Advertisement
০৮ মে ২০২৪

ডেলোয় বৈঠক করেছি, মানলেন মুকুলই

চলতি সপ্তাহেই সিবিআই দফতরে হাজিরা দিতে যাওয়ার কথা তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের। তার আগেই আজ সংবাদমাধ্যমের কাছে সারদা কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে তাঁর দু’টি বৈঠকের কথা নিজের মুখে স্বীকার করে নিলেন প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মুকুলবাবু। যার একটিতে আবার খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন বলে আগেই তদন্তকারীদের কাছে দাবি করেছিলেন সাসপেন্ড হওয়া তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৭
Share: Save:

চলতি সপ্তাহেই সিবিআই দফতরে হাজিরা দিতে যাওয়ার কথা তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের। তার আগেই আজ সংবাদমাধ্যমের কাছে সারদা কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে তাঁর দু’টি বৈঠকের কথা নিজের মুখে স্বীকার করে নিলেন প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মুকুলবাবু। যার একটিতে আবার খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন বলে আগেই তদন্তকারীদের কাছে দাবি করেছিলেন সাসপেন্ড হওয়া তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ। এখন দলের দু’নম্বর ব্যক্তিটি ডেলোর বৈঠকের কথা স্বীকার করে নেওয়ায় তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের বিড়ম্বনার পারদ আরও চড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে।

সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে সিবিআই জানতে পেরেছে, সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে আগাগোড়া যোগাযোগ ছিল মুকুলের। এমনকী, কলকাতা ছেড়ে উধাও হওয়ার আগে নিজাম প্যালেসে মুকুলের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন তিনি। ফেরার থাকাকালীনও ফোনে বহু বার কথা হয়েছিল দু’জনের মধ্যে। এ সব নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই সিজিও কমপ্লেক্সে তলব করা হয়েছে মুকুলকে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মুকুল এ দিন বলেন, তাঁর সঙ্গে সব মিলিয়ে দু’বার বৈঠক হয়েছিল সুদীপ্ত সেনের। এক বার কলকাতায়, অন্য বার উত্তরবঙ্গে। কলকাতায় বৈঠক যখন হয়েছিল, তখন সারদা গোষ্ঠীর সংবাদপত্রগুলি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাদের কর্মীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতেই সুদীপ্তর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন তিনি।

কলকাতার বৈঠকের ব্যাপারে তাঁর যে সমর্থন ছিল, সে কথা আগেই প্রকাশ্যে বলেছেন মমতা। কিন্তু ডেলোর বৈঠকের কথা প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই তা গোপন করার মরিয়া চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। ডেলোর বৈঠকে অন্য কেউ ছিলেন কি না, তা নিয়ে এ দিন একটিও শব্দ বলেননি মুকুল। কিন্তু সিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদের আগেই তিনি যে ভাবে ওই বৈঠক নিয়ে মুখ খুললেন, তার পিছনে অন্য তাৎপর্য রয়েছে বলেই তৃণমূল শিবির মনে করছে। এই মহলের ধারণা, সিবিআই যে ডেলোর বৈঠক সম্পর্কে জানতে চাইবে, মুকুল সে বিষয়ে নিশ্চিত। কারণ, সিবিআইয়ের হাতে ইতিমধ্যেই একাধিক প্রমাণ এসেছে যে, মুকুল ওই সময়ে ডেলোয় সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। সিবিআই-সূত্রের দাবি: মুকুলের ফোনালাপের বিস্তারিত বিবরণ ছাড়াও উত্তরবঙ্গে যাওয়ার ট্রেনের টিকিট ও রিজার্ভেশন চার্টও গোয়েন্দারা জোগাড় করে ফেলেছেন।

ফলে ডেলোর বৈঠকের কথা যে কোনও ভাবে অস্বীকার করা যাবে না, পোড়খাওয়া রাজনীতিক তা ভালই বুঝতে পারছেন। তাই তৃণমূল শিবিরের অন্দরে ধারণা তৈরি হয়েছে যে, আজকের স্বীকারোক্তির মাধ্যমে দলনেত্রীর উদ্দেশে মুকুল একটা বার্তা দিয়ে রাখলেন। বার্তা এটাই যে, ওই বৈঠকের ব্যাপারটা সিবিআইয়ের কাছে স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া তাঁর সামনে রাস্তা খোলা নেই। কুণালের দাবিমতো ওই বৈঠকে মমতা যদি সত্যিই থেকে থাকেন, তা-ও মুকুল স্বীকার করে নেবেন বলে তৃণমূল শিবিরের ধারণা। রাজ্যের শাসক দলের শীর্ষ নেতাদের রক্তচাপ বাড়িয়ে সিবিআই-কে ‘যথাসম্ভব সাহায্যের’ আশ্বাস মুকুল দিয়ে রেখেছেন। সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে ‘চক্রান্তের’ কোনও অভিযোগ আজও তাঁর মুখে শোনা যায়নি। এখন মুকুল সিবিআইয়ের সামনে ডেলোর বৈঠকের কথা স্বীকার করে নিলে আগামী দিনে সিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদের তালিকায় মমতার নাম যে থাকবে না, তৃণমূলের কোনও নেতাই এমনটা জোর গলায় বলতে পারছেন না।

কিন্তু ডেলোর বৈঠক ঘিরে কেন এত গোপনীয়তা?

ডেলোর পাহাড়ি বাংলোয় ওই বৈঠক হয়েছিল ২০১২-র ১ মার্চ। আর তার পরের বছরে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে কাশ্মীরে গ্রেফতার হন সুদীপ্ত, যার কয়েক দিন আগে সারদা সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মতো ধূলিসাৎ হয়েছে। সে সময়ে মমতা দাবি করেছিলেন, তিনি এর আগে সুদীপ্ত বা তাঁর সংস্থা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি ছিল, মাত্র ক’দিন আগে (বাংলা নববর্ষের সময়, অর্থাৎ এপ্রিলের মাঝামাঝি) তিনি সারদার কথা প্রথম শোনেন। এখন পর্যন্ত নিজের সেই অবস্থানে মমতা অনড়। কিন্তু মুকুলের দাবি সত্যি হলে সুদীপ্তের সঙ্গে মমতার পরিচয়ের সূত্রপাত আরও অন্তত এক বছর পিছিয়ে যাবে। অর্থাৎ প্রমাণ হবে, সারদা ঝাঁপ গোটানোর অন্তত এক বছর আগে থাকতেই মমতা সুদীপ্তকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনতেন। শুধু চিনতেনই না, নিজের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি তুলে ধরতে সুদীপ্তের মালিকানাধীন একাধিক সংবাদমাধ্যমের সাহায্যও নিয়েছিলেন তিনি। এবং সারদার জালিয়াতির সঙ্গে মমতার সম্পর্কও এসে পড়বে তদন্তের আতসকাচের তলায়। সে ক্ষেত্রে তাঁর ‘সৎ’ ভাবমূর্তি নিয়েও প্রশ্ন উঠতে বাধ্য বলে দলেরই অনেকে মনে করছেন।

গোয়েন্দা-সূত্রের খবর, ডেলোর বৈঠকেই কুণাল মারফত সুদীপ্ত প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাঁর মিডিয়া ব্যবসার মাধ্যমে মমতাকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে দেশ জুড়ে তুলে ধরবেন। সেই মতো তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় একাধিক সংবাদপত্র ফেঁদে বসেন। যদিও এক বছরের মধ্যে তাঁকে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে হয়। আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে না-পেরে তিনি কাশ্মীর পালিয়ে যান। সিবিআই সূত্রের খবর: সুদীপ্ত পালিয়ে যাওয়ার আগে ও পরে মুকুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলছিলেন। শুধু ফোনে কথা বলা নয়, গা ঢাকা দেওয়ার বিষয়ে পরামর্শ নিতে তিনি মুকুলের সঙ্গে দেখাও করেন। মুকুল অবশ্য এই অভিযোগ উড়িয়ে বলেছেন, “নেভার নেভার নেভার। সুদীপ্ত পালিয়ে যাওয়ার পরে তাঁর সঙ্গে কোনও দেখা হয়নি।”

এ দিকে আজ দুপুরে মুকুল হঠাৎ নয়াদিল্লির বাসভবন থেকে উধাও হয়ে যাওয়ায় এক প্রস্ত নাটক হয়ে যায়। শুরু হয় খোঁজ খোঁজ। বাড়ির লোক বলেন, “দাদা বেরিয়েছেন। একটু পরে ফিরবেন বলেছেন।” চলতে থাকে জল্পনা। তা হলে কি কোনও আইনজ্ঞের কাছে দৌড়লেন? আগাম জামিনের প্রস্তুতি নিতে বা সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে? কিন্তু মুকুল তো গত কালই জানিয়েছেন, এখনই তিনি কোর্টে যাবেন না! গেলেও মিডিয়াকে জানিয়ে দেবেন! তা হলে গেলেন কোথায়?

এক-দুই করে প্রায় আড়াই ঘণ্টা বাদে ১৪১ সাউথ অ্যাভিনিউয়ের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল মুকুলের গাড়ি। পরিচিত চেহারাগুলোর উপরে এক বার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, “যা বলার তো কালই বলে দিয়েছি! ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনে কোনও ভাবে কোনও অনৈতিক কাজ করিনি।” কাল চোখে পড়েছিল দু’হাতের আট আঙুলে আট রকমের পাথর। একদা ধূমপান ছেড়ে দেওয়া প্রাক্তন রেলমন্ত্রী এখন ফের ঘন ঘন সিগারেটে টান মারছেন। আজ তার সঙ্গে জুড়েছে কপালের আবছা হয়ে আসা লাল তিলক। বোঝাই যাচ্ছিল, সিবিআইয়ের মুখোমুখি হওয়ার আগে সকালে কোনও এক সময়ে মন্দিরে পুজো সেরে এসেছেন তৃণমূলের নাম্বার টু।

আংটি আর পুজোয় কি গ্রহের ফের কাটবে?

মুকুল-ঘনিষ্ঠেরাই খুব একটা ভরসা পাচ্ছেন না যে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE