দাড়িভিটের বাড়ির দাওয়ায় বসে তাপস বর্মণের মা এবং বোন।— নিজস্ব চিত্র।
ঠিক এক মাস আগে ছিল রাখি পূর্ণিমা। সে দিন ছোট্ট ডলি একটা রাখি বেঁধে দিয়েছিল তার দাদার হাতে। রাখিটার দাম নিয়েছিল তিরিশ টাকা।
দাদার পছন্দ হয়েছিল খুব। তার পর রাখিটা হাত থেকে আর খোলেনি। গত সপ্তাহে যখন দাদার পেটে এসে গুলিটা লেগেছিল, তখনও হাতে ছিল রাখি। এখন দোলঞ্চার তীরে দাদার দেহ পুঁতে রাখা। রাখিটা এখনও রয়েছে হাতে।
দাড়িভিটের বাড়িতে বসে কথাগুলো কোনও রকমে বলছিল ডলি। দাদা তাপস বর্মণ যে আর নেই, সেটা এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না ছোট্ট এই কিশোরী। বিশ্বাস করতে পারছেন না তার মা-ও। মাটির দাওয়ায় বসে মঞ্জু বর্মণ হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘‘তখনও দেহে প্রাণ রয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, বাবা তোর এই সর্বনাশ কে করল? আমার বুকে মাথা দিয়ে বলল, মা পুলিশ আমাকে গুলি করেছে। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। এ দিক ও দিক ছোটাছুটি করছি। ওঁর বাবাকে ডাকছি। ডলিকে ডাকছি। এমন সময় দেখি ছেলেটা ঝিমিয়ে পড়ছে। চোখের সামনে কোল খালি করে মধু চলে যাবে বুঝতেই পারিনি।’’
দোলঞ্চা নদীর পাড়ে ছেলের দেহ এখন মাটি চাপা দিয়ে রাখা। বর্মণ-বাড়ি থেকে কয়েক পা এগোলেই সেই ‘সমাধি’। কয়েক দিন কেটে গিয়েছে। ছেলে আর ফিরে আসবে না জেনেও দাওয়ায় বসে ‘মধু... মধু’ করে ডেকে চলেছেন তাপসের মা। এমন একটা দৃশ্যের সামনে কেমন অসহায় লাগে। হঠাৎই মঞ্জু দেবী বললেন, ‘‘কোথা থেকে এসেছো গো বাবা! একা? খুব সাবধান। ওরা কিন্তু সব নজর রাখছে।’’
জিজ্ঞেস করা গেল, কারা নজর রাখছে? জবাব এল, ‘‘যাঁরা আমার ছেলেকে খুন করেছে, তাঁরা। এই তো দু’দিন আগে তাপসের ফোনে কে যেন ফোন করে বলল, বৌদি তুমি কোথায়? দেখো, তোমার ছেলের দেহ সমাধি থেকে কারা যেন তোলার চেষ্টা করছে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলাম। দেখি আলো নেভানো। দূরে কয়েক জন দাঁড়িয়ে। পরে অবশ্য ওরা চলে গেল। আমার মরা ছেলেটাকেও ছাড়ছে না! সিবিআই চেয়েছি তো, এখন দেহটাই লোপাট করে দিতে চাইছে।’’
আরও পড়ুন: অগ্নিগর্ভ ইসলামপুর, চলছে দফায় দফায় সংঘর্ষ
আরও পড়ুন: সিপিএমের প্রাক্তন উপপ্রধানের দেহ মিলল উত্তর দিনাজপুরের খালে
এলাকার মানুষজন তাপসকে মধু নামেই চেনেন। ডাক নাম তো মধুসূদন ছিল। আদরের নাম তাই মধু। তিল তিল করে বাড়ির সামনেই তৈরি করেছিল মিষ্টির দোকান। এক দিকে কলেজের পড়াশোনা, অন্য দিকে দোকান সামলে পরিবারের হাল ধরেছিল মধু। দাড়িভিটে সে দিনের গোলমালে মধুর কোনও সম্পর্ক ছিল না বলেই মঞ্জু দেবীর দাবি। মায়ের পাশে বসে থাকা ছোট্ট ডলি তখনও ডুকরে কাঁদছে। মেয়েকে দেখিয়ে মঞ্জু দেবী বললেন, ‘‘এই তো বোনকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিল। বলল, ভাল জায়গায় বিয়ে দেব। তার পর আমি বিয়ে করব।’’
মঞ্জু দেবীর অভিযোগ, ‘‘গোলমালে পুলিশেরও অনেকে আঘাত পেয়েছেন। তাঁদের অতটা কিছু হয়নি। আর এ দিকে তিনটে ছেলের গুলি লাগল, তাদের হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে নিজেদের লোককে নিয়ে গেল ওরা। আর গুলিবিদ্ধ তিন জন পড়ে থাকল গ্রামেই। তাপস চলে গেল। রাজেশ চলে গেল। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে বিপ্লব। জানেন, অনেকেই দেখা করতে এসে অর্থ সাহায্যও করতে চেয়েছেন। আমি ওঁদের বলেছি, টাকা দিয়ে কি হবে রে বাপ। আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে পারবি! ওই টাকা আমার লাগবে না। পারলে ছেলের খুনিকে ধরে দেখা। পুলিশের শাস্তি চাই।’’
(মালদহ, দুই দিনাজপুর, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কালিম্পং সহ উত্তরবঙ্গের খবর, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা খবর পড়ুন আমাদের রাজ্য বিভাগে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy