Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
General Election 2019 Journalist

কোচবিহারে শেষ কথা বলবে ডাঙড় বাহিনী! অনেক বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীই চাইছে না বিজেপি

কেউ বলছেন বুনো ওল বাঘা তেঁতুলের লড়াই। আবার কারওর মুখে ‘জোড়া’ ফুলের লড়াই।

তিনি প্রার্থী নন, তবু কোচবিহারের লড়াইটা যেন নিশীথ প্রামাণিক (বাঁ-দিকে) বনাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষের।

তিনি প্রার্থী নন, তবু কোচবিহারের লড়াইটা যেন নিশীথ প্রামাণিক (বাঁ-দিকে) বনাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষের।

সিজার মণ্ডল
কোচবিহার শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৯ ১৭:৩৩
Share: Save:

রবিবারের সকাল। শহর কোচবিহারের উপকণ্ঠে ঘুঘুমারির চায়ের দোকানে বেশ ভিড়। চলছে জোরদার আলোচনা। কান পাততেই বোঝা গেল, গুঞ্জনের বিষয় গুঞ্জবাড়ির ঘটনা।

লোভ সামলাতে পারলাম না। নিজের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে প্রশ্ন করলাম, এ বার এখানে হাওয়া কার পালে? ওই প্রশ্নের পিঠেই প্রশ্ন করলাম, আপনাদের এখানে ভোটের মূল ইস্যু কী?

দ্বিতীয় প্রশ্ন শুনেই সামনে বসা এক প্রৌঢ় হাসতে শুরু করলেন। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললেন, ‘‘ইস্যু দিয়ে ভোট, ও সব আগে হত। এ বার তো ভোটে লড়াই দুই ফুলের।’’ আমার ঘাবড়ে যাওয়া মুখ দেখে উদ্ধার করলেন অন্য এক যুবক। পরে জেনেছিলাম তাঁর নাম মৃন্ময় রায়। ঘুঘুমারিতেই বাড়ি। একটি বেসরকারি স্কুলের অশিক্ষক কর্মী। মৃন্ময়ের কথায়, ‘‘খাতায় কলমে এই কেন্দ্রে পরেশ চন্দ্র অধিকারীর সঙ্গে নিশীথ প্রামাণিকের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলেও, আসলে লড়াইটা তো রবি ঘোষ (উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ) বনাম নিশীথ প্রমাণিকের।”

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

গোটা কোচবিহারের আনাচে কানাচে ঘুরতে গিয়েও বারে বারে কানে এল সেই একই কথা। কেউ বলছেন বুনো ওল বাঘা তেঁতুলের লড়াই। আবার কারওর মুখে ‘জোড়া’ ফুলের লড়াই। মৃণ্ময় সে দিন বুঝিয়েছিলেন, বিজেপিতে যোগ দেওয়ার বহু আগে থেকেই, আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে বললে, পঞ্চায়েত ভোটের আগে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ঘিরে গুলি-বোমা-খুন লেগেই ছিল। তৃণমূল কর্মীদের ভাষায় লড়াইটা ছিল ‘মাদার বনাম যুবর’। অর্থাৎ মূল তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে যুব তৃণমূলের। পরিস্থিতি এতটাই সঙ্গিন হয়ে ওঠে যে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দলের অভিজ্ঞ নেতা সুব্রত বক্সি এবং ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে যুগ্ম ভাবে জেলার দায়িত্ব দেন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। আর সেই মাদার বনাম যুবর লড়াইয়ের দুই পক্ষ— রবীন্দ্রনাথ ঘোষ এবং সেই সময় জেলার উঠতি যুব নেতা নিশীথ প্রামাণিক।

আসন্ন ভোটের আগে জোরদার প্রচারে তৃণমূল কংগ্রেস।

এর পরে তোর্ষা-রায়ডাক দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। নিশীথকে যুব তৃণমূল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বিজেপির বহু জেলা এবং রাজ্য নেতাকে চমকে দিয়ে কোচবিহারের টিকিট জোগাড় করে নিয়েছেন নিশীথ। কিন্তু সেই পুরনো মাদার-যুবর লড়াইটা যে থামেনি, বরং রাজনীতির আঙিনা ছেড়ে সেটা ব্যক্তিগত স্তরে পৌঁছে গিয়েছে, তার প্রমাণ মিলল শনিবার গুঞ্জবাড়িতে।

ওই দিন একটি টেলিভিশন চ্যানেলের বিতর্ক সভা উপলক্ষে কোচবিহারের শহরের গুঞ্জবাড়ির একটি হলে উপস্থিত হয়েছিলেন সব দলের প্রতিনিধিরাই। তৃণমূলের পক্ষে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঘোষ নিজে, অন্য দিকে বিজেপির প্রার্থী নিশীথ প্রামাণিক। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, তর্ক বিতর্ক ক্রমেই রাজনীতির সীমা ছাড়িয়ে ব্যক্তিগত স্তরে নেমে আসে। আর তখনই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে রবিবাবু ক্যামেরার সামনেই মঞ্চের উপর মারতে যান নিশীথকে। দু’জনের সদস্য সমর্থকরা তখন হলের মধ্যে। ধুন্ধুমার হওয়ার আগেই সঞ্চালিকার তৎপরতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও, লোকমুখে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওই ঘটনা চাউর হয়ে যায় গোটা জেলায়। ভাইরাল হয়ে যায় ‘মারামারির’ ভিডিয়ো। রবিবারের সকালে রাসমেলায় মোদী কী বলছেন, তা ছাপিয়ে মানুষ মশগুল রবি-নিশীথের দ্বৈরথ নিয়ে।

আরও পড়ুন: মোদীবাবুর হিসেব নেব ইঞ্চিতে, চ্যালেঞ্জ মমতার

দিনহাটার আনোয়ার দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক কর্মী। এক সময়ে গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন বংশীবদন বর্মণের সঙ্গে। তাঁর কথায়, কোচবিহার জেলায় অনেক ইস্যুই রয়েছে। রাজবংশী ভাষার স্বীকৃতি থেকে শুরু করে কোচ-রাজবংশী জনজাতির মানুষের জন্য সেনাবাহিনীতে আলাদা রেজিমেন্টের দাবি। পাশাপাশি রয়েছে কাজের অভাব। কর্মসংস্থানের অভাব এই কৃষি নির্ভর জেলারও অন্যতম বড় সমস্যা। কিন্তু প্রার্থী হিসাবে নিশীথের নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাকি সব চাপা পড়ে গিয়েছে। সামনে এসে গিয়েছে রবি ঘোষ বনাম নিশীথের ব্যক্তিগত শত্রুতা।

দলীয় কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে পথে প্রচারে পরেশ চন্দ্র অধিকারী।

যে নিশীথকে প্রার্থী ঘোষণার পরের মুহূর্তে কোচবিহারে বিজেপি কার্যালয়ে ভাঙচুর করেন বিক্ষুব্ধ বিজেপি কর্মীরা, সেই নিশীথকে নিয়ে কোন সমীকরণে আশার আলো দেখছে বিজেপি? বিজেপির এক রাজ্য নেতা বললেন, ‘‘কোচবিহারে এ বার কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার খেলা।” কথাটার মানে বুঝলাম শীতলকুচিতে গিয়ে। সেখানে স্থানীয় স্তরের এক ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা মহম্মদ ইসমাইল। তিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধরে কোচবিহারে ভোট হচ্ছে ‘ডাঙড়’ বাহিনীর দাপটে। যার হাতে ডাঙড় বাহিনী আছে, সেই জিতবে। ইসমাইলের কথা শুনে বুঝলাম ডাঙড় বলতে ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর কথা বলছেন তিনি। শুধু ইসমাইল নন— মাথাভাঙা, সিতাইয়ের অনেক সাধারণ মানুষের দাবি, রবি ঘোষের ডাঙড় বাহিনী সব নিশীথের শিবিরে নাম লিখিয়েছে। তার নমুনাও খানিকটা চোখে পড়ল দিনহাটাতে নিথীথের প্রচারের সময়। গাড়ি বাইক মিলিয়ে নিশীথের সঙ্গে সব সময়েই শ’দেড়েক যুবক। তাঁদের পরিচয় আমি না জানলেও, স্থানীয়রা হাড়ে হাড়ে জানেন। নিশীথের ডাঙরদের যে রবিবাবু সামাল দিতে পারছেন না, তা খানিকটা মালুম হল শনিবার গুঞ্জবাড়ির ঘটনায়। রবি ঘনিষ্ঠ এক তৃণমূল কর্মীর দাবি, ‘‘সকাল থেকে মেজাজ বেশ ভালই ছিল দাদার। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে পর পর ফোন আসতে থাকে সিতাই, শীতলকুচি থেকে। নিশীথের ছেলেরা কোথাও ফ্ল্যাগ খুলে দিচ্ছে, কোথাও পোস্টার ছিড়ে দিচ্ছে। তার পর দাদা প্রশাসনের অনেককেই ফোন করেছিলেন। কিন্তু তাতেও কাজ খুব একটা হয়নি। আর তাতেই মেজাজ হারান দাদা।” মাঠে ময়দানে প্রচারে গিয়ে নিশীথের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত স্তরেও বিষোদ্গার করছেন তিনি।

আরও পড়ুন: অবশেষে ‘ক্ষত’ মেরামতের চেষ্টা, ক্ষুব্ধ আডবাণী-জোশীর সঙ্গে দেখা করলেন অমিত শাহ

রবিবাবুর বিভিন্ন অভিযোগের মধ্যে মূল হল— নিশীথ দাগী অপরাধী। নিশীথকে প্রশ্ন করলে হাসি হাসি মুখে তাঁর জবাব, ‘‘আমি তো হলফনামাতেই জানিয়েছি আমার বিরুদ্ধে ১১টি ফৌজদারি মামলা রয়েছে। রবিবাবু, উদয়নবাবুরা যাই বলুন না কেন, এলাকার মানুষ জানেন সব মামলাই মিথ্যে। রবি ঘোষের সাজানো।” তবে এলাকার মানুষের অনেকেই বলেন, “বিট্টু (নিশীথের ডাক নাম) মানুষ কেমন সেটা ও ভাবে বলতে পারব না। কিন্তু কেউ সাহায্য চাইতে গেলে, খালি হাতে ফেরে না।” আনোয়ারের কাছে জানলাম, সিতাই দিনহাটাতে গত কয়েক বছর ধরে ক্লাবে ক্লাবে প্রতিযোগিতা চলে, কে নিশীথকে সভাপতি করবে। কারণ তাঁকে সভাপতি করলেই পুজোতে লাখের অঙ্কে চাঁদা বাঁধা। ‌

দলীয় প্রার্থীর হয়ে প্রচারে নেমেছে বিজেপি-ও।

বিদায়ী তৃণমূল সাংসদ পার্থপ্রতিম রায়কে নিয়েও নিশীথের বক্তব্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘‘পার্থবাবু ভাল মানুষ। তিনি অনেক কিছু করেছেন কোচবিহারের মানুষের জন্য। অনেক কিছু করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু হয়তো দলের চাপে করতে পারেননি। তিনি রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ। তিনি রাজবংশীদের জন্য কিছু কাজ করতে চেয়েও করতে পারেননি। আমি জিতলে সেই কাজগুলো করব।” কোচবিহারের তৃণমূল কর্মীদের দাবি, ভাল সংগঠক পার্থ রায়ের এ বারের ভোট প্রচারে যেন আবেগের অভাব। যদিও পার্থবাবুর দাবি, তিনি দলের সৈনিক যেমন ছিলেন, এখনও তেমনই আছেন।

কোচবিহার শহরেই কথা হচ্ছিল অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক পল্লব সেনগুপ্তের সঙ্গে। তিনি বলেন, পরেশ চন্দ্র অধিকারীর উপর মানুষের ক্ষোভ বাম থেকে তৃণমূলে আসা নিয়ে নয়। বরং শহরাঞ্চল এবং গ্রামাঞ্চলেরও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে অনেক বড় ইস্যু— পরেশ যোগ্য ছেলে-মেয়েদের যে ভাবে বঞ্চিত করে নিজের মেয়েকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। তাঁর কথার রেশ ধরেই কোচবিহার শহরের সাগরদিঘি এলাকার এক সরকারি কর্মী বলেন, ‘‘ব্যক্তি পরেশ প্রার্থী হিসাবে এখানকার মানুষের কখনও প্রথম পছন্দের নন। তাঁকে ভোট বৈতরণী পার করতে পারে তৃণমূলের সার্বিক সংগঠন এবং রবি ঘোষ।”

কিন্তু আনোয়ারের মত পুরনো রাজনৈতিক কর্মীদের দাবি, এক সময়ে শাসক দলের ডাঙড় বাহিনী সামলানো নিশীথকে কোন ডাঙড় দিতে সামলাবেন রবি, তার উপর নির্ভর করছে ভোটের ফল। জেলা তৃণমূলের এক নেতা সোমবার রাতে বলেন, ‘‘রাসমেলা ময়দানে সভা শেষে মুখ্যমন্ত্রীর চেহারা দেখে মনে হল, তিনি আদৌ সন্তুষ্ট হতে পারেননি কোচবিহারের শেষ বেলার ভোট প্রস্তুতি দেখে।” অন্য দিকে দিনহাটা, সিতাইয়ের বহু পূর্ব পরিচিত যাঁরা ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে তৃণমূলে গিয়েছিলেন এবং এখন নিশীথের হাত ধরে বিজেপি করছেন, তাঁদের কথায়, ‘‘আমরা চাই বেশ কিছু জায়গায় ভোটের দিন কেন্দ্রীয় বাহিনী না থাকুক।” শুনে মনে হল রাস্তা ঘাটে উড়ে বেড়ানো কথাই ঠিক— এ বার বুনো ওল আর বাঘা তেঁতুলের লড়াই।

—নিজস্ব চিত্র।

(পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেবাংলায় খবরজানতে পড়ুন আমাদেররাজ্যবিভাগ।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE