তারকা: মুম্বইয়ের বাড়িতে বাপ্পি লাহিড়ী। নিজস্ব চিত্র
তাঁর নিজের জীবন বলতে হিন্দিতে দিলীপ কুমার, দেবানন্দ থেকে বরুণ ধওয়ন, রণবীর সিংহ। আর বাংলায় উত্তরকুমার থেকে দেব। তিনি নিজে এমনটাই বিশ্বাস করেন।
তবু এক সময়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন। কিন্তু রাজনীতির ময়দানে ছক্কা হাঁকাতে পারেননি বলিউডের ‘ডিস্কো কিং’ বাপ্পি লাহিড়ী। বরং এখন তিনি মনে করেন, ‘‘রাজনীতি রিটায়ার্ড লোকেদের জন্য। যাঁদের জীবনে অনেক কাজ আছে, তাঁরা রাজনীতিতে আসেন না।’’
বৈশাখের এক দুপুরে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে এমনই সহাস্য মন্তব্য করলেন ‘ডিস্কো ডান্সার’, ‘নমক হালাল’, ‘সরাবি’-সহ বহু সুপারহিট সিনেমার সঙ্গীত পরিচালক। পাঁচ বছর আগে শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি-র প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে গর্ব অনুভব করেন। আর তাই মুম্বইয়ে বসেই নতুন বঙ্গাব্দের শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি বললেন, ‘‘সকলকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে এ বার একটা বাংলা গান গেয়েছি।’’ পরক্ষণেই অবশ্য ফিরে এলেন রাজনীতির প্রসঙ্গে। বললেন, ‘‘রাজনীতিটা করতে গেলে তো রাজনীতিতে থাকতে হয়। আমার তো সেই সময়টাই নেই। সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে হয়।’’
কিন্তু তা-ও তো রাজনীতিতে এসেছিলেন, ভোটেও লড়েছিলেন? কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা অপর প্রান্তে। তার পরেই ‘তু নে মারি এন্ট্রিয়া’ গানের গায়ক হেসে বললেন, ‘‘দেখলাম, এক বার দাঁড়িয়ে। রাজনীতিটা কী, সেটা জানলাম। তবে আমি ওখানে খাপ খাই না। যাঁরা অবসর নিয়েছেন, তাঁদের জন্য বরং রাজনীতিটা ভাল। তাঁরাই ওটা করতে পারেন।’’
লোকে যে বলে, অনেক আগে থেকেই তিনি কংগ্রেসের সমর্থক...। কথা শেষ হওয়ার আগেই বাপ্পির দাবি, ‘‘ওটা লোকে বলে। তবে এটা ঠিক যে, কংগ্রেসে আমার ভাল জানাশোনা ছিল। ইন্দিরা গাঁধীও আমাকে স্নেহ করতেন।’’ তা হলে বিজেপি-তে এলেন কী ভাবে? বাপ্পি নিজেই জানালেন তার নেপথ্যকাহিনি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী তাঁকে খুব ভালবাসতেন। তিনি অসুস্থ থাকার সময়েও তাঁর বাড়িতে যাতায়াত ছিল মুম্বইয়ের ওই সঙ্গীত পরিচালকের। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত বাপ্পির কথায়, ‘‘রাজনাথ সিংহের কথায় রাজনীতিতে এসেছিলাম। উনিই বলেছিলেন বাংলায় ভোটে দাঁড়াতে।’’
যদিও কাজের ব্যস্ততা সামলে রাজনীতির জটিল অঙ্ক তিনি সামলাতে পারবেন না বলেও জানিয়েছিলেন অমিতাভ বচ্চনের প্রতিবেশী, ‘লাহিড়ী হাউস’-এর কর্তা। তা-ও ভোটে দাঁড়ালেন কেন? ‘‘শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও অটলজিকে শ্রদ্ধা জানাতেই রাজি হয়েছিলাম। চেষ্টাও করেছিলাম,’’ সোজাসাপ্টা জবাব ৬৯ বছরের বাপ্পির। কিন্তু যিনি রোড শো করলে শ্রীরামপুরে জনতার ঢল নামত, সেই জনগণের ‘বাপ্পিদা’ জিততে পারলেন না কেন?
হারজিতের ব্যাখ্যায় জেতে রাজি নন তিনি। তবে এটা মেনে নিচ্ছেন, মাত্র এক মাসের প্রচারে তেমন কিছু হয় না। আর একটু বেশি সময় দিলে হয়তো কিছু করতে পারতেন। বললেন, ‘‘নির্বাচনটা ভালই হয়েছিল। পরাজয়ের ব্যবধানটাও খুব কম ছিল। আর হেরে যাওয়াটা বড় কথা নয়। যা হয়েছে, ঠিক আছে। জনতা যা চাইবে, তা-ই হবে। প্রচারে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগম বুঝিয়ে দিয়েছে, তাঁরা শিল্পী বাপ্পিদাকে কতটা ভালবাসেন।’’ অগণিত মানুষের সেই ভালবাসা আঁকড়েই আগামী দিনে চলতে চান সঙ্গীত জীবনের ৫০ বছর পূর্ণ করা বাপ্পি।
তবে দিল্লি দখলের লড়াইয়ে দেব, মিমি, নুসরতের মতো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অংশগ্রহণ নিয়ে কোনও কথা বলতে রাজি নন বঙ্গরত্ন পাওয়া ওই শিল্পী। তাঁর মন্তব্য ‘‘আমার ব্যাপারটা আলাদা। অন্যেরা কে ভোটে দাঁড়াল, কে দাঁড়াল না, তা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। আমি তো এখনও কাজ করে যাচ্ছি। এখনও আমার শো-এ মানুষ ভিড় করেন। এ বছরই পাঁচটা নতুন গান বেরোচ্ছে।’’ সঙ্গে আবারও বললেন, ‘‘যাঁরা অবসর নিয়েছেন, তাঁদের জন্য রাজনীতি ভাল। আমি ওতে খাপ খাই না।’’
রাজনীতির ময়দানে আর আসতে চান না এখনও স্টেজে ‘পারফর্ম’ করে চলা বাপ্পি। কিন্তু তা বলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক নেই, এমনটাও নয়। বাপ্পির দাবি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে সনিয়া গাঁধী, এমনকি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক খুবই ভাল। পাশাপাশি জানালেন, তিনি এখন ভোট নয়, সকলের থেকে ‘ভালবাসার প্রার্থী’। ‘এ আমার গুরুদক্ষিণা’ বা ‘পৃথিবী হারিয়ে গেল মরু সাহারায়’ গানের পরিচালক জোর গলায় বলছেন, ‘‘আমি শিল্পী মানুষ। আমার মধ্যে কোনও ভেদাভেদ নেই। রাজনাথজিকে শ্রদ্ধা করি। মোদীজি খুবই ভালবাসেন। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও আমার দিদি-ভাইয়ের সম্পর্ক।’’
নিজেকে এখনও গেরুয়া শিবিরের সদস্য বলতে অবশ্য আপত্তি নেই বাপ্পির। তবে এই কথার সঙ্গেই তাঁর সংযোজন, ‘‘দলের সঙ্গে কিন্তু সরাসরি আর জড়িত নই।’’ পাশাপাশি এ-ও বলছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি সব সময়েই আমি শ্রদ্ধাশীল।’’
তা হলে দিদি কখনও বাংলায় ডাকলে রাজনীতিতে ফিরে আসবেন?
জন্ম থেকে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত কলকাতায় কাটানো শিল্পীর উত্তর, ‘‘উনি যে আমার কাছে শ্রদ্ধার, সেটা বারবারই বলেছি। যখন ভোটে দাঁড়িয়েছিলাম, তখনও বলেছিলাম। এখন আমি রাজনীতিতে নেই, তা-ও বলছি। ওঁর সঙ্গে আমার দারুণ সম্পর্ক। চিরকাল সেটা রাখতে চাই। এর মধ্যে কোনও রাজনীতি নেই।’’ সঙ্গীতশিল্পী বাবা অপরেশ লাহিড়ী ও মা বাঁশরী লাহিড়ীর একমাত্র সন্তান বাপ্পি অবশ্য এটাও মানেন, ‘‘রাজনীতিতে কিছুই বলা যায় না। কখন কে দাঁড়ায়, কে আসে আর কে চলে যায়, কিছুই বলা যায় না।’’
তবে এ সবের উপরে গানই তাঁর কাছে আরাধ্য। সেই গানের সূত্রেই আট থেকে আশির মনে সারাটা জীবন নিজের লোক হয়ে থাকতে চান বাপ্পিদা। তাই ফোন রাখার আগে গাইলেন, ‘চিরদিনই তুমি যে আমার/ যুগে যুগে আমি তোমারই।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy