Advertisement
০৫ মে ২০২৪

আর্সেনিকে ছারখার পরিবার, নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ দম্পতি

প্রকল্প-পরিকল্পনা হয়েছে। কিন্তু আর্সেনিক দূষণ কি ঠেকানো গিয়েছে? কেমন আছেন আক্রান্তেরা?আর্সেনিকের বিষে এমন মৃত্যু আর সংসার ভাঙার ছবি উত্তর ২৪ পরগনার অনেক পরিবারেই। দেগঙ্গা ছাড়াও গাইঘাটা, হাবড়া, অশোকনগর, বসিরহাটের বিভিন্ন এলাকার জলে বিপজ্জনক মাত্রায় আর্সেনিক মিলেছে। সরকারি তথ্যই বলছে, দেগঙ্গারই কামদেবকাটি এলাকায় ১০ বছরে মারা গিয়েছেন ১৪ জন। একই সংখ্যায় মৃত্যু হয়েছে অশোকনগরের বিনিময়পাড়াতেও।

চিন্তামণি পাল এবং নিতাইচন্দ্র পাল। —নিজস্ব চিত্র।

চিন্তামণি পাল এবং নিতাইচন্দ্র পাল। —নিজস্ব চিত্র।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
দেগঙ্গা শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৮ ০৪:৫১
Share: Save:

বারো ঘর, এক উঠোনের কৃষক পরিবারে আগে এক হাঁড়িতেই চড়ত ৩২ জনের রান্না! সেই পরিবার এখন ছারখার।

১০ বছর আগে শেষের শুরু। বাড়ির জলেই যে বিষ, টের পাননি কেউ। পরপর মৃত্যু হয় পাঁচ জনের। মাসতিনেক আগে মারা যান পরিবারের ছোট ছেলে নন্দ পাল। গায়ে আর্সেনিক-দূষণের চিহ্ন নিয়ে প্রাণভয়ে ভিটে ছাড়েন বাকিরা। দেগঙ্গার চণ্ডালআটির ওই বাড়ি আগলে এখন শুধু পড়ে বৃদ্ধ নিতাইচন্দ্র পাল এবং তাঁর স্ত্রী চিন্তামণিদেবী। আর্সেনিকের জেরে দু’জনের শরীরেই তেমন সাড় নেই। তবু ভিটের ‘মারণ জল’ই খাচ্ছেন। বৃদ্ধার খেদ, ‘‘একসময় ভিটে গমগম করত। এক রোগ সব ছারখার করে দিল।’’

ওখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বাসা বেঁধেছেন পরিবারের অদ্বৈত পাল। এখানে ‘টাইম কল’-এর জল মেলে। আর্সেনিক থেকে ক্যান্সার হওয়ায় তাঁর বাঁ পা কেটে বাদ দিতে হয়েছে। ছেলে মধুসূদন বলেন, ‘‘কোনও সাহায্য পাননি বাবা। ভিটে-মাটি ছেড়ে কষ্টে দিন কাটছে।’’

আর্সেনিকের বিষে এমন মৃত্যু আর সংসার ভাঙার ছবি উত্তর ২৪ পরগনার অনেক পরিবারেই। দেগঙ্গা ছাড়াও গাইঘাটা, হাবড়া, অশোকনগর, বসিরহাটের বিভিন্ন এলাকার জলে বিপজ্জনক মাত্রায় আর্সেনিক মিলেছে। সরকারি তথ্যই বলছে, দেগঙ্গারই কামদেবকাটি এলাকায় ১০ বছরে মারা গিয়েছেন ১৪ জন। একই সংখ্যায় মৃত্যু হয়েছে অশোকনগরের বিনিময়পাড়াতেও।

তা সত্ত্বেও, সরকারি উদাসীনতা চরমে বলে অভিযোগ রাজ্য ‘আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ কমিটি’র। তাদের পরিসংখ্যান বলছে, এই জেলায় আক্রান্তের সংখ্যা লক্ষাধিক। মৃতের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়েছে। কমিটির রাজ্য সম্পাদক অশোক দাস বলেন, ‘‘মৃত্যুর কারণ হিসেবে হয়তো লেখা হয়েছে ক্যান্সার, লিভার, সিরোসিসের মতো রোগের। কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকেই আর্সেনিক আক্রান্ত ছিলেন।’’

কী বলছে প্রশাসন? জেলা জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার সঞ্জীব সরকারের দাবি, ‘‘জেলায় ২০০টি আর্সেনিকমুক্ত নলকূপ রয়েছে। ১০০টি নতুন বসানো হয়েছে। আরও ২০টি বসানো হবে।’’

কিন্তু মাঝেমধ্যেই আর্সেনিকমুক্ত নলকূপ খারাপ হয়। বিপাকে পড়েন গ্রামবাসী। সম্প্রতি দেগঙ্গার একটি স্কুলে ওই অভিযোগ ওঠায় নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। সঞ্জীববাবুর যুক্তি, নলকূপগুলির রক্ষণাবেক্ষণ এবং বিদ্যুৎ-বিলের টাকা স্কুল বা পঞ্চায়েতের দেওয়ার কথা। তা নিয়ে সমস্যায় মাঝেমধ্যে কিছু কল অকেজো হয়ে পড়ে থাকে। তবে এ ভাবে সমস্যার সমাধান করা যাবে না বলে মনে করেন অশোকবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘জেলায় আর্সেনিক সমস্যা যত তীব্র, তুলনায় ততটা সরকারি পরিষেবা নেই। সরকারি কলগুলিতে ভূ-স্তরের যেখান থেকে জল তোলা হচ্ছে, সেখানেও আর্সেনিক ছড়িয়েছে।’’

একসময় আর্সেনিকপ্রবণ এলাকাগুলিতে পলতা থেকে গঙ্গার জল শোধন করে সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল প্রশাসন। সেই প্রকল্প এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। অশোকনগরে আর্সেনিক আক্রান্ত এবং মৃত বাবুলাল তরফদারের বাড়ি গেলে শুনবেন, পরিবারের লোকেরা জানাবেন, মৃত্যুর আগে বাবুলাল বলতেন, ‘মাটির নীচে তেল, প্রত্নবস্তু মিললে সরকার লাফিয়ে পড়ে। কিন্তু আর্সেনিক-বিষ মিললে হাত
গুটিয়ে নেয়।’’

রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাংলায় খবর জানতে পড়ুন আমাদের রাজ্য বিভাগ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Arsenic Death Poison আর্সেনিক
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE