হেরে হতাশ র্যান্টি। প্র্যাকটিসে চনমনে সনি।
ডেম্পো ১: (রোমিও)
ইস্টবেঙ্গল ০
কোনও টিমের রিজার্ভ বেঞ্চ কি সেই দলের ড্রেসিংরুম রসায়নের ছবিটা কেমন তা বুঝিয়ে দেয়? বোঝায় টিমের বোঝাপড়ার চেহারাটাও?
রোমিও, মান্দার, জুয়েল, লেনিদের তুলে আনা ঝড়ের মতো আক্রমণ যখন লাল-হলুদ রক্ষণমুখী হচ্ছে তখন আর্থার পাপাসের পুরো রিজার্ভ বেঞ্চ উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছিল।
আর ডুডু-র্যান্টিরা যখন দু’একবার পাল্টা আক্রমণে ওঠার চেষ্টা করছিলেন, তখন ইস্টবেঙ্গল বেঞ্চে এক জন ছাড়া কারও কোনও তাগিদ আছে মনে হচ্ছিল না। টিম কোচ আর্মান্দো কোলাসোকেই শুধু দেখা যাচ্ছিল চিৎকার করছেন। মাথা চাপড়াচ্ছেন। কখনও মাথায় হাত দিয়ে হতাশায় দাঁড়িয়ে থাকছেন।
কলকাতা লিগ জেতার পর প্রায় সাড়ে তিন মাস কোনও প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলেনি ইস্টবেঙ্গল। তার পর নেমে আর্মান্দোর টিম যা খেলল তাতে মনে হল হতাশ তিনিও। “টিমটার বোঝাপড়াটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সবাই ক্লান্ত। মেহতাব-লোবো তো মাঝমাঠে খেলতেই পারল না। ডিফেন্সের হালও খারাপ,” বলার সময় তাঁর মুখটা করুণ।
আপনার টিম তো আজ চার-পাঁচ গোল খেতে পারত? অন্য সময় হলে হয়তো পাল্টা কিছু বলতেন। “সবে তো একটা মাচ হল। অর্ণব-ডিকার চোট। জানি না পরে খেলতে পারবে কি না। কী আর করা যাবে, কোচ তো আর আশা ছাড়তে পারে না?” লাল-হলুদ কোচের গলা নেমে আসে।
বছর দেড়েক হল, ইস্টবেঙ্গলে কোচিং করছেন। কখনও এ রকম ভেঙে পড়তে দেখা যায়নি গোয়ান কোচকে। বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত। দিশাহীন নাবিকের মতো দেখাচ্ছিল তাঁকে। আসলে নিজের পাড়ায় এসে পুরনো টিমের কাছে হারলে এ রকমই হয়তো হয়।
কিন্তু আইএসএলে খেলে আসার ক্লান্তির দোহাই দিয়ে কত আর বাঁচবেন আর্মান্দো? ডেম্পোর এ দিনের খেলা সাত জন তো ছিলেন জিকোর গোয়া টিমেও। চুটিয়ে খেলেছেন নীতা অম্বানির টুর্নামেন্টে। তারা যদি এ রকম ঝড় তুলতে পারেন তা হলে ডিকা-দীপকরা পারবেন না কেন? আসলে ইস্টবেঙ্গল টিমটার ফিটনেস জিরো-তে নেমে গিয়েছে। বিরতির আগে রোমিওর গোলে পিছিয়ে পড়ার পর ডুডু-র্যান্টির সঙ্গে পুরো মাঝমাঠ গোলের জন্য মরিয়া চেষ্টা করছিলেন, আক্রমণে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দেখা গেল বিপক্ষ পাল্টা-আক্রমণে এলে তাঁরা নামতেই পারছেন না। কেন এমন হল? আর্মান্দো নিজের টিমের কাউকে বুড়ো বলেননি। তবে বললেন, “ওদের বয়স কম। আমাদের ছেলেরা সিনিয়র। তাই পারছিল না।”
চৌম্বকে এই ম্যাচটার নির্যাস হতে পারে আর্থারের স্ট্র্যাটেজিতে আর্মান্দো ভোকাট্টা!
ডেম্পোর অস্ট্রেলীয় কোচ জানতেন তাঁর বিপক্ষের মূল শক্তি দুই স্ট্রাইকার ডুডু আর র্যান্টি। তাঁদের আটকে দিতে পারলেই ইস্টবেঙ্গল কেল্লা অর্ধেক ভেঙে পড়বে। দুই নাইজিরীয় যুগলবন্দির দৌরাত্ম্য আটকাতে ৫-৪-১-এ চলে গিয়েছিলেন আর্থার পাপাস। তাতেই ইস্টবেঙ্গলের সব আক্রমণের ঝাঁঝ শেষ। ডুডু বা র্যান্টি বল ধরলেই চক্রব্যূহের মতো ঘিরে ধরছিলেন হারুণ, লেনি, রোউইলসনরা। যে করে হোক বল কেড়ে নিয়ে ক্লিফোর্ড মিরান্ডারা পাল্টা আক্রমণে যাচ্ছিলেন। তৃপ্ত ডেম্পো কোচ ম্যাচ শেষে বললেন, “ছেলেদের জন্য আমি গর্বিত। ওরা স্ট্র্যাটেজি মতোই খেলেছে।”
সাইডলাইনে কোচের সঙ্গে অ্যালভিটো। সোমবার।
নেহরু স্টেডিয়ামের ক্লাব হাউসের দোতলার লাউঞ্জের রাখা ছিল ফেড কাপটা। চার্চিল ব্রাদার্স ফেডারেশনকে যা ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছে দু’দিন আগে। রং চটা কাপটা এত অযত্নে ছিল যে কাঠের উপরের চকচকে অংশটা নড়বড় করছিল। এ দিনের ইস্টবেঙ্গল ডিফেন্সেও অনেকটা ছিল তেমনই। মিলান সুসাক ছেলেটাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁর পুরনো দুবাই-এর ক্লাব। কেন তা জানা যাচ্ছে না। তবে আল ওয়াসেল এফসি কর্তারা যে দূরদর্শী তা বুঝতে অসুবিধা হল না প্রথম ম্যাচেই। আটলেটিকোর হয়ে আইএসএলে দুর্দান্ত ফুটবল খেলেছিলেন অর্ণব। স্প্যানিশ স্টপার হোসেমির পাশে বেহালার ছেলেকে তখন দেখাত সোনার মতো ঝকঝকে। সুসাকের মতো অচল আধুলির পাশে অর্ণবও আজ বিবর্ণ। দুই সাইড ব্যাক দীপক মণ্ডল আর রাজুর অবস্থা আরও খারাপ। রাজুর পাশ দিয়েই হেলতে-দুলতে গোলের বলটা তুললেন টোলগে। রোমিও ফার্নান্ডেজ অনায়াসেই গোলটা করে গেলেন। দীপক কভারই করলেন না। টোলগেকে অবশ্য রাতে নববর্ষের কেক পাঠাতেই পারেন আর্মান্দো। পাঁচ গোলের লজ্জা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। এমন দু’টো সহজ সুযোগ অস্ট্রেলীয় স্ট্রাইকার নষ্ট করলেন যা অবিশ্বাস্য। গোয়ার সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার ব্রুনো কুটিনহো এখানে কমেন্ট্রি দিতে এসেছিলেন। মজা করে বললেন, “পুরনো ক্লাব তো তাই টোলগে লজ্জা দিল না হয়তো।”
রোমিওর দুর্ভাগ্য তাঁর অন্য গোলটা বাতিল হল অফসাইডের জন্য। আর্মান্দো যখন ডেম্পোর কোচ ছিলেন তখন অনুশীলন শেষ হলেই দক্ষিণ গোয়ার আসোলেন গ্রামের ছোট্টখাট্টো ছেলেটাকে দেখিয়ে বলতেন, ‘‘একে দেখে রাখুন। ভবিষ্যতের তারকা। আমি তুলে এনে তৈরি করছি।” আর্মান্দোর সেই পুরনো ছাত্রই এ দিন তাঁকে পথে বসিয়ে ছাড়লেন। দু’টো উইংয়ে রোমিও আর মান্দার রাও দেশাই টাট্টু ঘোড়ার মতো দৌড়চ্ছিলেন। তাঁদের ঝাপটায় তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছিল লাল-হলুদ ব্রিগেড। একটা সময় লড়াই হচ্ছিল কিপার শুভাশিস রায়চৌধুরী বনাম ডেম্পোয়। কতগুলো নিশ্চিত বাঁচালেন শুভাশিস? নোটবই বলছে, পাঁচ-ছ’টা তো হবেই।
গতবার কেরলে প্রথম ম্যাচ ড্র করেও পরে ছিটকে গিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। এ বার শুরুতেই হার। পার্থক্য একটাইগতবার ছিল তিন দলের গ্রুপ, এ বার পাঁচ দলের। আর্মান্দো টিম বাসে ওঠার আগে বলে গেলেন, “এ বার তো গ্রুপ থেকে দু’টো দল উঠবে।” ইস্টবেঙ্গলের মনের কথাও হয়তো এখন এটাই!
ইস্টবেঙ্গল: শুভাশিস, দীপক (বলজিৎ), অর্ণব, সুসাক, রাজু, বার্তোস, লোবো (তুলুঙ্গা), মেহতাব (রফিক), ডিকা, ডুডু, র্যান্টি।
ছবি: উৎপল সরকার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy