Advertisement
১১ মে ২০২৪

ডিএ বকেয়ায় হাফ সেঞ্চুরি রাজ্যের

পিছনের দিকে আরও এক ধাপ এগোল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। বুধবার কেন্দ্রীয় সরকার তাদের কর্মীদের জন্য আরও ৬ শতাংশ মহার্ঘভাতা (ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স, সংক্ষেপে ডিএ) ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বকেয়ার দৌড়ে হাফ সেঞ্চুরির গণ্ডি অতিক্রম করল।

শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:১৪
Share: Save:

পিছনের দিকে আরও এক ধাপ এগোল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। বুধবার কেন্দ্রীয় সরকার তাদের কর্মীদের জন্য আরও ৬ শতাংশ মহার্ঘভাতা (ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স, সংক্ষেপে ডিএ) ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বকেয়ার দৌড়ে হাফ সেঞ্চুরির গণ্ডি অতিক্রম করল। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের তুলনায় রাজ্য সরকারের কর্মীরা ৫৪% ডিএ কম পাবেন। যা গোটা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ (গ্রাফিক্স দেখুন)

দুই সরকারের কর্মীদের মাইনের ফারাক কী রকম?

যুগ্মসচিব পদমর্যাদার এক জন আইএএস এবং এক জন ডব্লিউবিসিএস অফিসারের কথাই ধরা যাক। নবান্নে পাশাপাশি ঘরে বসেন তাঁরা। প্রথম জনকে বেতন দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। দ্বিতীয় জন বেতন পান রাজ্য সরকারের থেকে। দু’জনের বেতনক্রম একই: মূল বেতন: ৩৭০০০-৬০০০০, গ্রেড পে ৮৭০০। অর্থাৎ, এই পদে চাকরির শুরুতে দু’জনেই বেসিক ও গ্রেড পে মিলিয়ে ৪৫ হাজার ৭০০ টাকা পান। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বাড়ি ভাড়া আর ডিএ। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের দেওয়া বাড়ি ভাড়ায় ফারাক রয়েছে। কিন্তু সব চেয়ে ফারাক মহার্ঘভাতায়। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এখন থেকে ডিএ পাবেন ১১৯ শতাংশ। আর রাজ্য সরকারি কর্মচারী ৬৫ শতাংশ। ফলে এক পদে চাকরি করেও দু’জনের ডিএ-র ফারাক দাঁড়াচ্ছে মাসে ২৪ হাজার ৬৭৮ টাকা। বেতনক্রমের শেষপ্রান্তে এলে পার্থক্যটা দাঁড়াবে ৩৭ হাজার ৯৮ টাকা। সরকারি চাকরিতে সর্বনিম্ন পদ গ্রুপ ডি-দের ক্ষেত্রে বেতনক্রমের শুরুতে এই ব্যবধান হবে মাসে ২৮০০ টাকা।

ডিএ-র এমন ফারাক নিয়ে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ক্ষোভ ছিলই। বুধবার কেন্দ্রীয় সরকার আরও ৬ শতাংশ ডিএ ঘোষণার পরে তা স্বাভাবিক ভাবেই বেড়েছে। প্রকাশ্যে কিছু না-বললেও ক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মী সংগঠনের নেতারাও। সে কথা নবান্নের কর্তাদের কানেও পৌঁছেছে। তবু কোনও হেলদোল দেখা যায়নি তাঁদের মধ্যে! এ দিন দুপুরে মুখ্যমন্ত্রীর পৌরোহিত্যে অনুষ্ঠিত রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারিত হয়নি বলেই জানিয়েছেন একাধিক মন্ত্রী। ডিএ নিয়ে কথা বলতে চেয়ে ফোন এবং এসএমএস করা হয়েছিল অর্থমন্ত্রীকে। তিনি সাড়া দেননি। উত্তর এড়িয়েছেন তৃণমূল মহাসচিব তথা শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও।

তবে সরকারের এক কর্তা সেই পুরনো ব্যাখ্যাটাই শুনিয়েছেন— বাম জমানায় নেওয়া বিপুল ঋণ শুধতেই আয়ের বড় অংশ বেরিয়ে যাচ্ছে। বছরে এক কিস্তি ডিএ, বাৎসরিক বেতনবৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) ও বোনাস দেওয়ার পরে কোষাগারে বিশেষ কিছু অবশিষ্ট থাকছে না। তাঁর দেওয়া হিসেব অনুসারে কয়েক লক্ষ কর্মীকে এ বার বোনাস-এক্সগ্রাসিয়া দিতে চারশো কোটি টাকা লাগছে। পাশাপাশি মূল বেতনের ৩% হারে ইনক্রিমেন্ট দিতে মাসে ১০০ কোটি খরচের বাড়তি বোঝা চেপেছে। চলতি অর্থবর্ষে বেতন-পেনশন খাতে বরাদ্দও বেড়েছে ৭%। এই সব দায় মিটিয়ে হাতে যা পড়ে থাকছে, তাতে দু’কিস্তি ডিএ দেওয়া সম্ভব নয়। চলতি বছর জানুয়ারিতে এক কিস্তি (৭%) ডিএ ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। অর্থ দফতরের এক আধিকারিকের পর্যবেক্ষণ বলছে, পুজোর আগে তো বটেই, চলতি বছরে আর ডিএ-র আশা না-করাই ভাল। কারণ, বাম আমলে কেন্দ্রের ধাঁচে বছরে দু’বার ডিএ দেওয়ার প্রথা চালু থাকলেও নয়া জমানায় তা বছরে এক বারই দেওয়া হচ্ছে।

ফলে ফারাকও বাড়ছে লাফ দিয়ে। বাম আমলের শেষ বছরে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ডিএ-র ব্যবধান ছিল ১৬%। তার ১০% দেওয়ার সংস্থান ভোট অন অ্যাকাউন্টসে করে গিয়েছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত। নতুন সরকার সেই বকেয়া দেয়নি। তার পর বছরে এক বার করে ডিএ দেওয়ার প্রথা চালু হওয়ায় ব্যবধান এখন বেড়ে হল ৫৪%। অর্থ দফতরের আর এক আধিকারিক অবশ্য বলেন, ‘‘আগামী বছর এপ্রিল-মে’তে বিধানসভার ভোট হওয়ার সম্ভাবনা। তা ছাড়া, এ দিন কেন্দ্র ডিএ ঘোষণা করায় সরকারের উপর প্রবল চাপ তৈরি হয়েছে। তাই বাড়তি এক কিস্তি ডিএ মিললেও মিলতে পারে।’’ ঘটনাচক্রে ভোটের মুখে দাঁড়ানো বিহার এ দিনই, কেন্দ্রের ঘোষণার ঠিক পরেই, ৬% ডিএ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। বিহারে এক শতাংশও ডিএ বকেয়া ছিল না। তার পরেও কোনও ঝুঁকি নেননি মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার।

১০ লক্ষেরও বেশি কর্মচারী এবং পেনশনভোগীকে ডিএ দিতে রাজ্য সরকারের কী রকম খরচ হয়? অর্থ দফতরের আধিকারিকদের দেওয়া হিসেব অনুসারে ১% ডিএ দিতে মাসে ২৫ কোটি টাকা দরকার। ফলে বকেয়া ৫৪% মেটাতে হলে মাসে ১৩৫০ কোটি, বছরে ১৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা লাগবে।

কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এ দিন ৬% ডিএ দেওয়ার যে ঘোষণা করেছেন, তা গত ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে। কেন্দ্রের প্রেস বিজ্ঞপ্তি বলছে, ৫০ লক্ষ কর্মী এবং ৫৬ লক্ষ পেনশনভোগীকে এই সুবিধা দিতে নতুন বাজেট পেশের আগে পর্যন্ত আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) খরচ হবে ১১ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

ডিএ-র দৌড়ে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে একেবারে শেষে চলে আসায় মমতা সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছে বিরোধী দলগুলি। সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘‘খেলা-মেলা-ডোল বিলোতে এই সরকারের জুড়ি নেই। কিন্তু সরকারি কর্মী-সহ মানুষের ন্যায্য পাওনা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই।’’ এ দিন ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে বামেদের সভায় প্রায় সব বক্তাই ডিএ নিয়ে সরকারের সমালোচনা করেন।

বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যও বলেন, ‘‘রাজ্য সরকার মেতে আছে মেলা-খেলা-মোচ্ছবে। সে জন্য টাকার অভাব হয় না। অথচ কর্মীদের ডিএ দিতে ভাঁড়ারে টান পড়ে!’’ কংগ্রেস বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এই সরকারের ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই। কর্মীদের ডিএ দেওয়া হচ্ছে না, অথচ বন্‌ধে না-এলে বেতন কাটার ফতোয়া দেওয়া হচ্ছে।’’

সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছে সরকারি কর্মী সংগঠনগুলিও। কো-অর্ডিনেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনোজ গুহর দাবি, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নতুন রেকর্ড করলেন। এত কম বেতন আর কোনও রাজ্যের কর্মীরা পান না।’’ ডিএ-এর দাবিতে আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তাঁরা। কনফেডারেশন অব স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের নেতা মলয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘উৎসবের নামে কোটি কোটি টাকা খরচে সরকারের কোনও কার্পণ্য নেই। যত অভাব-অনটন কর্মীদের মহার্ঘভাতা এবং বেতন বৃদ্ধির বেলায়।’’ পশ্চিমবঙ্গ সরকারি কর্মচারী ইউনিয়ন (নবপর্যায়)-এর সাধারণ সম্পাদক সমীররঞ্জন মজুমদারের বক্তব্য, ‘‘ডিএ দেওয়া না-দেওয়ার সঙ্গে টাকা থাকা না-থাকার কোনও সম্পর্ক নেই। এটা একেবারেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।’’

তৃণমূলের কর্মী সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশনর আহ্বায়ক সৌম্য বিশ্বাসের অবশ্য দাবি, ‘‘গোটা বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীর নজরে আছে। তিনি যথাসময়েই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।’’ কাল, শুক্রবার নেতাজি ইন্ডোরে শাসক দলের কর্মী সংগঠনের সভায় থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে তিনি যাতে কিছু ঘোষণা করেন, সেই চেষ্টা চলছে বলে দাবি।

সরকারি সূত্রের খবর, গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো ১ জানুয়ারি কেন্দ্রে সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ বলবৎ হতে চলেছে। এতে কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের প্রাপ্তি এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। এ দিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখনও ষষ্ঠ বেতন কমিশনই গড়ে উঠতে পারেনি! ফলে মাস চারেক বাদে কেন্দ্রের কর্মীদের সঙ্গে রাজ্যের কর্মীদের বেতনের ফারাক ‘আকাশছোঁয়া’ হয়ে দাঁড়াবে বলেই গুঞ্জন নবান্নে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE