মধ্যমগ্রামের ব্যবসায়ী বছর পঁয়তাল্লিশের সঞ্জয় রায়চৌধুরীর গায়ে চিকেন পক্স উঠেছিল ২৫ মার্চ। সেই সঙ্গে প্রচণ্ড পেটে ব্যথা। শারীরিক পরীক্ষায় দেখা যায়, পক্স থেকেই প্যাংক্রিয়াটাইটিসে আক্রান্ত হয়েছেন সঞ্জয়বাবু।
এ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল এর পরেই। আরজিকর এবং এসএসকেএমের মতো প্রথম সারির সরকারি হাসপাতালগুলি জানিয়ে দেয়, পক্সের মতো ছোঁয়াচে রোগের রোগীকে ভর্তি করা যাবে না। সরকারি ব্যবস্থায় তাঁর চিকিৎসা করা যাবে একমাত্র বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে।
অথচ, পক্সের রোগীকে প্রথমে কিন্তু তাঁর বাড়ির লোকেরা নিয়ে গিয়েছিলেন আইডি হাসপাতালে। পরিবারের অভিযোগ, অ্যাকিউট প্যাংক্রিয়াটাইটিস-এর চিকিৎসা করবেন এমন কোনও গ্যাসট্রোএন্টারোলজিস্ট তাদের নেই বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। তাই ভর্তি করানো যাবে না।
রাজারহাট চৌমাথার বছর পাঁচেকের ছোটন পোড়েলের পরিবারেও হেনস্থার একশেষ। ছোটনের এর মাম্পস এর সঙ্গেই মেনিনজাইটিস ধরা পড়ে। তাকে বেলেঘাটা বিসি রায় শিশু হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু সেখানে তিনটি আইসোলেশন বেডে-র প্রত্যেকটিতেই তখন রোগী ভর্তি ছিল। মাম্পস ছোঁয়াচে রোগ। ফলে অন্য শয্যায় তাকে ভর্তি করা যাবে না। ছোটনকে আইডি-তে রেফার করা হয়।
ছোটনের পরিবারের লোকেদের অভিযোগ, ওই শিশুকে ভর্তি নেয়নি আইডি-ও। কারণ, আইডি-তে কোনও শিশু-বিশেষজ্ঞ নেই। নেই নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞ। ফলে ভর্তি করা গেলেও যে চিকিৎসা ছোটনের দরকার, তা সে পাবে না। হন্যে হয়ে একাধিক সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরে প্রত্যাখ্যাত হয়ে শেষপর্যন্ত উল্টোডাঙার নার্সিংহোমে ভর্তি করে চিকিৎসা করাতে হয়েছে ছোটনের।
সংক্রমণ বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ‘‘শীতের শেষ থেকে বসন্তের শেষ পর্যন্ত মূলত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে এ রাজ্যে চিকেন পক্স, মাম্পস, মিজলস বা হামের মতো রোগের প্রকোপ বাড়ে। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে এই সব রোগ আর একা আসে না। এদের অনুসঙ্গ বা অনুসারি হিসাবে এখন একাধিক রোগ হওয়ার প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে।’’ তাই আইডি হাসপাতালে কেন অন্য রোগের চিকিৎসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকবে না সেই প্রশ্ন তুলেছেন সংক্রমণ বিশেষজ্ঞেরা।
এক সংক্রমণ বিশেজ্ঞের কথায়, ‘‘যে সব রোগীর পক্সের সঙ্গে নিউমোনাইটিস, কার্ডাইটিস, নিউমোনাইটিস, প্যাংক্রিয়াটাইটিস, মাম্পসের সঙ্গে অর্কাইটিস, মেনিনজাইটিস বা মিজলসের সঙ্গে রেসপিরেটরি ট্র্যাক ইনফেকশন হবে তারা কি সরকারি পরিকাঠামোয় কোনও চিকিৎসা পাবে না?’’
সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা উন্নত করতে যখন জেলায়-জেলায় আইটিইউ, এসএনসিইউ খোলা হচ্ছে, সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল হচ্ছে তখন রাজ্যের একমাত্র ছোঁয়াচে রোগের চিকিৎসার হাসপাতাল আইডি-র পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগে কেন সরকারের ভ্রূক্ষেপ নেই সেই প্রশ্ন কিন্তু উঠেছে।
আইডি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তাঁদের সবসময় ১৩০-১৪০ রোগী ভর্তি থাকেন। রোজ আউটডোর চলে। এই সব কিছুর জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলতে রয়েছেন দু’জন মেডিসিন (তার মধ্যে এক জন আবার এনআরএস থেকে ডিটেলমেন্ট-এ আছেন) বিশেষজ্ঞ ও একজন ইএনটি বিশেষজ্ঞ। পক্স বা মাম্পসের রোগী কোনও শারীরিক জটিলতা নিয়ে ভর্তি হলে তাঁরা কী ভাবে চিকিৎসা করবেন? হাসপাতালে একজনও শিশু বিশেষজ্ঞ নেই। ফলে কোনও শিশু মাম্পস, পক্স বা মিজলসের জটিলতা নিয়ে এলে তাকেও ভর্তি নিতে চাওয়া হয় না।
সুকুমার মুখোপাধ্যায়, অপূর্ব ঘোষের মতো প্রবীণ চিকিৎসকেদের মতে, যত দিন যাচ্ছে ছোঁয়াচে রোগের জটিলতা বাড়ছে, একটা রোগের সঙ্গে অনেকগুলো রোগ মিশে থাকছে। এবং পক্স, হামের মতো রোগ হলে যে হেতু এমনিতেই দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা করে যায় তাই এইসময় রোগী সহজেই অন্য রোগে আক্রান্ত হন। ফলে আইডি-র মতো হাসপাতালে অবশ্যই একাধিক বিষয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ করা বা নিয়মিত অন্য হাসপাতাল থেকে তাঁদের নিয়ে এসে রোগী দেখার ব্যবস্থা করা উচিত।
আইডি এবং বিসি রায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, তাঁরা নিকট অতীতে একাধিকবার এই বিষয়টি স্বাস্থ্যভবনের কানে তুলেছেন, কিন্তু লাভ হয়নি। তবে সব শুনে রাজ্যের স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘এমনিতেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের আকাল। তাই তাইলেই সব জায়গায় তাঁদের নিয়োগ করা সম্ভব নয়। তবে বিষয়টি যে এত গুরুতর পর্যায়ে গিয়েছে সেটা আইডি কর্তৃপক্ষ আমাদের স্পষ্ট জানাননি।’’
সুশান্তবাবুর পরামর্শ, ‘‘এই রকম রোগী ভর্তি হওয়া মাত্র তাঁরা যদি আমাদের জানান তা হলে আমরা অবশ্যই এ বার থেকে অন্য হাসপাতাল থেকে বিশেষজ্ঞ এনে দেখানোর ব্যবস্থা করব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy