Advertisement
০৮ মে ২০২৪
অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা

ছেলেকে পিটিয়ে মারল ওরা, বৃথা কান্না মায়ের

লোকগুলোর পায়ে পড়ে আছাড়িপিছাড়ি কাঁদছিলেন মা— ‘‘ওকে ছেড়ে দাও গো। এ ভাবে মারলে মরে যাবে! ও কেন মোষ চুরি করতে যাবে? ও তো কলেজে পড়ে।’’

কৌশিক পুরকাইতের (ইনসেটে) শোকার্ত মা চন্দ্রাদেবী।

কৌশিক পুরকাইতের (ইনসেটে) শোকার্ত মা চন্দ্রাদেবী।

দিলীপ নস্কর
ডায়মন্ড হারবার শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৬ ০৪:৩৩
Share: Save:

লোকগুলোর পায়ে পড়ে আছাড়িপিছাড়ি কাঁদছিলেন মা— ‘‘ওকে ছেড়ে দাও গো। এ ভাবে মারলে মরে যাবে! ও কেন মোষ চুরি করতে যাবে? ও তো কলেজে পড়ে।’’

লোকগুলো উল্টে মায়েরই চুলের মুঠি ধরল। হিড়হিড় করে টেনে সরিয়ে দিতে দিতে লাগিয়ে দিল দু-চার ঘা।

তেইশ বছরের ছেলে তখন পড়ে রয়েছে নিঃসাড়। মুখ-চোখ ঢেকে রক্তের স্রোত। তবু উন্মত্তের মতো পিটিয়েই চলেছে পাশের পশ্চিমপাড়া গ্রামের একদল লোক। বলছে, তাদের গ্রামে কালীপুজোয় বলির জন্য কিনে আনা মোষটা নাকি চুরি করেছে এই ছেলেই। বাঁচাতে এসে মায়ের সঙ্গে মাসিও তখন বেদম মার খাচ্ছেন। ভারী টর্চ দিয়েও তাঁদের মারতে কসুর করছে না জনতা। ডায়মন্ড হারবারের পূর্বপাড়া গ্রামে এই মাসির বাড়িতেই গৃহপ্রবেশের নেমন্তন্ন খেতে আসা। হঠাৎ ঘিরে ধরল লোকগুলো। পেটাতে পেটাতে নিয়ে এল পশ্চিমপাড়ায়।

এ বার মাকে দিয়ে সাদা কাগজে লেখানো হল মুচলেকা— ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আলুথালু মা সই করে দিলেন। মার থামল। রক্তে মাখামাখি কৌশিক পুরকাইত ওরফে শুভকে পাঁজাকোলা করে তুলে ডায়মন্ড হারবার জেলা হাসপাতালে নিয়ে গেলেন বাড়ির লোকেরা। আশা দিলেন না ডাক্তারবাবুরা। অগত্যা গভীর রাতে এম আর বাঙ্গুর হাসপাতাল। গড়িয়াহাটের আইটিআই কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রের প্রাণ বেরিয়ে
যায় সেখানেই।

সোমবার রাতের এই ঘটনায় নাম জড়িয়েছে স্থানীয় হরিণডাঙা গ্রামের তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য তাপস মল্লিকের। অভিযোগ, কৌশিককে পেটানোর সময়ে ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনিই। মৃতপ্রায় ছাত্রের মাকে দিয়ে মুচলেকা লেখানোর ফরমানটাও নাকি তাঁরই দেওয়া। ঘটনার পর ডায়মন্ড হারবার থানায় এফআইআর দায়ের হয়েছে তাপস-সহ ১০ জনের বিরুদ্ধে। এক মহিলাকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। জেরা করা হচ্ছে চার জনকে।

অথচ তাপসের খোঁজ মিলছে না! অন্তত পুলিশের তা-ই দাবি। যা শুনে কেউ কেউ বলছেন, এ তো সেই গত পাঁচ বছরের ফ্ল্যাশব্যাক। একটা খুন বা অসামাজিক কাজকর্ম। তাকে ঘিরে তৃণমূলের কোনও নেতার নাম উঠে আসা। এবং অবধারিত ভাবে পুলিশের তাঁকে নাগালে না পাওয়া। কাজেই এ বারেও অনেকে আশঙ্কা করছেন, নির্বাচন কমিশনের চাপের মুখে দিন কয়েক আগে শিরদাঁড়া ‘খুঁজে পাওয়া’ রাজ্য পুলিশ ভোট মিটতেই পুরনো ফর্মে ফিরছে না তো! জেলা পুলিশের এক কর্তা অবশ্য আশ্বাস দিচ্ছেন, ‘‘দোষীরা সকলেই ধরা পড়বে।’’

বছর পঁয়তাল্লিশের তাপস ডায়মন্ড হারবার ডকে আইএনটিটিইউসি ইউনিয়নের ক্যাশিয়ার। সম্প্রতি একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কর্মী নিয়োগ নিয়ে গণ্ডগোলে ম্যানেজারকে পিটিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সে বারও পুলিশ তাঁর টিকি ছুঁতে পারেনি। স্থানীয়দের দাবি, ডায়মন্ড হারবারের তৃণমূল নেতা তুষার হালদার, ব্লক সভাপতি উমাপদ পুরকাইতদের ছত্রচ্ছায়াতেই তাপসের এমন বাড়বাড়ন্ত। উমাপদবাবু এ দিন তাপসসম্পর্কে কোনও মন্তব্য করতে
চাননি। বলেছেন, ‘‘পুলিশ প্রকৃত অপরাধীদের ধরুক।’’

থমথমে পূর্বপাড়া গ্রামের বাসিন্দারা এ দিন সংবাদমাধ্যমের কাছে নিজেদের পরিচয় দিতে চাননি। তবে জানিয়েছেন, এলোপাথাড়ি মারধরে কৌশিক নেতিয়ে পড়লেও তাপস মল্লিকের নেতৃত্বে মারধর কমার লক্ষণ ছিল না।

মন্দিরবাজারের গুমকি গ্রামে কৌশিকের বাড়ি। মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা ছোট ব্যবসায়ী। কলেজে যাতায়াতের অসুবিধে হওয়ায় ডায়মন্ড হারবারের নাইয়াপাড়ায় মেসবাড়িতে থাকতেন। সোমবার, অক্ষয় তৃতীয়ায় মাসির বাড়িতে গৃহপ্রবেশ ছিল। কৌশিক ও তাঁর মা চন্দ্রাদেবী এসেছিলেন পূর্বপাড়ায়। পুলিশে দায়ের করা অভিযোগে বাড়ির লোকেরা জানিয়েছেন, রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ মাসির বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা দূরে গাছতলায় বসে ফোনে কথা বলছিলেন কৌশিক। হঠাৎই সেখানে লাঠিসোঁটা হাতে হাজির হয় পশ্চিমপাড়ার কিছু লোক। তারা দাবি করে, সামনেই তাদের গ্রামে কালীপুজো। অথচ বলির জন্য কিনে আনা মোষটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এলাকায় অপরিচিত মুখ কৌশিককে জেরা শুরু করে তারা। কৌশিক বলার চেষ্টা করেছিলেন, তিনি মাসির বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। মাসি-মেসোর পরিচয়ও দেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা!

চড়-থাপ্পড় মারতে মারতে কৌশিককে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিমপাড়ায়। ইতিমধ্যে ওই গ্রামেরই কিছু লোক কৌশিকের মেসো সত্য হালদারের বাড়ি খুঁজে বের করে তাঁকে খবর দেন। মা চন্দ্রাদেবী, তাঁর বোন ছন্দাদেবী পড়িমড়ি করে ছোটেন পশ্চিমপাড়ায়। তার পর ঘণ্টা দুয়েক মায়ের সামনেই ছেলেকে পিটিয়ে চলে উন্মত্ত জনতা।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কৌশিকের দেহ নিয়ে কয়েক হাজার মানুষের মিছিল বেরোয় ডায়মন্ড হারবার শহরে। দোষীদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবিতে সেখানে হাজির ছিলেন স্থানীয় সিপিএম নেতারা। থানার সামনে বিক্ষোভও দেখানো হয়। পরে থানায় আসেন সিপিএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এটা মানুষের নয়, জানোয়ারের কাজ।’’

মোষটাকে অবশ্য খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল ওই রাতেই। সে দড়ি ছিঁড়ে পালিয়েছিল। পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দারা যত ক্ষণে ‘আসল’ ব্যাপারটা বুঝেছেন, নিথর কৌশিক তত ক্ষণে রওনা দিয়েছেন লাশকাটা ঘরের দিকে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mother Son
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE