জাল চেকের বিপদ ঠেকাতে গরজ নেই বহু ব্যাঙ্কেরই— এমনটাই জানাচ্ছে কলকাতা পুলিশ।
চেক জালিয়াতি ঠেকাতে ব্যাঙ্কের জন্য কিছু সুরক্ষা কবচের নিদান দিয়েছিল লালবাজার। যাতে ভুয়ো চেক জমা দিয়ে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরানো বন্ধ করা যায়। লালবাজারের দাবি, একটি মাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক শুধু ওই সব সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বলে কলকাতা পুলিশকে জানিয়েছে। কিন্তু বাকি সব ব্যাঙ্ক, বিশেষত অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক সে সব মানছে না। এ নিয়ে উদ্বেগে পুলিশের কর্তারা। গোয়েন্দারা বলছেন, বারবার বলা সত্ত্বেও বেশ কয়েকটি ব্যাঙ্কের এ ব্যাপারে কোনও গা নেই।
ইতিমধ্যেই খবর এসেছে, সম্প্রতি দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমায় একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে ভুয়ো চেক জমা দিয়ে লাখ পাঁচেক টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দাদের মতে, এই ঘটনাই প্রমাণ করে, চেক তৈরিতে যে ধরনের সতর্কতা নিতে বলা হয়েছিল, ওই ব্যাঙ্কটি তা নেয়নি। লালবাজারের অফিসারেরা বলছেন, একে এটিএম লুঠ ও ডেবিট কার্ড জালিয়াতি নিয়ে তাঁরা নাজেহাল, তার উপরে ফের চেক জালিয়াতি শুরু হলে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হবে।
চেক জালিয়াতির ক্ষেত্রে সাধারণত যেটা দেখা যায়, কোনও ব্যাঙ্কের চেকের পাতা আসল, কিন্তু তাতে ছাপার অক্ষরে থাকা অ্যাকাউন্ট নম্বর, চেকের সিরিজ, ব্যাঙ্কের শাখা ও ঠিকানা, অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের নাম— সবই যান্ত্রিক ভাবে নিখুঁত বদলে দেয় জালিয়াতেরা। হোমওয়ার্ক করে জেনে নেয়, ওই ব্যাঙ্কের নির্দিষ্ট ব্রাঞ্চে থাকা কোন অ্যাকাউন্টে সব সময়ে মোটা টাকা থাকে। তার পরে এমন এক জনের নামে সেই চেক কাটা হয়, যাঁর নামে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল ভুয়ো
নথি জমা দিয়ে। এবং টাকা তুলেও নেওয়া হয়।
২০১৩ সালে উল্টোডাঙায় একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখায় এই কায়দায় প্রায় দু’কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল জালিয়াতেরা। গুজরাতের একটি সংস্থা ওই দু’টি চেক কেটেছে বলে দেখানো হয়েছিল। তদন্তে বেরোয়, জালিয়াতেরা একটি আসল চেক ফোটোকপি করে সমস্ত তথ্য ও সংশ্লিষ্ট অবস্থান জেনে নিয়েছিল। তার পরের বছর শহরের ব্যাঙ্কে এই ধরনের আরও কয়েকটি জালিয়াতি হলে নড়েচড়ে বসেন গোয়েন্দারা।
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) দেবাশিস বড়াল বলেন, ‘‘নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। সে জন্য চেক জালিয়াতি রুখতে চাইছি। এ ব্যাপারে যে সব ব্যাঙ্ক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি, তারা দ্রুত সেগুলো করবে বলে আশা রাখি। তাতে গ্রাহকদের অর্থাৎ নাগরিকদের লাভ।’’
গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, প্রতিটি চেকে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে যেগুলি একমাত্র অতি বেগুনি রশ্মিতে দেখা যায়। লালবাজারের সুপারিশ ছিল, ওই সব বৈশিষ্ট্য চেকের মধ্যে এমন সব জায়গায় রাখতে হবে, যাতে চেকের গায়ে লেখা তথ্য যান্ত্রিক ভাবে বদলাতে গেলেই অতি বেগুনি রশ্মির ওই সব বৈশিষ্ট্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তা করা হলে তখনই ধরে ফেলতে পারবেন যে ব্যাঙ্কে জমা দেওয়া হচ্ছে, সেখানকার কর্মীরা।
গত বছর ২১ সেপ্টেম্বর কলকাতায় স্টেট লেভেল ব্যাঙ্কার্স কমিটির (এসএলবিসি) একটি বৈঠক হয়। সেখানে গোয়েন্দা বিভাগের ব্যাঙ্ক জালিয়াতি দমন শাখার ওসি সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় ও কয়েক জন অফিসারকে পাঠান তৎকালীন স্পেশ্যাল কমিশনার, বর্তমানে কলকাতা পুলিশের কমিশনার সৌমেন মিত্র। ছিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার ডেপুটি গভর্নর
এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিরাও।
ওই বৈঠকে লালবাজারের গোয়েন্দারা একটি ভিডিও রেকর্ডিং পেশ করেন। তাতে দেখানো হয়, কী ভাবে চেকের পাতার আসল তথ্য যান্ত্রিক ভাবে মুছে জাল তথ্য বসাচ্ছে জালিয়াতেরা। ওই ভিডিও দেখিয়েই জাল চেকের বিপদ রুখতে অতি বেগুনি রশ্মিতে দৃশ্যগোচর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য দায়সারা ভাবে যেখানে সেখানে না বসিয়ে কৌশল করে বসানোর সুপারিশ করেছিল পুলিশ।
লালবাজার সূত্রের খবর, এটিএম লুঠের পর মে মাসের গোড়ায় ব্যাঙ্ককর্তাদের লালবাজারে ডাকা হয়েছিল। বৈঠকে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর জানান, কলকাতা পুলিশের সুপারিশ মতো তাঁরা চেকের পাতায় অতি বেগুনি রশ্মিতে দৃশ্যগোচর বৈশিষ্ট্যগুলির অবস্থান বদল করেছেন। নিয়েছেন আরও কিছু সাবধানতাও। এবং তার ফলও হাতেনাতে পাচ্ছেন।
এক গোয়েন্দা অফিসার বলেন, ‘‘প্রতিটি ব্যাঙ্ক এ ভাবে এগিয়ে এলেই গ্রাহকেরা বিপন্মুক্ত হবেন। একটি-দু’টি ব্যাঙ্ক পদক্ষেপ করলে কাজের কাজ হবে না।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোকে নিয়ে তেমন সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এ দিকে তেমন নজর নেই।’’ একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এক কর্তা বলেন, ‘‘পুলিশের পরামর্শগুলি অবশ্যই মানা হবে। কিছুটা সময় লাগছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy