Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

টমাসকে দেখিয়ে মুলার বললেন চিনে রাখুন, একদিন মাঠ কাঁপাবে

সেটা ২০০৯ সাল। বায়ার্ন মিউনিখ তখনও মাঠেই আসেনি। অথচ কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম যেন গর্জন করছে। কলকাতায় বায়ার্ন মিউনিখের অনূর্ধ্ব ২৩ দল খেলতে আসবে শুনেই উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ওঁরা রাজিও হয়ে গেলেন। গ্যালারিতে থাকা ভিড়ের মতো আমিও এক জনকে দেখার জন্যই মুখিয়ে রয়েছি। সত্যি কথা বলতে, সে সময় উৎকন্ঠায় কয়েক দিন রাতে ভাল ঘুমও হয়নি।

(বাঁ দিকে) গার্ড মুলারের সঙ্গে অশোকবাবু। (ডান দিকে) এই বলটিই অশোকবাবুকে উপহার দেয় বায়ার্ন। ছবি: রত্না ভট্টাচার্যের সংগ্রহ থেকে।

(বাঁ দিকে) গার্ড মুলারের সঙ্গে অশোকবাবু। (ডান দিকে) এই বলটিই অশোকবাবুকে উপহার দেয় বায়ার্ন। ছবি: রত্না ভট্টাচার্যের সংগ্রহ থেকে।

অশোক ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৪ ০৪:৪৩
Share: Save:

সেটা ২০০৯ সাল। বায়ার্ন মিউনিখ তখনও মাঠেই আসেনি। অথচ কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম যেন গর্জন করছে।

কলকাতায় বায়ার্ন মিউনিখের অনূর্ধ্ব ২৩ দল খেলতে আসবে শুনেই উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ওঁরা রাজিও হয়ে গেলেন। গ্যালারিতে থাকা ভিড়ের মতো আমিও এক জনকে দেখার জন্যই মুখিয়ে রয়েছি। সত্যি কথা বলতে, সে সময় উৎকন্ঠায় কয়েক দিন রাতে ভাল ঘুমও হয়নি।

অবশেষে মাঠে এলেন তিনি। ছোট করে কাটা চুল। এক মুখ সাদা দাড়ি। গার্ড মুলার। কিংবদন্তি ফুটবলার। বায়ার্ন মিউনিখের কোচ। তখনও পর্যন্ত বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা। খুব ভাল না হলেও, কাজ চালানোর মতো ইংরেজি জানেন। বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা হল। তাঁর খেলার প্রশংসা করতে হাত বাড়িয়ে ডেকে আনলেন দলের আর এক খেলায়োড়কে। তাঁর বয়স বড় জোর ১৯। সুঠাম চেহারা। কপালটা বেশ প্রশস্ত। গার্ড মুলার বললেন, “একে দেখে রাখুন, ভবিষ্যতে এক দিন নাম করা খেলোয়াড় হবে।”

কোচের প্রশংসা শুনে মাথা নিচু করল ছেলেটা। হয়তো লজ্জা পেল। উৎসাহী ছেলেটাকে বললাম, “চলো তোমার সঙ্গে একটু খেলি।” মাঠের এক কোণায় একটি বল নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ওর সঙ্গে শর্ট পাস করলাম। ছটফটে ছেলেটা হ্যান্ডশেক করে মাঠে দৌড়ে গেল। এর কিছুদিন পরে এক রাতে সেই ম্যাচের উদ্যোক্তার ফোন পেলাম। তিনি জানালেন, শিলিগুড়ি থেকে ফেরার পরেই বায়ার্ন মিউনিখের জুনিয়র দলে থাকা সেই ১৯ বছরের ছেলেটা জার্মানির বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পেয়েছে। এবং শিলিগুড়ি থেকে ফিরেই এই খবর পাওয়ায় শিলিগুড়ি তার কাছে ‘লাকি’ বা পয়মন্ত বলেও জানিয়েছেন। সে দিনের সেই ছেলেটাকে মঙ্গলবার রাতে যখন মাঠ জুড়ে খেলতে দেখলাম, পুরোনো সব কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল, গর্বিত হয়েছিলাম। ওই ছেলেটার সঙ্গে আমি কাঞ্চনজঙ্ঘা মাঠে বল নিয়ে পাস খেলেছি। কাজেই কাউকে যদি বলি, আমিও একদিন টমাস মুলারের সঙ্গে খেলেছি তা হলে অত্যুক্তি হবে?

হ্যাঁ, ২০০৯ সালের ২১ জুনের দুপুরে বায়ার্ন মিউনিখ জুনিয়র দলের কোচ গার্ড মুলার দলের যে কিশোর খেলোয়াড়কে ডেকে ভবিষ্যতের তারকা বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর নাম টমাস মুলার। সে দিন শিলিগুড়ির মেয়র একাদশকে ৬-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছিল মুলারের দল। সেই ম্যাচে অবশ্য টমাস কোনও গোল করতে পারেননি। প্রথম অর্ধের পরেই তাঁকে মাঠ থেকে তুলে নেওয়া হয়। ভেবেছিলাম, হয়ত গোল করতে পারেনি বলে তুলে নেওয়া হল। পরে শুনেছি, ভবিষ্যতের তারকার যাতে চোট আঘাত না লাগে সে জন্যই কোচ তাঁর প্রিয় ছাত্রকে প্রথমার্ধের পরে আর খেলাতে রাজি হননি। কিন্তু সেই ম্যাচে টমাসের পা থেকে যে এক একটি পাস বেরিয়েছিল, সেগুলি ছিল দেখার মতো। মঙ্গলবার রাতে যখন ব্রাজিলের বেলো হরাইজন্তের স্টেডিয়ামে টমাস মুলারকে ব্রাজিলের রক্ষণ দুরমুশ করতে দেখলাম, সত্যি তখন কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামের মুহূর্তগুলিও টুকরো টুকরো হয়ে ভেসে আসছিল।

মনে আছে, খেলার পরে মিষ্টি আর দার্জিলিঙের চা তুলে দেওয়া হয়েছিল বায়ার্নের খেলোয়াড়দের। দুপুরে গার্ড মুলারের মুখে প্রশংসা শোনার পর থেকে টমাসের ফ্যান হয়ে গিয়েছিলাম। ওকে দার্জিলিং চায়ের প্যাকেট দিয়েছিলাম। শিলিগুড়ির একটি জনপ্রিয় দোকান থেকে বাছাই করা মিষ্টিও পাঠিয়েছিলাম টমাসের হোটেলের ঘরে। খেলার শেষে জার্সিতে সই করে উপহার দিয়েছিল টমাসরা। কাকতালীয় ভাবে কয়েকদিন আগেই সেই জার্সি আমার স্ত্রী আলমারি থেকে খুঁজে বের করেছেন। পাশাপাশি ছবিও তুলেছিলাম বেশ কয়েকটা। তার অনেকগুলি হয় তো এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু আমার মতো অসংখ্য শিলিগুড়িবাসীর স্মৃতিতে টমাসে মুলারের খোঁজ মিলবে। শিলিগুড়িতে বসে ওঁর খেলা আমরা দেখেছি। এটা ভাবতেই ভাল লাগছে। আর মুলারও পরবর্তীতে শিলিগুড়িকে মনে রেখে লাকি’ বলেছিলেন, সেটাও মন ভাল করে দেয়।

শেষে বলি, বরাবরই আমি আর্জেন্তিনার সমর্থক। মেসির ভক্ত। কিন্তু ফাইনালে যদি আর্জেন্তিনা জার্মানির মুখোমুখি হয়, তবে টমাস মুলারের প্রতি দুর্বলতা থাকবেই। মনে প্রাণে চাইব, আর্জেন্তিনা ম্যাচ জিতুক, আর টমাস মুলারও গোল করুক। কারণ হাজার হোক টমাসের সঙ্গে আমাদের প্রিয় শহরটার যোগ রয়েছে যে!

(লেখক প্রাক্তন পুরমন্ত্রী। অনুলিখন: অনির্বাণ রায়)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

fifaworldcup ashok bhattacharya muller
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE