Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ব্যতিক্রমী ম্যাচেও বহাল ধর্মযুদ্ধের গনগনে আঁচ

আর্থার কনান ডয়েলের গোয়েন্দা গল্পে যেমন ইনস্পেক্টর লেস্ট্রেড। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের যেমন ভুঁড়িওয়ালা ইনস্পেক্টর সুন্দরবাবু। ভারত-পাক ব্লকবাস্টার ম্যাচে তেমনই আইসিসি গোয়েন্দারা! যারা অপরাধী ধরার সবিস্তার তোড়জোড় করেও কিছুই করতে পারে না। কাউকে বিস্মিত না করে আজ পর্যন্ত যাদের দুর্নীতিদমন শাখার জালে এক জন ক্রিকেটারও পড়েনি। কোনও বুকিও না। শেষ দৃশ্যে যখন হয় মিডিয়া বা দিল্লি পুলিশ-জাতীয় নেটওয়ার্কের জালে অপরাধী ধরা পড়ে, তখন এরা উজ্জ্বলতম ভাঁড়ের চেহারায় দেখা দেয়!

গৌতম ভট্টাচার্য
ঢাকা শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৪ ০৩:০০
Share: Save:

আর্থার কনান ডয়েলের গোয়েন্দা গল্পে যেমন ইনস্পেক্টর লেস্ট্রেড। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের যেমন ভুঁড়িওয়ালা ইনস্পেক্টর সুন্দরবাবু। ভারত-পাক ব্লকবাস্টার ম্যাচে তেমনই আইসিসি গোয়েন্দারা!

যারা অপরাধী ধরার সবিস্তার তোড়জোড় করেও কিছুই করতে পারে না। কাউকে বিস্মিত না করে আজ পর্যন্ত যাদের দুর্নীতিদমন শাখার জালে এক জন ক্রিকেটারও পড়েনি। কোনও বুকিও না। শেষ দৃশ্যে যখন হয় মিডিয়া বা দিল্লি পুলিশ-জাতীয় নেটওয়ার্কের জালে অপরাধী ধরা পড়ে, তখন এরা উজ্জ্বলতম ভাঁড়ের চেহারায় দেখা দেয়!

বিষ্যুদবার ঢাকায় ভারত-পাক ম্যাচের আগে যেমন গোয়েন্দাদের সর্বাত্মক তৎপর দেখা গেল। প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে কাল রাত্তির থেকে লবি এবং ডাইনিং রুমের কোনায় কোনায় এরা সাদা পোশাকের চর বসিয়ে রেখেছে। প্লেয়ারের ঘরে ফোন গেলে সরাসরি দেওয়া হচ্ছে না। তাঁকে। প্রথম স্ক্রিনিং করছেন গোয়েন্দারা। তার পর টিমের সিকিউরিটি।

ভারত-পাক সাক্ষাৎ পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক, কোটি কোটি টাকার বেটিং তাকে ঘিরে ঘটবে খুব সহজবোধ্য। প্লেয়ারদের টোপ দেওয়ার চেষ্টা হবে, সেটাও স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু কোন অপরাধী এত আহাম্মক যে, সে পায়ে হেঁটে প্লেয়ারদের ঘরে যাবে বা প্লেয়ারের ঘরে ল্যান্ডলাইনে ফোন করে স্পট ফিক্সিংয়ের ছক কষবে!

ক্রিকেট বেটিং রহস্য ভেদ করার জন্য চাই স্মার্টনেস আর উন্নততর প্রযুক্তি। শুক্রবারের ভারত-পাক ম্যাচ জিততে ঠিক যা দরকার।

অসম্ভব স্নায়ুযুদ্ধের মধ্যে কার মগজাস্ত্র লক্ষ্যে কত অভ্রান্ত থাকে, ঐতিহাসিক ভাবে তারই পরীক্ষা নিয়ে এসেছে এই ম্যাচ। অন্য বার যেমন ভারত-পাক ম্যাচ ঘিরে বাতাসে গনগনে ডেসিবেল থাকে, পদ্মাপারে সেটা অদৃশ্য। যার সম্ভাব্য কারণ, বাংলাদেশ নিজেরাই এখন ক্রিকেটে একটা শক্তি। এখানকার মানুষও সেই জঙ্গি ক্রিকেট-জাতীয়তাবোধে এত আচ্ছন্ন যে, ভারত-পাক ঘিরে স্থানীয় আবেগের ঢেউ মুম্বইয়ের সমুদ্রের মতো। পাড়ে প্রায় পৌঁছোচ্ছে না।

বাংলাদেশের জনপ্রিয় কাগজ ‘প্রথম আলো’ বৃহস্পতিবার প্রথম পাতায় বাংলাদেশ ম্যাচের প্রিভিউতে হেডলাইন দিয়েছে, ‘আজ উড়ে যাওয়ার পালা হংকংয়ের’। ক্রিকেট জগতে ভাবাই যায় না এমন শিরোনাম। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সামনে চায়ের দোকানের কর্মী থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক— সবাই জাতীয় ক্রিকেট-মাদকতায় তীব্র ভাবে আচ্ছন্ন। এমনকী বাংলাদেশের বিশিষ্ট জনেরাও। প্রতিবেশীদের মহাসংঘর্ষ চরম লোভনীয়, কিন্তু সর্বাগ্রে যে নিজের টিম! বরঞ্চ আবহ যেটুকু তৈরি আছে, তার পেছনে অগুনতি ক্রিকেট-পর্যটক। ভারত-সহ ঢাকার বাইরে থেকে অনেকে উড়ে আসছেন ম্যাচটা দেখতে। বাংলাদেশিরা সেই আবহের মধ্যেও বেশি আচ্ছন্ন হংকং ম্যাচ হেরেও সুপার টেনে পৌঁছে যাওয়ায়। বাংলাদেশের এক নম্বর নায়িকা অপু চৌধুরী এখানে একটু বেশিই আলোচিত, যে ভাবে হিন্দু নারী হয়েও অবিসংবাদী শিরোপা এত বছর ধরে রেখেছেন। তা অপু এ দিন এবিপি-কে বললেন, “আমি সৌরভ-সচিনের পাগল ফ্যান। কিন্তু এখন তো ওরা নেই। এখন উজাড় করে সমর্থন করি মুশফিকুরকে। আমার মতো ও-ও বগুড়ার। তা ছাড়া আমার দেশের অধিনায়ক।”

পদ্মাপারে এ বারের ভারত-পাক সাক্ষাতের মেজাজটা আসলে ব্যতিক্রমী। আবহে পরিচিত উত্তাপ নেই, অথচ প্লেয়ারদের পারস্পরিক মনোভাবে আছে। এ দিন মীরপুর মাঠ থেকে বেরোবার সময় দেখা হয়ে গেল যুবরাজ সিংহ আর মইন খানের। খুব উষ্ণ শরীরী ভাষা। ফটোগ্রাফাররা দিনের ছবি পেয়ে গেলেন। কিন্তু আদৌ ওটা ভেতরকার ছবি নয়। বরং দোসরা মার্চের শেষ সংঘর্ষের রেশ এখনও চলছে। পাকিস্তানের বিরাট ক্ষোভ বিরাট কোহলিকে নিয়ে।

আফ্রিদির জয়সূচক ছক্কার পর যখন পাক ডাগআউট থেকে উচ্ছ্বসিত প্লেয়াররা আফ্রিদির দিকে দৌড়োচ্ছেন, কোহলি নাকি তাঁদের কাউকে কাউকে গালাগাল করেন। শুক্রবার ব্যাট করতে নামার সময় স্টাম্প মাইক্রোফোনে পা চেপে যদি রঙিন কিছু উর্দু শব্দ আশপাশ থেকে কোহলির দিকে ধেয়ে আসে, তা হলে আশ্চর্য হওয়ার নেই। শুনলাম, পাক শিবির সকালে পুল সেশন করার ফাঁকে এই রকমও আলোচনা করেছে যে, ধোনি ফিরেছে বাঁচোয়া। ও হল জেনুইন ভদ্রলোক।

ভারতের আবার পাল্টা ক্ষোভ, স্রেফ ভাগ্যের মারে সে দিন আফ্রিদি ও পাকিস্তান একদিনের সুলতান বনে গিয়েছিল। রবিচন্দ্রন অশ্বিন ছিলেন সে দিনের চেতন শর্মা। আফ্রিদির দু’ছক্কায় বিদ্ধ তিনি আজও যথেষ্ট কাতর, এমন কোনও ইঙ্গিত দু’টো ওয়ার্ম-আপ ম্যাচেই অশ্বিনের বোলিংয়ে পাওয়া যায়নি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ফুঁসছেন। ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, “দু’টোই মিসহিট ছিল। দু’টোতেই ওর আউট হওয়ার কথা। ফাঁকতালে বেরিয়ে গেল।” কোহলির সে দিনের টিমের তীব্র বিশ্বাস, সাইড বাউন্ডারিগুলো এশিয়া কাপে মাত্র ৬৩ মিটার না হয়ে যদি ফুল সাইজ হত, আফ্রিদি আউট হয়ে যেতেন। ভারতও ম্যাচটা জিতে যায়। আবার এই আলোচনার কথা জেনে কুয়ালা লামপুর থেকে এশিয়া কাপ সংগঠনের মহাসচিব আশরাফুল হক প্রতিবাদ করে বললেন, “এই কথাটা কেন রটছে জানি না। আমরা যেহেতু টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য মেন পিচ পাইনি, তাই সাইড উইকেটে খেলা করতে হয়েছিল। তাতে এক দিকের সাইড বাউন্ডারির দূরত্ব যদি কমে থাকে, আর এক দিকের তো বেড়েছিল।”

মজার কথা, অশ্বিনের টিম ইন্ডিয়া যখন মীরপুরে আঠারো দিন আগের হারাটাই রেফারেন্স পয়েন্ট ধরে বদলার জন্য আরও তেতে থাকছে, তখন তিনি— পাকিস্তানের আফ্রিদি দলকে প্রাণপণ বোঝাবার চেষ্টা করছেন, আগের ম্যাচটা থেকে মানসিক ভাবে বেরোও। নইলে নতুন যুদ্ধ জিততে পারবে না। পাকিস্তান টিম তত বেশি করে তাঁর শরণ নিচ্ছে, “শাহিদভাই তুমি আর সাত নম্বর নও। লম্বা পার্টনারশিপ যখনই শেষ হবে তখনই তুমি নামবে। তুমি হলে আমাদের সুইসাইড বম্বার। উড়িয়ে দেবে ভারতকে।”

দলগত ভাবে ধোনির টিমকে আরও ভারসাম্যপূর্ণ মনে হচ্ছে। পেস বোলিংয়ে ব্যথা থেকেও সামগ্রিক শক্তিতে ভারত এগিয়ে। যদি না মাঠের বাইরে থেকে ভেসে আসা আইপিএল ফিক্সিং জাতীয় বিতর্কের রেশ তাদের পেড়ে ফেলে, এই পাকিস্তানকে সমীহ করার কিছু নেই। এর চেয়ে অনেক শক্তিশালী হতে যাচ্ছে পরের দুই প্রতিদ্বন্দ্বীওয়েস্ট ইন্ডিজ আর অস্ট্রেলিয়া।

ভারতের যা ব্যাটিং লাইন আপ, তাতে গ্রুপে চার প্রতিদ্বন্দ্বীর বরং সেই দুশ্চিন্তায় চোক্ করার কথা। কোহলি, রায়না, ধোনি, যুবরাজ এবং ধবন। এক একজন ম্যাচ উইনার। এর মধ্যে রায়না আবার সম্প্রতি সৌরভের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। এ দিন সোনারগাঁও হোটেলে বসে সৌরভ বলছিলেন, টি-টোয়েন্টিতে রায়নার বিশেষ কিছু বদলের দরকার নেই। কিন্তু টেস্ট বা ওয়ান ডে-তে রায়নার ব্যাটিং স্ট্র্যাটেজিতে সূক্ষ্ম কিছু বদল তিনি আনতে চান। যেমন পুল সব সময় না করে শর্ট বল ছেড়ে দেওয়াই ভাল। পরবর্তী ক্র্যাশ কোর্সের দিন নাকি রায়নাকে সেগুলো বোঝাবেন।

রায়না হলেন ধোনির এক নম্বর বন্ধু। সিএসকে-র অঘোষিত ভাইস ক্যাপ্টেন। তামিলনাড়ু লবির মহানক্ষত্র। সৌরভের কাছে তাঁর প্রকাশ্যে টিপস চাইতে যাওয়াটা অধীর চৌধুরীর কাছে দেবের নির্বাচনী আশীর্বাদ নিতে যাওয়ার মতোই অলীক!

টিম ইন্ডিয়া চাইবে মীরপুরে এমন আজব কিছু যেন না ঘটে। স্বাভাবিক ক্রিকেটীয় নিয়মে আফ্রিদির ছক্কাগুলো যে এ বার লাইনের ধারে ধরা পড়ার কথা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE