উদ্বেগে মৃত্যু: পরিবারের দাবি, নাগরিক পঞ্জির নথি জোগাড় করতে না পেরে আত্মঘাতী হয়েছেন শিবনগরের যুবক মিলন মণ্ডল। মঙ্গলবার তাঁর শোকস্তব্ধ পরিবারের পাশে পড়শিদের ভিড়। নিজস্ব চিত্র
লাইনটা এঁকেবেঁকে ছায়া খুঁজছে। কোথাও রাস্তায় আঁকিবুঁকি কেটে যানজট, কোথাও বা হুহু মাঠে রোদ মেখে সর্পিল। প্রশানিক কর্তারা বলছেন— একেই বলে এনআরসি’র (নাগরিকপঞ্জি) জুজু।
সপ্তাহ দুয়েক আগেই পড়শি অসমে নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হয়ে গিয়েছে। বাদ পড়েছেন প্রায় বিশ লক্ষ মানুষ। যাঁদের কেউ তিন পুরুষের ভিটেতে বাস করছেন। কেউ বা আজন্ম, ভূমিপুত্র। কিন্তু যথাযথ নথিপত্র না থাকায় দেশের নাগরিকত্বের প্রশ্নে তাঁদের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রশ্নচিহ্ন।
সেই ছায়ায় ঘুম ছুটেছে বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা মুর্শিদাবাদের অগুন্তি গ্রামেরও। আধার কার্ড, রেশন কার্ড, ভোটার কার্ডে নাম-ঠিকানা-বয়সের সংশোধন করতে লোকজনের উপচে পড়া ভিড় জমেছে বিডিও অফিস, ভুমি রাজস্ব দফতর, ডাকঘর ও ব্যাঙ্কে। আধার কার্ডের জন্য আগের রাত থেকে লাইন দিয়ে অনেকেই সকালে লাইন দিচ্ছেন রেশন কার্ডের জন্য।
জেলা খাদ্য সরবরাহ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ৯ সেপ্টেম্বর থেকে রাজ্য জুড়ে নতুন রেশন কার্ড, রেশন কার্ডের সংশোধনের জন্য আবেদন গ্রহণ করা হচ্ছে। ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সে আবেদন গ্রহণ করা হবে। মঙ্গলবার পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ জেলায় ২ লক্ষ ২৯ হাজার আবেদন জমা পড়েছে।
রাজ্যে শীর্ষে রয়েছে এই জেলা। তার মধ্যে এই জেলায় শুধুমাত্র রেশন কার্ডে নাম, ঠিকানা, সংশোধনের জন্য (৫ নম্বর ফর্ম) ৯৪ হাজার আবেদন জমা পড়েছে। ভূমি ও ভূমি সংস্কার অফিসগুলিতেও ভিড় জমাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তাঁদের দাবি, ১৯৭১ সালের রেকর্ড।
সূত্রের খবর, শুধুমাত্র মঙ্গলবার বহরমপুরের ব্লকে ১৯৬০ সালের আরএস রেকর্ড পাওয়ার জন্য ৮০০ আবেদন জমা পড়েছে। জেলার প্রায় সব ব্লকেই আরএস রেকর্ডের জন্য আবেদন জমা পড়ছে হুহু করে।
বহরমপুর ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারীক প্রিয়ব্রত রাঢ়ী বলছেন, ‘‘গত কয়েক দিন থেকে দেখছি জমির রেকর্ডের পাহাড় জমে গিয়েছে। আবেদনকারীদের একটা বড় অংশ ১৯৬০ সালের রেকর্ড চাইছেন।’’
কম্পিউটার সেন্টারে গিয়ে লোকজন অনলাইনের নানা নথির খোঁজ করছেন। ১৯৭১ সালের আগে নথি মিলবে কি না সে সব নিয়ে আলোচনা চলছে পাশের চায়ের দোকানে। দু’দিন আগের নিঝুম চায়ের দোকান এখন গভীর রাতে
ঝাঁপ ফেলছে।
আধার কার্ড করতেও লম্বা লাইন পড়ছে। তিন দিন আগে লাইনে দাঁড়িয়ে আধার কার্ডের কাজ করাতে পারেননি এমনও উদাহরণ রয়েছে। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার মির্জাপুর থেকে বহরমপুর মুখ্য ডাকঘরে শনিবার থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ইমারুল শেখ। বলছেন, ‘‘বৃষ্টি হোক, রোদ্দুর হোক আধার কার্ড সংশোধনটা করাতেই হবে। জানেন, বাড়ি ছেড়ে হোটেলে পড়ে আছি চার দিন, একেবারে কাজ করিয়ে ফিরব।’’
সাগরদিঘির চর কাবিলপুর থেকে আধার কার্ড সংশোধন করতে আসেন হাসিম আব্দুল হালিম। বৃহস্পতিবার থেকে এক ভাবে লাইনে থেকে তিতিবিরক্ত হয়ে বলছেন, ‘‘কী আর করব, আধার কার্ড সংশোধন না হলে ভিটে ছাড়া হবে, চলে যাব!’’
হরিহরপাড়ার রাজনগরের বাসিন্দা সাহিনা আকতার বলছেন, ‘‘ভোটার কার্ড, আধার কার্ডে নাম রয়েছে সাহিনা আকতার। কিন্তু রেশন কার্ডে রয়েছে সাহিনা খাতুন। শুনছি এনআরসি চালু হলে সমস্যা হবে। তাই হত্যে দিয়ে পড়ে আছি।’’
হরিহরপাড়ার পীরতলার পঞ্চাশোর্ধ মুক্তার হোসেন বলেন, ‘‘আমাদের পরিবারের বিভিন্ন কাগজে নাম পদবি এক এক রকম রয়েছে। শুনছি কাগজপত্র ঠিক না হলে ভুগতে হবে। তাই ভেবে রাতের ঘুম ছুটেছে। এনআরসি হলে যাতে বাংলা ছেড়ে চলে যেতে না হয় তার জন্য নাম ঠিক করতে বিডিও অফিসে এসেছি।’’
ভয়ের ভ্রুকুটি তাড়াতে প্রশান এ বার নড়েচড়ে বসেছে। মানুষকে সচেতন করতে মঙ্গলবার বেলডাঙা ১ ব্লক প্রশাসন ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান ও পঞ্চায়েত সমিতির কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। কিন্তু তাতে কি ভয় কাটে, শক্তিপুরের রমজান আলি বলছেন, ‘‘ঘরবাড়ি ছাড়তে বড় ভয় বাবু, আর ছিন্নমূল হতে পারব না!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy