পশ্চিমবঙ্গে হামলা চালানোর জন্য সুন্দরবনের অরক্ষিত অঞ্চলকে ব্যবহার করতে পারে জঙ্গিরা। শুক্রবার এক বৈঠকে এমনই আশঙ্কা করেছেন কেন্দ্রীয় এবং নৌ-সেনার গোয়েন্দারা। তাঁদের মতে, সুন্দরবনে যে ৪৮টি দ্বীপে মানুষ বসবাস করে না, সেগুলিকেও নিজেদের সাময়িক আস্তানা হিসেবে কাজে লাগাতে পারে দেশবিরোধী সংগঠনগুলি। নদী, খাঁড়ি এবং নালায় ভর্তি সুন্দরবনকে কী ভাবে আরও নিরাপদ করে তোলা যায়, তা নিয়েও ওই বৈঠকে আলোচনা হয়েছে বলে গোয়েন্দা সূ্তের খবর। দীর্ঘ বৈঠকে কয়েকটি পদক্ষেপের কথা স্থির করা হলেও তা কত দ্রুত কার্যকর হবে, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন রয়েই গিয়েছে।
২০০৮ সালে মুম্বই হামলায় সমুদ্রপথে মাছধরা নৌকোয় চেপে এ দেশে ঢুকেছিল পাক জঙ্গি আজমল কাসভ ও তার দলবল। হামলার তদন্তে নেমে এ কথা জানার পরেই উপকূলীয় নিরাপত্তার উপরে জোর দেয় কেন্দ্র। উপকূলরক্ষী বাহিনীকে নোডাল এজেন্সি হিসেবে চিহ্নিত করে রাজ্য পুলিশ, নৌ-সেনা, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ব্যুরো (আইবি)-সহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীকে নিয়ে সমন্বয়ের কথা বলা হয়। শুক্রবার নিউ টাউনে উপকূলরক্ষী বাহিনীর কলকাতা সদর দফতরে তেমনই একটি বৈঠকে বসেছিলেন গোয়েন্দা কর্তারা।
এক উপকূলরক্ষী বাহিনীর কর্তা জানান, বৈঠকে সুন্দরবন সংক্রান্ত আলোচনাই ছিল প্রধান। কারণ, গত কয়েক মাসে দেখা গিয়েছে, এই জলপথ দিয়েই চোরাশিকার এবং বিভিন্ন দেশবিরোধী কার্যকলাপ বাড়ছে। কিছু ক্ষেত্রে ধরপাকড় করা হলেও তা পুরোটা বন্ধ করা যায়নি। তার ফলে নিরাপত্তাও নিশ্ছিদ্র করা যায়নি। বাহিনীরই একাংশ বলছেন, মাস খানেক আগে দু’টি বাংলাদেশি ট্রলারকে পাকড়াও করা হয়েছিল। তারা জলসীমা ভেঙে অনেকটাই ভিতরে ঢুকে এসেছিল। এর আগেও এই এলাকা থেকে একাধিক বিদেশি নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। সুন্দরবনের খাঁড়িপথ বেয়ে চোরাশিকারী এবং অপরাধীদের যাতায়াত রয়েছে বলেও গোয়েন্দা সূত্রের খবর। “ এগুলি অনেক দিনেরই সমস্যা। কিন্তু রাজ্য জুড়ে সম্প্রতি আইএসআইয়ের নেটওয়ার্কের হদিস মেলার পর তা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে”, বলছেন এক সেনা-গোয়েন্দা কর্তা।
কেন সুন্দরবন এতটা অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে?
এক নৌ-সেনা অফিসার বলছেন, সুন্দরবনের মধ্যে মোট ১০২টি দ্বীপ রয়েছে। এর মধ্যে ৫৪টিতে মানুষ থাকে। গোটা এলাকায় জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে নদী-নালা-খাঁড়ি রয়েছে। এর মধ্যে কোনও এলাকার দায়িত্বে রয়েছে মেরিন পুলিশ, কোনও এলাকা আবার বিএসএফ-এর অধীনে। কিছু এলাকা আবার বন দফতরের সংরক্ষিত এলাকার আওতাধীন। একে জটিল ভৌগোলিক এলাকা, তার উপরে পাহারা দেওয়ার জন্য আলাদা আলাদা বাহিনী। সব মিলিয়ে পুরো বিষয়টিও ঘেঁটে রয়েছে।
নৌবাহিনীর এক কর্তা বলছেন, আগে বাংলাদেশ থেকে নদীপথে আসা জলযানগুলি সুন্দরবনের যে কোনও পথ দিয়ে সোজা এসে নামখানায় হাজির হতো। সেই সমস্যা এড়াতে শামসেরনগরে বিএসএফ চৌকি করা হয়েছে। সেখানেই বিএসএফ এবং কাস্টমস অফিসারেরা ওই জলযানগুলি পরীক্ষা করেন। এবং তার পরে একটি নির্দিষ্ট পথ দিয়ে তারা ভারতে ঢোকে। “কিন্তু জঙ্গিরা তো আর ওই পথ ব্যবহার করবে না। সমস্যাটা সেখানেই”, বলছেন ওই নৌসেনা-কর্তা।
গোয়েন্দাকর্তাদের ব্যাখ্যা, এই ধরনের এলাকার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে তথ্য আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে সমন্বয় থাকা জরুরি। তা না হলে সীমান্ত পারাপারের ক্ষেত্রে আরও ফাঁকফোকর তৈরি হবে। সুন্দরবনের একটি সুসংহত মানচিত্র তৈরি হওয়া জরুরি। এক গোয়েন্দাকর্তা বলেন, “সুন্দরবনের বহু এলাকা তো আমরাই ঠিক মতো চিনি না।” পাশাপাশি বিএসএফের পাশাপাশি রাজ্য পুলিশের টহলদারি বাড়াতে বলা হয়েছে।
নৌ সেনা ও উপকূলরক্ষী বাহিনীর একাংশ বলছেন, এ রাজ্যের মেরিন পুলিশের পরিকাঠামোগত ত্রুটি রয়েছে। তার ফলে টহলদারি নিয়মিত হয় না। বহু ক্ষেত্রেই টহলদার নৌকোগুলি পড়ে থাকে। এক নৌ-সেনা অফিসার বলছেন, “মেরিন পুলিশের অফিসারেরা বলেন, নৌকোর জন্য তেল মেলে না। কোথাও কর্মীসংখ্যা কম।” মেরিন পুলিশের যে সমস্যা রয়েছে, তা মেনে নিয়েছেন রাজ্য পুলিশের অনেক কর্তাও। তবে তাঁদের যুক্তি, উপকূলীয় নিরাপত্তা জোরদার করতে দ্বিতীয় দফার কাজ শুরু হয়েছে। আশা করা যায়, খুব শীঘ্রই এই সমস্যাগুলি দূর হবে।
এই বৈঠকের নোডাল এজেন্সি উপকূলরক্ষী বাহিনীর মুখপাত্র অ্যাসিস্ট্যান্ট কম্যান্ডান্ট অভিনন্দন মিত্র বলেন, “সব সমস্যা নিয়েই আলোচনা হয়েছে। গোয়েন্দা সমন্বয় গড়ে তোলার পাশাপাশি সুন্দরবনের একটি সুংসহত মানচিত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy