Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
জমছে অনাদায়ী ঋণ

আলু চাষের ক্ষতিতে বিপাকে সমবায়ও

ফি বছর মাঠ থেকে আলু ওঠার পরেই চাষিদের মধ্যে সমবায় সমিতির ঋণ শোধ করার হিড়িক পড়ে যায়। কারণ সময়ের মধ্যে ধার মিটিয়ে দিতে পারলে তিন শতাংশ সুদ কম দিতে হয়। ধার মেটানোর পরে অনেকেই ফের ঋণের আবেদন করেন। তা মঞ্জুরও হয়।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৫ ০২:৫৯
Share: Save:

ফি বছর মাঠ থেকে আলু ওঠার পরেই চাষিদের মধ্যে সমবায় সমিতির ঋণ শোধ করার হিড়িক পড়ে যায়। কারণ সময়ের মধ্যে ধার মিটিয়ে দিতে পারলে তিন শতাংশ সুদ কম দিতে হয়।

ধার মেটানোর পরে অনেকেই ফের ঋণের আবেদন করেন। তা মঞ্জুরও হয়। ধানের টাকায় আলু, আলুর টাকায় ধান— এ রাজ্যের দু’ফসলি চাষের বিস্তীর্ণ এলাকায় দীর্ঘ দিন ধরে এই রীতিই চলে আসছে।

তবে এ বার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো। একে তো আগের মরসুমে ন্যায্য মূল্যে ধান বিক্রি করতে না পেরে চাষিরা মার খেয়েছিলেন। তার উপরে আলুর অতিফলন ও সামাল দেওয়ার মতো সংরক্ষণ বা বিপণনের ব্যবস্থা না থাকায় পথে বসেছেন বহু চাষি।

ইতিমধ্যেই একের পর এক চাষির আত্মহত্যার ঘটনা সামনে আসছে। দায় এড়াতে প্রশাসন কখনও দাবি করছে, নিছক পারিবারিক অশান্তির জেরে এই অপঘাত। কখনও দাবি করছে, যিনি আত্মঘাতী হয়েছন, তিনি আদৌ চাষি নন। চাষিরা আত্মঘাতী হতে পারেন এমন কোনও বিপর্যয় ঘটেনি।

কিন্তু রাজ্যের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কৃষি সমবায়গুলির অনাদায়ী ঋণের পরিমাণই বলে দিচ্ছে বাস্তবটা আসলে কী। সাধারণত কিষান ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সমবায় সমিতির কাছ থেকে ঋণ নেন চাষিরা। খরিফ মরসুমের ঋণ শোধ করতে হয় ৩১ মার্চের মধ্যে। রবি মরসুমের ঋণ শোধ করার শেষ তারিখ ৩১ অগস্ট। নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ শোধ করতে পারলে বার্ষিক সাত শতাংশের জায়গায় চার শতাংশ হারে সুদ দিতে হয়। স্বাভাবিক ভাবেই, চাষিরা সেই সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না।

কিন্তু ধান-আলুর জোড়া ধাক্কায় এ বার সমবায়মুখোই হচ্ছেন না বেশির ভাগ চাষি। বর্ধমান জেলার বিভিন্ন সমবায় সমিতি চাষের মরসুমে ৫০ লক্ষ টাকা থেকে শুরু করে তিন কোটি টাকারও বেশি ঋণ দেয়। সব সমবায়েরই মাথায় হাত পড়েছে। তিন পঞ্চায়েত এলাকা নিয়ে গঠিত কালনা ২ ব্লকের সিএডিপি ফার্মাস সার্ভিস কো-অপারেটিভ সোসাইটির সম্পাদক বনমালী মণ্ডল বলেন, “আমরা সাড়ে তেরোশো চাষিকে প্রায় দু’কোটি টাকা ঋণ দিয়েছি। আলু চাষের জন্য দেড় কোটি টাকা। অন্য বার চাষিরা এই সময়ে অনেকটাই শোধ করে দেন। এ বার তা হয়নি। আলুর দর না থাকায় আমরা জোরও করতে পারছি না।”

হুগলিতে দু’শোরও বেশি কৃষি সমবায় রয়েছে। তার মধ্যে কৃষিপ্রধান ব্লকগুলিতে যে সব সমবায়, সেগুলির হাল বেশি খারাপ। তারকেশ্বরের বালিগড়ি মহেশপুর সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতি এ বার আমন ধান ও আলু চাষের জন্য তিন কোটি ২০ লক্ষ টাকার ঋণ দিয়েছিল। ওই সমবায়ের সম্পাদক দেবীপ্রসাদ রক্ষিত জানান, প্রাথমিক ভাবে চাষিরা ধানের কিছু ঋণ শোধ করেছিলেন। কিন্তু যাঁরা আশায় ছিলেন, আলু বিক্রি করে ধানের দেনা পরিশোধ করবেন, তাঁরা অথৈ জলে পড়েছেন। গত ফেব্রুয়ারি থেকেই কার্যত কোনও ঋণ শোধ করতে পারেননি চাষিরা।

জলপাইগুড়ি কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের তরফে মাধব ভট্টাচার্য জানান, পাট ও আলু মিলিয়ে এই মরসুমে সাড়ে দশ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিলেন। গত বছর এই সময়ের মধ্যে অধিকাংশ ঋণ শোধ হয়ে গিয়ে থাকলেও, এ বছর মাত্র দু’কোটি টাকা মতো ফেরত এসেছে। “এখনও বকেয়া আদায়ের সময় রয়েছে, তবে শেষ অবধি সামান্যই মিলবে বলে মনে হচ্ছে,” বললেন মাধববাবু।

বাঁকুড়া ২ ব্লকের কষ্টিয়া সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতির ম্যানেজার প্রবোধ রানা জানান, আলু চাষের জন্য তাঁরা জনা চল্লিশ চাষিকে ১৫ লক্ষ টাকা ঋণ দিয়েছিলেন। এখনও এক টাকাও ফেরত আসেনি। গঙ্গাজলঘাটি ব্লকের ভট্টপাড়া সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতির দশা একই। ওন্দা ব্লকের পাহাড়পুর সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতি প্রায় দু’শো আলু চাষিকে ৬০ লক্ষ টাকা ঋণ দিয়েছিল। টাকা ফেরত পায়নি। সমিতির ম্যানেজার অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “টাকা চাইতে গেলে চাষিরা আমাদের আলু কিনে নিতে বলছেন। কিন্তু আমাদের হাতেও আলু কেনার মতো টাকা নেই।”

আলিপুরদুয়ার জেলায় কিষান ক্রেডিট কার্ড ছাড়াও ৫১১৭ জন চাষিকে ৩৯ কোটি ৫৮ লক্ষ টাকা ঋণ দিয়েছে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক। তবে টাকা শোধ এখনও সে ভাবে হচ্ছে না। কয়েক কোটি টাকা আলু চাষের জন্য ঋণ দিয়েছে বেশ কিছু ব্যাঙ্ক। মেদিনীপুর সদরের মণিদহ কৃষি উন্নয়ন সমিতি আলুচাষের জন্য প্রায় ২৪ লক্ষ টাকা ঋণ দিয়েছে। ঋণ শোধ কার্যত হয়নি বললেই চলে। শালবনির তিলাখুল্যা সমবায় সমিতি প্রায় ১২ লক্ষ টাকা ঋণ দিয়েছে। সমিতির অন্যতম কর্তা প্রশান্ত সানি বলেন, “সময়ে ঋণ শোধ না হলে কৃষির পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজও তো আটকে যায়।”

বস্তুত, সমবায় সমিতিগুলি নিজের তহবিল থেকে সামান্য ঋণই দেয়। বাকিটা জেলার কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিতে হয়। চাষিরা টাকা ফেরত দিলে সমিতিগুলিও ঋণশোধ করে। চাষিরা ঋণশোধ না করায় তা-ও আটকে যাচ্ছে। মেদিনীপুরের এক সমবায় সমিতির কর্তার কথায়, “কৃষকদের সমস্যার কথা বুঝতে পারি। কিন্তু সমিতির সমস্যার কথাও তো বুঝতে হবে। বেশি পরিমাণ টাকা অনাদায়ী থেকে গেলে সমিতি কাজ করবে কী করে?”

এর পরেও অবশ্য সমবায় সমিতি চাষিদের চাপ দিতে চাইছে না। কালনা ১ ব্লকের মির্জাপুর সমবায় সমিতির ম্যানেজার জাকির হোসেন মোল্লা বলেন, “আমরা ৬০ লক্ষ টাকারও বেশি ঋণ দিয়েছি চাষিদের। আদায় নেই বললেই চলে। কিন্তু চাষিদের যা দুর্দশা, টাকা চাইতে বিবেকে লাগছে।” আরামবাগের এক সমবায়ের কর্তা বলেন, “যে হারে চাষিরা আত্মঘাতী হচ্ছেন, কোন মুখে তাঁদের ঋণ পরিশোধের কথা বলব?”

দেনায় আকণ্ঠ ডুবে যাওয়া চাষিদের বাড়তি সমস্যা, ঋণশোধ না করার তালিকায় তাঁদের নাম উঠে যাওয়ায় পরের বার ঋণ পেতে তাঁরা সমস্যায় পড়বেন। তখন চড়া সুদে তাঁদের টাকা ধার করতে হবে মহাজনদের থেকে, নইলে পাড়ার দোকানে দীর্ঘ দিন দাম বাকি রেখে সার, কীটনাশকের ব্যবস্থা করতে হবে। একবার বড়সড় ক্ষতি হলে এ ভাবেই সমবায়ের সঙ্গে চাষিদের সম্পর্কের ছন্দটা ছিন্ন হয়ে যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE