Advertisement
০১ মে ২০২৪

রোমাঞ্চ নিয়ে ধোনি কোহলিদের অপেক্ষায় বাংলাদেশ

বুধবার থেকে শুরু হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ টেস্ট ম্যাচ। কেমন হবে সেই ম্যাচের ইতিবৃত্ত? তা জানাতে শুধুমাত্র আনন্দবাজার ওয়েবসাইটের জন্য কলম ধরলেন বাংলাদেশের প্রথম আলো সংবাদপত্রের ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্র।বুধবার থেকে শুরু হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ টেস্ট ম্যাচ। কেমন হবে সেই ম্যাচের ইতিবৃত্ত? তা জানাতে শুধুমাত্র আনন্দবাজার ওয়েবসাইটের জন্য কলম ধরলেন বাংলাদেশের প্রথম আলো সংবাদপত্রের ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্র।

বাংলাদেশ সফরের আগে অধিনায়কের সঙ্গে অণুশীলনে ব্যস্ত দল। ছবি: পিটিআই।

বাংলাদেশ সফরের আগে অধিনায়কের সঙ্গে অণুশীলনে ব্যস্ত দল। ছবি: পিটিআই।

ঢাকা শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৫ ২২:০১
Share: Save:

ঢাকায় রাস্তায় পাশাপাশি উড়ছে লাল সবুজ আর তেরঙ্গা পতাকা। সারা শহরেই, তবে বিমানবন্দর থেকে হোটেল সোনারগাঁওয়ের রাস্তায় একটু বেশি। আকাশে-বাতাসে বাজছে প্রতিবেশী দুই দেশের মৈত্রীর সুর। বাংলাদেশে-ভারত ক্রিকেট দ্বৈরথের আদর্শ আবহই বলতে হবে। সোমবার সকালে বিরাট কোহলির দল ওই পথ দিয়েই বিমানবন্দর থেকে হোটেলে এসে উঠবেন। পতাকার ওই সারি তখনও থাকবে তো?

থকলে ভালই হয়। যদিও ঢাকার ওই সজ্জা দুই দেশের ক্রিকেট সিরিজের জন্য নয়। সেটির উপলক্ষ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দু’দিনের বাংলাদেশ সফর। আর কোনও রাষ্ট্রপ্রধানের সফর ঘিরে বাংলাদেশ এমন আলোড়িত হয়নি। মহা আলোচিত এবং বহুল প্রতীক্ষিত সেই সফরের শেষের সঙ্গে ভারতীয় ক্রিকেট দলের সফরের শুরুটা এমনভাবে মিশে গিয়েছে যে, কারোও মনে হতে পারে দুই দেশের মৈত্রীর বন্ধনকে উদযাপন করতেই বোধ হয় আয়োজন এই ক্রিকেট সিরিজের।

মৈত্রী! মৈত্রী! এই সুরটা সব সময়ই বেজেছে অনুচ্চারে। একাত্তরের মুক্তি যুদ্ধই দুই দেশকে বেঁধে দিয়েছে অচ্ছেদ্য এক মৈত্রীর বন্ধনে। ঢাকা থেকে কলকাতায় যে ট্রেনটা যায়, সেটির নাম দিতে গিয়ে যেমন একটুও ভাবতে হয়নি। খুব সহজেই মাথায় চলে এসেছে নামটা- মৈত্রী এক্সপ্রেস। তবে আলাদা করে ক্রিকেটের কথা বললে সাড়ে তিন মাস আগে মেলবোর্নের এক রাত এই ‘মৈত্রী’ ব্যাপারটিকে কঠিন এক হুমকির মুখেই ফেলে দিয়েছিল। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে বিরাট কোহলিকে ফিরিয়ে দিয়ে রুবেল হোসেনের বুনো উল্লাসের ওই ছবিটিই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছিল দুই দেশের ক্রিকেট সম্পর্কের প্রতীকি চিত্র। ইয়ান গোল্ড ও আলিম দারের ডাকা এই রুবেলেরই একটি ‘নো’ বল তিক্ততার বিষ ছড়িয়ে দিয়েছিল আকাশে বাতাসে।

বডিলাইন সিরিজ ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্কেও ছায়া ফেলেছিল। ট্রেভর চ্যাপেলের আন্ডারআর্ম বোলিং অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের। এই দু’টির সঙ্গে তুলনাটা হয়তো একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। তবে মেলবোর্নের ওই ম্যাচ নিয়ে যা হয়েছে, সেটির তুলনাও ক্রিকেট ইতিহাসে খুব বেশি নেই। ফেসবুক-টুইটারের এই যুগে কোনও কিছু নিয়ে ঝড় উঠতে বেশি সময় লাগে না। আর সেটি ছিল বিশ্বকাপ। দুর্দান্ত খেলে মাশরাফির দল কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার পর পুরো বাংলাদেশ তখন স্বপ্ন-রঙিন। এমনিতে হারলেও শোকের আবহ থাকত। বিতর্কিত আম্পায়ারিং শোকের বদলে ক্ষোভে উত্তাল করে তুলেছিল পুরো দেশকে।

আর ভারত-বাংলাদেশ মুখোমুখি হওয়ার আগে অবধারিত ভাবেই ফিরে ফিরে আসছে বিশ্বকাপের ওই ম্যাচ। তবে অবশ্যই সে সময়ের তীব্র প্রতিক্রিয়া সমেত নয়। সময়ের প্রলেপ অবশ্যই একটা কারণ। এর চেয়েও বড় কারণ সম্ভবত ভারতীয় ক্রিকেটে শ্রীনিরাজ শেষ হয়ে জগমোহন ডালমিয়ার ফিনিক্সের মতো পুণরুত্থান। ডালমিয়া বাংলাদেশের ক্রিকেটের পুরনো বন্ধু। বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়াতেও তখনকার আইসিসি প্রেসিডেন্টের বিশ্বায়ন মন্ত্রের বড় ভূমিকা। গত কয়েক মাসের দূতিয়ালীতে দুই দেশের ক্রিকেট সম্পর্ক তাই অনেকটাই আগের জায়গায়।

বছর ১৫ আগে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু এই ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়েই। প্রথম তো প্রথমই— ওই টেস্ট তাই কখনও ভুলবে না। ভারতেরও মনে রাখা উচিত। ভারতীয় ক্রিকেটে রেনেসাঁর নায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেস্ট অধিনায়কত্বে অভিষেকও যে ওই ম্যাচেই।

এটিকেও ঘটনাচক্রই বলতে হবে, প্রায় ১৫ বছর ব্যবধানে বাংলাদেশ আরেকটি ওয়ান-অফ টেস্ট দেখছে, যেটির প্রতিপক্ষও সেই ভারত।

ভারতের বিপক্ষে সিরিজ মানেই বাণিজ্যে লক্ষ্মী। ভরা বর্ষার মরসুমে কোহলি-ধোনিদের পেয়েও ক্রিকেট বোর্ড তাই মহা খুশি। সাকিব-মাশরাফিরাও যথেষ্টই রোমাঞ্চিত। গত নভেম্বরে জিম্বাবুয়ে সিরিজ দিয়ে শুরু করে বিশ্বকাপ-পাকিস্তান সিরিজ-বাংলাদেশ দল যেন যাচ্ছে এক স্বপ্ন যাত্রার মধ্য দিয়ে। ভারতের বিপক্ষে সিরিজটিকে সেই স্বপ্ন যাত্রায় আরেকটি ধাপ মনে করার সাহসও জোগাচ্ছে সাম্প্রতিক ওই সাফল্য। সবচেয়ে বেশি বোধ হয় পাকিস্তানের বিপক্ষে একটি টেস্ট ড্র করার আগে ওয়ানডে সিরিজে ৩-০ জেতার টাটকা সুখ স্মৃতি। ৩-০ মানে হোয়াইট ওয়াশ, যার বাংলাদেশি রূপ—বাংলা ওয়াশ!

বাংলাদেশের ক্রিকেট অভিধানে এই ‘বাংলা ওয়াশ’ কথাটা অনির্বচনীয় এক সুখানুভবের নাম। যেটির জন্ম ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডকে ওয়ানডে সিরিজে ৪-০ হারানোর মাধ্যমে। ‘যুগান্তকারী’ শব্দটা অনেক সময়ই অকারণে ব্যবহৃত হয়। তবে এই সিরিজটিকে বাংলাদেশের ক্রিকেটে যুগান্তকারী আখ্যা দেওয়ায় একটুও অতিশয়োক্তি নেই। অন্তত দেশের মাটিতে যে কোনও দলের জন্যই প্রবল এক প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠার সূচনা যে ওখানেই। তিন বছর পর নিউজিল্যান্ড এসে ফের ‘বাংলাওয়াশ’ হয়ে ফিরে গিয়েছে। মাঝখানে সিরিজ হেরেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে দর্শক বানিয়ে বাংলাদেশ খেলেছে এশিয়া কাপের ফাইনাল। জিম্বাবুয়েও স্বাদ নিয়ে গিয়েছে ৫-০ বাংলাওয়াশের। নির্ভেজাল সংখ্যার হিসেবে দেখলে নিউজিল্যান্ড বিপক্ষে ২০১০ সালের অক্টোবরের ওই সিরিজ থেকে দেশের মাটিতে খেলা ৫৩ টি ওয়ানডে বাংলাদেশের জয়ের পাল্লা ভারি (২৭ টি জয়, ২৫ টি পরাজয়)। টেস্টের বাংলাদেশ এখনও ওয়ানডে বাংলাদেশের মতো সমীহ জাগানো হয়ে উঠতে পারেনি। তাই বলে টেস্টের পারফরম্যান্সের গ্রাফেও একটু উর্ধ্বমুখী প্রবণতা কি নেই! জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নিরঙ্কুশ জয়কেও না হয় না-ই গুরুত্ব দিলেন। নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট ড্র করাটা তো এক সময় তিন দিনেই টেস্ট হারাটাকে নিয়ম বানিয়ে ফেলা দলের জন্য উন্নতির পথে বড় উল্লম্ফনই, তাই না?

তবে এই সাফল্যমুখর সময়েও ভারত হয়ে আছে একটা দুঃখের নাম। গত বছর এই জুনেই তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলতে ভারতের যে দলটি এসেছিল, সেটিকে ভারতের ‘এ’ দল বলাই ভাল। সেই দলের বিপক্ষেও হেরে ভূত হতে হয়েছে। এক ম্যাচে ভারতকে মাত্র ১০৫ রানে গুটিয়ে দিয়েও বাংলাদেশ অল আউট হয়ে গেছে ওয়ানডেতে নিজেদের সর্বনিম্ন ৫৮ রানে। সেই বাংলাদেশ আর এই বাংলাদেশ এক নয়। সে বার আত্মবিশ্বাস ছিল তলানিতে, এ বার তা তুঙ্গে। তবে সেই ভারত আর এই ভারতও তো এক নয়। সিনিয়র খেলোয়াড়েরা সব বিশ্রাম চাইছেন, এ বার হয়তো দ্বিতীয় সারির দলই—এই গু়ঞ্জন উড়িয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত আসছে ভারতের সেরা দলই। যেটি ঘোষণা হওয়া মাত্র স্বাগত জানিয়েছেন ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। জানানোরই কথা। ভারতের দ্বিতীয় দল এলে সেটি হত অবজ্ঞারই নামান্তর। সেরা দল পাঠানোটা তো বদলে যাওয়া বাংলাদেশকে এক ধরণের স্বীকৃতিই।

বিমানবন্দর থেকে হোটেলে আসার পথে কোহলিরা যাঁর ছবিতে অলঙ্কৃত অগণিত বিলবোর্ড দেখবেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা সেই সাকিব আল হাসানও উন্মুখ প্রতীক্ষায়। আইপিএলের কল্যাণে ভারতের সব খেলোয়াড়ই তাঁর চেনা, বন্ধুত্বও আছে অনেকের সঙ্গে। ভারতের বিপক্ষে খেলাটা তাই তাঁর একটু বাড়তি উপভোগ করারই কথা।

পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের আগে বাংলাদেশকে ফেভারিট ঘোষণা করে এই সাকিবই চমকে দিয়েছিলেন সবাইকে। কয়েক দিনের মধ্যেই যেটি আর চমক থাকেনি। পালাবদলের মধ্য দিয়ে যাওয়া পাকিস্তান আর তারকাখচিত ভারত অবশ্যই এক নয়। এ বার তাই নিজেদের ফেভারিট বলার প্রশ্নই ওঠে না। তবে বাংলাদেশ আর পড়ে পড়ে মার খাওয়ার দল নয়, এটি বলতে তো সাকিব আল হাসান হতে হয় না। ভারত যেন কষ্টিপাথর, বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাম্প্রতিক সুসময়টাকে যাচাই করে নেওয়ার একটা সুযোগ। শেষ পর্যন্ত মাঠের খেলায় কী হবে, এই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের হাতে তোলা। তবে একটা কথা এখনই বলে দেওয়া যায়, এমন রোমাঞ্চ নিয়ে আর কোনও সিরিজের জন্য অপেক্ষা করেনি বাংলাদেশ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bd
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE