Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

নেইমারের নামে জয়ধ্বনির মধ্যে মেসির পদধ্বনি

ইউচি নিশিমুরার চেয়ে হাতে বেশি সময় পাবেন! কিন্তু রিও দে জেনেইরোর আন্তর্দেশীয় টার্মিনাল থেকে বার হয়ে মোটর রাস্তায় পড়া মাত্র আপনাকেও তড়িঘড়ি সাংঘাতিক একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে হবে! সামনে স্বর্গের দু’টো রাস্তা! কোনটায় যাবেন? বাঁ দিকে স্বর্গ লেন ওয়ান— কোপাকাবানা বিচ। ডান দিকে স্বর্গ লেন টু— মারাকানা স্টেডিয়াম! ব্রাজিলীয় ট্যাক্সি ড্রাইভার জানতে চাইছেন, কোন দিকটায় যাব? আরোহী খানিক কিংকতর্ব্যবিমূঢ় দেখে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললেন, “কোপাকাবানায় সারা রাত পার্টির পর সবাই টায়ার্ড। মারাকানায় যান এখন।”

প্রথম জয়ের নায়ক। বৃহস্পতিবার ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে গোলের পরে নেইমার। ছবি: উৎপল সরকার।

প্রথম জয়ের নায়ক। বৃহস্পতিবার ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে গোলের পরে নেইমার। ছবি: উৎপল সরকার।

গৌতম ভট্টাচার্য
রিও দে জেনেইরো শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৪ ০৩:৪০
Share: Save:

ইউচি নিশিমুরার চেয়ে হাতে বেশি সময় পাবেন! কিন্তু রিও দে জেনেইরোর আন্তর্দেশীয় টার্মিনাল থেকে বার হয়ে মোটর রাস্তায় পড়া মাত্র আপনাকেও তড়িঘড়ি সাংঘাতিক একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে হবে!

সামনে স্বর্গের দু’টো রাস্তা! কোনটায় যাবেন? বাঁ দিকে স্বর্গ লেন ওয়ান— কোপাকাবানা বিচ। ডান দিকে স্বর্গ লেন টু— মারাকানা স্টেডিয়াম!

ব্রাজিলীয় ট্যাক্সি ড্রাইভার জানতে চাইছেন, কোন দিকটায় যাব? আরোহী খানিক কিংকতর্ব্যবিমূঢ় দেখে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললেন, “কোপাকাবানায় সারা রাত পার্টির পর সবাই টায়ার্ড। মারাকানায় যান এখন।” এমনিতে ব্রাজিলে ভাঙা ভাঙা ইংরেজি জানা ট্যাক্সিচালক পেয়ে যাওয়াটা মমতা-বিমান সৌহার্দ্যপূর্ণ বৈঠকের চেয়ে সামান্য কম বিস্ময়কর। কিন্তু এই শুক্কুরবার সকালে ব্রাজিল জুড়ে তো নানান বিস্ময়কর ঘটনা ঘটছে।

কাল গভীর রাতে স্টেডিয়াম থেকে ফেরার সময় দেখছিলাম পানশালা আর নাইটক্লাবের বাইরে কী জমজমাট পার্টি চলছে! হলুদে-হলুদে ছয়লাপ চার দিক। চিৎকার-চেঁচামেচি, হাসাহাসি সব বড় বড় মোড়ে। কিন্তু বিষ্যুদবার তো পাশ্চাত্যে নাইটক্লাবে এত লোক যায় না। উইকএন্ড শুরু আজ থেকে। তা ছাড়া এই যে শুনেছিলাম, ব্রাজিলের বিচ্ছুদের ভয়ে শনি-রোববার ছাড়া স্থানীয় লোকও বেশি রাত করেন না। তা হলে কি বিচ্ছুগুলোও নেইমার দ্য সিলভাকে উদ্যাপন করছে নাকি?

ভোরে সাও পাওলো বিমানবন্দরে লাগেজ চেক-ইনের সময় বিস্ফারিত লাগল দেখে, চার দিকে শুধু হলুদ জার্সি। এরা কি মাঠের ড্রেসেই চলে এল? নাকি দু’টো করে সেট এনেছিল? আমাদের দেশে বিশ্বকাপ ফাইনালের দিনও এত লোক অন্তত ভারতীয় জার্সি পরে প্লেনে চলাফেরা করে না। যাক গে, যাক। ব্রাজিলীয় জনজীবনের হাবভাব দেখে এটুকু বোঝা যাচ্ছে, তাদের গত এক বছরের যাবতীয় কাপজনিত বিদ্বেষ আর ঘৃণায় পেনকিলারের কাজ করেছেন নেইমার দ্য সিলভা। সিএনএনে দেখলাম ব্রাজিলীয় সমাজবিজ্ঞানী বাইট দিচ্ছেন, “এই একটা ম্যাচের ফিলগুড ফ্যাক্টর থেকে কোনও সিদ্ধান্তে আসা উচিত হবে না। জনগণের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখনও ক্ষোভ রয়েছে।”

সমাজবিজ্ঞানীটি কাল এরিনা দে সাও পাওলোয় মনে হল না ছিলেন বলে। বা আজ কাকভোরে রিও-র প্লেন ধরতেও বেরোননি। আম ব্রাজিলীয় সমর্থককে উদ্বোধনী ম্যাচের জয়ে যেমন খুশিয়াল দেখছি, এই লোকগুলো এত তাড়াতাড়ি আবার ঘুরে যাবে বলে মনে হয় না। পরে রিওয় বসে শুনলাম, ট্যাক্সিচালক তো ঠিকই বলেছেন। সত্যিই কাল রাতভোর পার্টি হয়েছে কোপাকাবানা বিচে। সাম্বা, পানীয় আর মস্তির টান এমনই ভরপুর ছিল যে, স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ওখানে রাতভোর প্রতিনিধি রেখে দিয়েছিল। অনেকে বলছেন, এক গোলে পিছিয়ে পরে তিন গোল দেওয়ার ব্যাপারটা জয়ে বাড়তি হলুদ রং যোগ করে দিয়েছে। গোটা ব্রাজিলও যেন এক রাত্তিরেই তার হাসি মুখ ফেরত পেয়েছে।

মারাকানায় ঢুকতে গিয়ে দেখি, গেটের সামনে বেশ জটলা। ফটোগ্রাফাররা লাইন করে দাঁড়িয়ে। এক দল সমর্থক নাচছে-গাইছে, চেঁচাচ্ছে। এদের গায়ে অবশ্য হলুদ জার্সি নেই। এদের হাতে বিশ্বকাপের রেপ্লিকা। ঠিক এক মাস বাদে এই দিন মারাকানায় বিশ্বকাপ ফাইনাল। এরা চেঁচাচ্ছে, ওই দিন এ ভাবেই আমাদের টিম ট্রফি নিয়ে পোজ দেবে।

ব্রাজিল তবু হলুদ পরেনি কেন? কারণ এরা ব্রাজিল নয়। আর্জেন্তিনা বলে! এক দঙ্গল আর্জেন্তিনীয় সমর্থক বুয়েনস আইরেস থেকে রিওয় উড়ে এসেছেন রোববার বিশ্বকাপ জয়ের অভিযান শুরুর সাক্ষী থাকতে। ফুটবলের এমনই অমোঘ রূপটান যে, একই শহরে, একই সঙ্গে হলুদ আর নীল রং নিয়ে সম-উত্তেজনার আকুতি, উচ্ছ্বাস আর উচ্চাকাঙ্খা! এক দিকে যখন ব্রাজিলের আর পাঁচটা শহরের মতোই রিও নেইমারকে নিয়ে জয়ধ্বনির কোরাসে, আবার সেই শহরেরই মঞ্চে অদৃশ্য সাউন্ড টেস্টিং চলছে বিশ্বফুটবলের মহানায়কের জন্য। লিওনেল মেসির পদধ্বনি যে এ বার ব্রাজিল বিশ্বকাপ এবং মারাকানায়!

মেসি আর নেইমারের তফাতটাও আর্জেন্তিনা সমর্থকদের ভিড়টা খুব সহজ করে বুঝিয়ে দিচ্ছে। কী, না নেইমার হল নেইমার + রেফারি। মেসি মানে একা মেসি!

ব্রাজিলীয়রা আবার কাল রাত্তির থেকে বলা শুরু করেছে, এখনকার ফর্ম অনুযায়ী আগে নেইমার, পরে মেসি। এমনিতে বেলো হরাইজন্তেতে আর্জেন্তিনা অনুশীলন করার সময়ে যা-ই ঘটে থাক, গড়পড়তা ব্রাজিল সমর্থক পছন্দই করেন মেসিকে। আজ থেকে তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে যখন ক্লাব ফুটবলের এমন রমরমা হয়নি, যখন দেশই সর্বোত্তম ছিল, তখন মেসির ব্রাজিলে আসাটা হয়তো বর্গি এল দেশের মতো দেখা হত! এখন একেবারেই নয়। বার্সার এ দেশেও অজস্র ফ্যান। এ দিন দেখছিলাম সাও পাওলো আর রিও— দু’টো বিমানবন্দরের ক্লোজড সার্কিট টিভিতেই বারবার করে মেসির মুখ ফুটে উঠছে। পরে জানা গেল, এগুলো মেসির বিশেষ বিশ্বকাপ বিজ্ঞাপন। পেলেই যদি সাঁইত্রিশ বছর জনতার সামনে বলে লাথি না মেরে শুধু এই বিশ্বকাপের বিজ্ঞাপন থেকে আঠারো কোটি টাকা রোজগার করতে পারেন, তা হলে মেসির কত আয় হতে পারে?

আন্দাজ করার ব্যর্থ চেষ্টায় না গিয়ে বরং ভাবছি, এশীয় র্যাঙ্কিংয়ে সবার আগে থাকা ইরান কি মেসির ক্রোয়েশিয়া হতে পারে?

মারাকানা স্টেডিয়ামের সামনে বিশ্বকাপের রেপ্লিকা হাতে আর্জেন্তিনার সমর্থকরা। ছবি: গৌতম ভট্টাচার্য।

সাও পাওলো মাঠে কাল ক্রোয়েশিয়া জিততে না পারুক, ব্রাজিলীয় ডিফেন্স সম্পর্কে প্রাক্-টুর্নামেন্ট মিথটাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। ভাবা হচ্ছিল থিয়াগো সিলভা, দানি আলভেজ আর চেলসির দাভিদ লুইজকে নিয়ে গড়া ডিফেন্স হল দানধ্যানে ফিফার মতোই কৃপণ। জার্নালিস্টদের জন্য ফিফা যেমন জলটাও দেড়শো টাকায় বিক্রি করছে, এরাও তেমন প্রতিপক্ষকে ফাঁকা জমি ফ্রি-তে দেওয়ায় বিশ্বাসী নয়। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এই প্রথম ব্রাজিলীয় ডিফেন্স সম্পর্কে এমন সম্ভ্রমের ঢক্কানিনাদ চলছিল, যেন ডিফেন্সের সামনে ১৪৪ ধারা জারি থাকবে! অথচ গোল হওয়ার পর থেকে স্কোলারিকে প্রায় টানা দাঁড়িয়ে থাকতে হল। কলকাতায় টিভিতে বসা ব্রাজিলীয় ফ্যানদের দেখার উপায় ছিল না। টিভি বল দেখায়। বলের বাইরের মুহূর্ত কদাচিৎ। স্কোলারি বারবার গালাগাল দিয়ে গেলেন, মাঝখানে লোক আনো। ক্রোটরা হু হু করে ঢুকে যাচ্ছে এবং ঠিক মাঝমাঠে কোনও ব্লকারের খোঁজ নেই। ব্রাজিলীয় কোচ বলেছিলেন, তাঁর টিম খেলা ধরবে ঘণ্টায় একশো মাইল গতিতে। কিন্তু প্রতিআক্রমণ ঘণ্টায় সম গতিতে হলে? বৃহস্পতিবার রাতের সাও পাওলো জবাব পায়নি।

টিভি ক্যামেরা আরও একটা জিনিস অবশ্যই দেখাতে পারেনি যে, নেইমার গোটা ম্যাচে কতটা দৌড়েছেন! এক-এক সময় এতটাই নীচে নেমে ট্যাকল করছিলেন, যে বাড়তি কষ্টটা মহাতারকা স্ট্রাইকার বেশির ভাগ সময়ই করার জন্য তৈরি থাকে না। আগের দিন প্রেস কনফারেন্সে কয়েক হাত দূর থেকে দেখা। কাল ব্রাজিলের টিম ম্যানেজমেন্টের তরফে খেলার আগে ফিফার বুলেটিনে কার্লোস আলবার্তো পাহিরার ইন্টারভিউটাও পড়ছিলাম যে, নেইমার জীবনের প্রথম কাপে নিজেকে এত ঠান্ডা রাখতে পারছে মানে ও টপ পারফরম্যান্স দেবে। এরিনা সাও পাওলোয় বসে বারবার তা-ই মনে হল।

লালকার্ড দেখা থেকে বেঁচে গেলেন স্বয়ং রেফারি নার্ভের বলি হয়ে যাওয়ায়। কিন্তু বিশ্বকাপের উদ্বোধনীতেই যা খেলেছেন, সন্ত্রাসের লাল অ্যালার্ট তাঁর পরবর্তী ডিফেন্ডারদের মধ্যে জারি করার পক্ষে যথেষ্ট। মেসির মতোই মার খাওয়ার ললাটলিখন নিয়ে চলতি বিশ্বকাপে এসেছেন নেইমার। দেখে মনে হচ্ছে, দেশের হয়ে সত্যিই কাপ জিততে চান এবং বার্সায় আবার ফেরার দিন কবে, সেই ভাবনাটা আপাতত অতলান্তিকে উড়িয়ে দিয়েছেন। এখন শয়নে স্বপনে শুধুই দেশ আর বিশ্বকাপ। অনেক সময় কমবয়সী মহাতারকাকে নিয়ে দলের সিনিয়ররা বিপন্নতায় ভোগে। শোনা কথা যে, ব্রাজিল টিমে সে সব নেই। নেইমার ও টিমের বাকিদের মাঠে শরীরী ভাষা আদানপ্রদান দেখে আরও নিশ্চিত হওয়া গেল, সত্যিই নেই। বিশ্বকাপ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মতোই যে নেইমার দ্য সিলভারও আনুষ্ঠানিক উন্মোচন ঘটল বিশ্ব ফুটবলের রাজ-বংশধর হিসেবে, তাতে টিমের সিনিয়রদেরও গৌরবান্বিত দেখাল।

কোথাও যদিও মনে হচ্ছে, নেইমার আর জাপানি রেফারি নিয়ে কলরবে ব্রাজিল তার আসল নায়ককেই জয়ের মুহূর্তে ভুলে গেল! যে ভাবে ভারতীয় ক্রিকেট টিম নিয়মিত ভুলেছে রাহুল দ্রাবিড়কে।

তিনি জুলিও সিজার। ব্রাজিলের গোলকিপার। একটা সময় ব্রাজিলে প্রচলিত কথা ছিল যে, এ দেশের বিশেষত্ব হল বিয়ে টেকে না আর গোলকিপার লাগে না! কাব্যে বরাবরের উপেক্ষিত সেই গোলকিপারই কিন্তু কাল ব্রাজিলকে উতরে দিয়েছে। নেইমারের প্রথম গোলের ঠিক আগের মুহূর্তেই নিশ্চিত গোলমুখী জোরালো হেড বাঁচান সিজার। ওটা গোল হলে তখনই ০-২ হয়ে যায়। নেইমার ১-১ করার পরেও ক্রোটরা দূরপাল্লার দুর্দান্ত গড়ানো শট নিয়েছিল। বাঁ দিকে শরীর ফেলে অত্যাশ্চর্য সেভ করেন টরন্টো এফসি-তে খেলা জুলিও। ঠিক পরের মিনিটেই ব্রাজিলের প্রতিআক্রমণ এবং মহাবিতর্কিত পেনাল্টি।

বলা হচ্ছে, ব্রাজিলীয় ডিফেন্ডারের আত্মঘাতী গোল করার ঘটনা বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথম ঘটল। কিন্তু ব্রাজিলীয় গোলকিপার তিনটে অব্যর্থ গোল বাঁচিয়ে টিমকে জেতাচ্ছে, এটাই বা টাইব্রেকার ছাড়া কবে, কোন ইতিহাসে ঘটেছে? কোপাকাবানার বিচ ফুটবলেও কেউ দেখেনি!

মহাব্যতিক্রমী রাতের ব্যতিক্রমী উৎসবপালন— এ ভাবে ভাবলে মারাকানার বাইরে ট্রফি নিয়ে আর্জেন্তিনা সমর্থকদের আগাম ছবি তোলাতুলিরও ব্যাখ্যা হয়। কী, না বিশ্বকাপ বাজারে সব কিছুর ব্যাখ্যা খুঁজতে নেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE