Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Jammu And Kashmir

আপেলবাগানে জঙ্গিদের দেখাই কি কাল হল ওঁদের! ভাত আনতে গিয়ে বেঁচে গেলেন টিপু

নেহাত বরাত জোরেই বেঁচে গিয়েছেন বাসিরুল সরকার ওরফে টিপু।

স্বজন হারানোর কান্না। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

স্বজন হারানোর কান্না। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

সিজার মণ্ডল
বাহালনগর (সাগরদিঘি, মুর্শিদাবাদ) শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৯ ১৯:১৮
Share: Save:

সুদূর কাশ্মীরে ভাতই বাঁচিয়ে দিল ছেলেটাকে। বাহালনগরে গ্রামের বাড়িতে বসে টিপুর বৃদ্ধা মা তাই কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন আল্লাকে।

পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসছে কান্নার আওয়াজ। আর এ বাড়িতে তক্তপোষের উপর বসে হাত দুটো জড়ো করে টিপুর মা বছর ষাটের নুরনেহা বিবি। পাশে বসা টিপুর স্ত্রী রুকসানা বিবির চোখে জল। কিন্তু, মুখে হাসি।

নেহাত বরাত জোরেই বেঁচে গিয়েছেন বাসিরুল সরকার ওরফে টিপু। মঙ্গলবার জম্মু-কাশ্মীরের কুলগামের যে বাড়িতে জঙ্গিরা হামলা চালিয়েছিল, সেখানেই থাকতেন টিপু। তাঁর সঙ্গে থাকা পাঁচ বাঙালি শ্রমিক জঙ্গিদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। ওই ঘটনায় নিহত কামরুদ্দিনের গ্রামেই বাড়ি টিপুর। একেবারে পাশের বাড়ি। ২৬ দিন আগে বাহালনগর থেকে যে সাত জন কুলগামের কাতরাসুতে গিয়েছিলেন, তাঁদেরই এক জন টিপু।

বাসিরুল সরকারের মা ও স্ত্রী। —নিজস্ব চিত্র।

আরও পড়ুন: কাশ্মীর ছেড়ে আজই ওঁদের রওনা দেওয়ার কথা ছিল, সাগরদিঘির গ্রামে হাহাকারে মিশে আক্ষেপ​

কাতরাসুতে সাত জনই থাকতেন এক ঘরে। সঙ্গী পাঁচ জনকে জঙ্গিরা বুলেটে ঝাঁঝরা করে দিলেও অক্ষত রয়ে গিয়েছেন টিপু। বুধবার সকালেই ফোন করেছিলেন মা এবং স্ত্রীকে। নুরনেহার কথায়, ‘‘সবই আল্লার দয়া। আমার ব্যাটা ভাত আনতে গেছিল। জঙ্গিরা যখন আসে, ও তখন ছিল না ডেরায়। ফেরার পথে দূর থেকে গুলির শব্দ শুনতে পায়। সেখান থেকেই পালায়। তাই বেঁচে গিয়েছে টিপু।” আর রুকসানা বলছেন, ‘‘ওরা রাস্তার ধারে একটা ঘর ভাড়া করে থাকত। প্রতি দিন সন্ধ্যায় খাবার নিয়ে আসতে হত জমির মালিকের বাড়ি থেকে। এক এক দিন এক এক জন যেত। গতকাল সন্ধেয় আমার স্বামী গিয়েছিল। আর সেটাই ওকে বাঁচিয়ে দিল।”

ভাত আনতে গিয়েই প্রাণে বেঁচে যাওয়া টিপু মঙ্গলবার সকালে ফোন করেছিলেন স্ত্রীকে। রুকসানার কথায়, ‘‘তখনও সব কিছু ঠিকঠাক ছিল। বলেছিল, যার বাগানে ওরা কাজ করছে, সেই মালিক বিকেলে মজুরির সব টাকা দেবে। টাকা পাওয়ার পরই ভোরবেলা রওনা হওয়ার কথাও বলেছিল।” তবে সেই সময় তিনি স্ত্রীকে যা বলেননি তা বলেন বুধবার সকালে পাড়ার স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য মুস্তাফিজুর রহমানকে।

বুধবার দুপুরে মুস্তাফিজুর বলেন, ‘‘আজ সকালে টিপু সোমবারের একটা ঘটনার কথা বলেন। ওই দিন আপেলবাগান থেকে কাজ করে ফেরার পথে ওরা কয়েক জন জঙ্গির মুখোমুখি হয়ে যায়। জঙ্গিরা জঙ্গলের ধারে আপেলবাগানে মিটিং করছিল। টিপুদের দেখে প্রশ্ন করে, কোথাকার লোক? ওরা বলে, বাংলার, মুর্শিদাবাদের। ওই সশস্ত্র জঙ্গিরা টিপুদের পরের দিনই গ্রাম থেকে চলে যেতে বলেছিল।” মুস্তাফিজুর আরও বলেন, ‘টিপুরা মঙ্গলবারই ফিরবে ঠিক করেছিল। কিন্তু জমির মালিক টাকা আটকে রেখে বলেন, এক দিন আরও কাজ করে যেতে।” টিপু ফোনে মুস্তাফিজুরকে জানিয়েছেন, কাকতালীয় ভাবেই মঙ্গলবার সকালে ওই গ্রামে তল্লাশি শুরু করে সেনা। টিপুদের ঘরেও তল্লাশি চলে। পরিচয়পত্র দেখাতে হয়। মুস্তাফিজুরের দাবি, সেনা জওয়ানরা ওদের ঘরে ঢোকার খবর জঙ্গিরা পেয়েছিল। জঙ্গিরা সন্দেহ করেছিল, সেনাকে হয়তো তাদের খবর টিপুরাই দিয়েছে। সে কারণেই পরে তারা হামলা চালায়। টিপু এমন সন্দেহের কথাই জানিয়েছেন তাঁকে।

বাসিরুল সরকারের বাড়ির বাইরে ভিড় গ্রামের বাসিন্দাদের। ছবি: এপি।

রও পড়ুন: নিন্দায় রাজ্যপাল-মুখ্যমন্ত্রী, কুলগাম হত্যাকাণ্ড নিয়ে মোদী-অমিতকে চিঠি অধীরের​

তবে জঙ্গিরা সোমবারের আগেও এক বার খোঁজ খবর করেছিল টিপুদের। মঙ্গলবারের ঘটনায় নিহত রফিকুল শেখের বউদি রেশমা বিবি এ দিন বলেন, ‘‘চার পাঁচ দিন আগেও জঙ্গিরা রাতের বেলা ওদের ডেরাতে এসেছিল। জিজ্ঞাসা করেছিল কোথাকার লোক?”

ঘটনাস্থলে এখনও পড়ে রয়েছে রক্ত। ছবি: এপি।

তবে, ফি বছর কাশ্মীরে যাওয়া বাহালনগরের বাসিন্দাদের অনেকেই অবাক মঙ্গলবারের ঘটনায়। এই বাহালনগরেরই মিরাজ আলি মঙ্গলবার রাতে কাশ্মীর থেকে ফিরেছেন। সঙ্গে মহম্মদ কলিমুদ্দিন। এ দিন কলিমুদ্দিন বলেন, ‘‘গত ১৫ বছর ধরে কাশ্মীর যাচ্ছি পেটের ধান্ধায়। অনেক বার আতঙ্কবাদীদের মুখোমুখি হয়েছি। কোনও বার কিছু বলেনি। উল্টে সেনার লোকজন বারণ করত কাজ করতে যেতে। বলত, কেন প্রাণ হাতে নিয়ে আমরা কাশ্মীরে কাজ করতে যাই। এ বার সবটাই কেমন ওলটপালট হয়ে গেল!”

তবে এ সবের মধ্যেই টিপুর মা আল্লাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলে চলেছেন, ‘‘ভাতের জন্যই কাশ্মীরে গিয়েছিল ব্যাটা। সেই ভাতই প্রাণে বাঁচিয়েছে ওকে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE