলের এখন ঘোর দুর্দিন! প্রথম আইএসএল ট্রফি কলকাতায় আসার পরও!

ছবি: উত্‌পল সরকার

পাল্টা মারে বাগান শেষ
রতন চক্রবর্তী • ভাস্কো

মোহনবাগান ১ (বোয়া)
সালগাওকর ৪ (ডুহু-২, কাসোন্ডে, ক্লিফটন)

আট বছর আগে শেষ বার ফেড কাপ চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন তিনি। গতবার শেষ চারে তুলেও হেরে যান। রবিবার মোহনবাগান যখন একের পর এক গোল হজম করছে তখন সেই করিম বেঞ্চারিফা মোবাইলে কী লিখছিলেন। হয়তো মেসেজ পাঠাচ্ছিলেন। খেলা শেষ হতেই মরক্কান কোচ বিধ্বস্ত বাগান ড্রেসিংরুমের পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেলেন পুণের টিম হোটেলে। ডেম্পোর পর সবচেয়ে ভাল খেলছিল সঞ্জয় সেনের টিম। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে কী ভাবে নিজেদের খেলাটা ভুলে গেলেন সনি-বোয়ারা, তা নিয়ে গবেষণা চলতে পারে। বাগান কোচের কাছেও ব্যাখ্যা নেই। ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে তিনি শুধু বললেন, “আমার ভিডিও অ্যানালিস্ট নেই। ফলে বলা সম্ভব নয় কেন এমন হল। তবে, এই টিমের অনেকেই আই লিগে থাকবে না।” তখনও অবশ্য ক্লাব কর্তাদের পদত্যাগের খবর আসেনি। জয় ছাড়া পথ ছিল না বাগানের। তাই পরীক্ষায় যাননি সঞ্জয়। কিংশুক, পঙ্কজকে এনে কাতসুমিকে নিয়ে যান লালকমলের জায়গায়। আক্রমণাত্মক শুরু করে গোলও পেয়ে যান বোয়া। কিন্তু পাল্টা আক্রমণের স্ট্র্যাটেজি নিয়ে সালগাওকর অ্যাটাকিং থার্ডে চাপ দিতেই ভেঙে পড়ল বাগান ডিফেন্স। বোয়া, সনি, বলবন্ত জায়গা পাল্টে আক্রমণ শুরু করলেও আঁটোসাটো গোয়া রক্ষণের সামনে পড়ে তাঁরা হাঁসফাঁস করছিলেন। মার্কার ছাড়াতে সনিরা নীচে নামায় আরও সুবিধা হয়ে গেল বিপক্ষের। ডাফি, ডুহু নিজেদের খেলা শুরু করতেই বাগান শেষ। বাগান কোচ ১-২ পিছিয়ে পড়ার পর ৪-৩-৩ এর স্ট্র্যাটেজিতে মরিয়া আক্রমণে গেলেন। সেটাই বুমেরাং হল। আরও দু’গোল হজম করতে হল। শিল্টন তিনটি দুর্দান্ত সেভ না করলে কপালে আরও দুঃখ ছিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE