Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বস

টিম ডিরেক্টর হিসেবে ভারতীয় ক্রিকেটের মধ্যগগনে এখন এই রবি। আলিবাগে তাঁর বিলাসবহুল বাংলোয় একদিন কাটিয়ে আনন্দplus-এর জন্য লিখছেন তিরিশ বছরের বন্ধু-সাংবাদিক আয়াজ মেনন।টিম ডিরেক্টর হিসেবে ভারতীয় ক্রিকেটের মধ্যগগনে এখন এই রবি। আলিবাগে তাঁর বিলাসবহুল বাংলোয় একদিন কাটিয়ে আনন্দplus-এর জন্য লিখছেন তিরিশ বছরের বন্ধু-সাংবাদিক আয়াজ মেনন।

শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৪ ০১:০৫
Share: Save:

সেদিন রবির সঙ্গে আড্ডা মারতে মারতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি তা হলে এই মুহূর্তে ভারতীয় ক্রিকেটের সবথেকে শক্তিশালী লোক?’ প্রশ্নটা শুনে হেসেই ফেলল ভারতের প্রাক্তন অলরাউন্ডার। “এ তো তুমি টিভি অ্যাঙ্করদের মতো লোকতাতানো প্রশ্ন করছ! আমি একেবারে ফুট সোলজার - পদাতিক সৈন্য,” বলল রবি ।

আড্ডা হচ্ছিল ওর আলিবাগের ফার্ম হাউজে। গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া থেকে স্পিড বোটে প্রায় মিনিট কুড়ি যেতে হয়। এ জায়গাটা রবি কিনেছিল ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটে গ্ল্যামরগনের হয়ে খেলে রোজগার করা টাকা দিয়ে। তারপর নিজেই সেখানে বানিয়ে নিয়েছে এক বিলাসবহুল কান্ট্রি হোম। প্রাইভেট পুল, জিম, ক্রিকেট পিচ... কী নেই সেখানে!

সেই গা-ছাড়া পরিবেশে আরও আলসেমি আনতে যোগ হয়েছে ওর পোষা কুকুর। এক বছর আগেও তাদের সংখ্যা ছিল চার। তিনটে ল্যাব্রাডর- বাউন্সার, বিমার, ফ্লিপার আর একটা গোল্ডেন রিট্রিভার স্কিপার। দুঃখের ব্যাপার, মাস কয়েকের ব্যবধানে বাউন্সার আর বিমার মারা যায়। আর ইংল্যান্ড থেকে রবির ফেরার পরেই মারা যায় ফ্লিপার আর স্কিপারও।

কুকুরগুলো অনেক বছর বেঁচেছিল তাই হয়তো অতটা ট্রমা শাস্ত্রী পরিবারকে পেতে হয়নি। তাও পোষ্যবিয়োগের ব্যথাটা ছিলই। শাস্ত্রী তাই বাউন্সার আর বিমারের বদলে একই রংয়ের আর দুই ল্যাব্রাডর আনিয়েছে। আর তাদের নামও রেখেছে সেই আগের মতোই। খুব একটা অবাক হব না যদি ফ্লিপার আর স্কিপারও ফিরে আসে কোনও নতুন অবতারে।

“এটা আমার করা সেরা ইনভেস্টমেন্ট,” ওর ফার্ম হাউজে গেলে মাঝেমাঝেই এমন কথা শুনতে হয়। আলিবাগের এই জায়গাটা আসলে ওর বন্ধুদের এন্টারটেন করার জায়গা, আমার মতে রবি এখানে বসে মেডিটেটও করে। “এখানে থাকলেই মাথাটা দ্রুত কাজ করতে থাকে। জীবনের বেশ কিছু সেরা সিদ্ধান্ত এখানে বসেই নিয়েছি আমি,” বলছিল রবি। অনেক সময়ই শাস্ত্রী দু’-এক দিনের জন্য এখানে আসে। তেমন কয়েকটা সময়ে আমি উপস্থিত থেকে দেখেছি, ও রকম পার্টি আর মজাদার আলোচনা খুব কমই দেখা যায়।

ইয়ান চ্যাপেল, ব্যারি রিচার্ডস, ইয়ান বথাম, ভিভ রিচার্ডস, ওয়াসিম আক্রম, মাইক হোল্ডিং, জেফ ক্রো, রবিন জ্যাকম্যান থেকে শিবরামকৃষ্ণ-র সঙ্গে এখানেই পানীয় সহযোগে লাঞ্চে আলাপ হয়। হাসিঠাট্টা, গসিপ আর ক্রিকেট নিয়ে উত্তপ্ত তর্ক —এগুলোও মেনু থেকে বাদ পড়ে না।

সে দিন শাস্ত্রীর নতুন ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল। নিজেকে ফুট সোলজার বলাটা অবশ্য রবির ট্রেডমার্ক হিউমারের নিদর্শন কারণ কোনও মতেই ও ভারতীয় ক্রিকেটের ফুট সোলজার নয়। গত দশ বছর বিসিসিআই-এর যে কোনও বড় কাজে তার ‘ফেস’ হয়ে উঠেছে রবি। তা আইসিসি-র টেকনিক্যাল কমিটি হোক কী আইপিএলয়ের গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য, কিংবা ২০০৭এর বাংলাদেশ ট্যুরে স্ট্যান্ড বাই কোচ থেকে নমিনেটেড টিভি কমেন্টেটর। আর এখন তো একেবারে ক্রিকেট ডিরেক্টর। যার অর্থ, ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিমের প্রায় যে কোনও সিদ্ধান্ত এখন রবির হাতে।

এ রকম যেখানে ক্ষমতা, সেই চাকরিটা কন্টিনিউ করা নিয়ে কেন দ্বিধাগ্রস্ত ছিল রবি? “আমি নিশ্চিত ছিলাম না অনেক দিন ধরে মিনিংফুল কনট্রিবিউশন করে যেতে পারব কি না তা নিয়ে।” কথা শুনে অবশ্য মনে হল, শাস্ত্রী নিশ্চিত ছিল না, বিসিসিআই অ্যাডমিনিসট্রশন থেকে কোচ, সিলেক্টর থেকে টিম—সব্বাই ওকে কী ভাবে গ্রহণ করবে তা নিয়ে। কিন্তু হল ঠিক উল্টো। বিসিসিআই থেকে সিলেক্টররা তো রবির ভ্যালু বুঝলই, টিমের প্লেয়ারদেরও বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেল রবি।

কথায় কথায় রবি বলছিল, এখনকার টিম ‘ইজ আ ভেরি ফাইন ব্যাচ’। কিন্তু গত গ্রীষ্মে ইংল্যান্ডের সঙ্গে টেস্ট সিরিজ হারা আর প্রায় ৩-৪ বছর ধরে দেশের বাইরে ভারতের খারাপ ফর্মের কথা মনে করাতেই শাস্ত্রীর ক্রিকেটীয় যুক্তি, “দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া আর কোনও টিমই তো শেষ ৮-১০ বছরে দেশের বাইরে ভাল খেলেনি। ভারতে এসে অস্ট্রেলিয়া কিংবা অস্ট্রেলিয়া সফরে ইংল্যান্ডকেই দেখুন না। দেশের বাইরে জিততে হলে এমন বোলিং লাইন দরকার যারা নিয়মিত ২০টা উইকেট নিতে পারবে। এটাই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।”

যখন মনে করিয়ে দিলাম, সবথেকে ধনী বোর্ড হলেও বিসিসিআই কিছুতেই সেরা টিম করতে পারে না, সেই কথা প্রায় মেনে নিল ‘টিম ডিরেক্টর’, “তুমি ঠিকই বলেছ। টপ লেভেলে আরও ধারাবাহিকতা দরকার।”

আড্ডা চলতে চলতে জানলাম রবি কিছুতেই মানে না, আইপিএল প্লেয়ারদের টেস্ট খেলার জন্য প্রয়োজনীয় স্কিল আর মোটিভেশনে ফাটল ধরাচ্ছে। “ও সব ছেঁদো যুক্তি। সে তো অস্ট্রেলিয়ান, সাউথ আফ্রিকান, শ্রীলঙ্কান প্লেয়াররাও আছে আইপিএলয়ে। তাদের ছেড়ে শুধু ভারতীয় ক্রিকেটারের ব্যাপারেই এই কথাটা বলা হচ্ছে কেন?” প্রশ্ন রবির।

কিন্তু আইপিএলয়ে দুর্নীতি? সেই ব্যাপারে ওর কী মত? “আইপিএলয়ে যে দুর্নীতি হচ্ছে এটা তো কেউই প্রথমে ভাবতে পারেনি! তবে সবরকম সতর্কতা তো নেওয়া হয়েছে। বাকিটা তো এখন কোর্ট দেখছেই। এখনই এ নিয়ে কিছু বলার কী আছে?” উল্টে প্রশ্ন শাস্ত্রীর।

সে দিন কথা হচ্ছিল ধোনি আর কোহলিকে নিয়ে। বুঝতে পারলাম এমএস আর বিরাট-এর প্রতি ওর বিশেষ ভাললাগা রয়েছে। “আমি অনেক প্লেয়ারকে দেখেছি। কিন্তু এমএস ওদের থেকে একেবারে আলাদা। ভীষণ কমিটেড, মাটিতে পা থাকে আর দেখা না গেলেও জেতার খিদেটা ওর মধ্যে সব সময়।”

কোহলির সঙ্গে অবশ্য আমার মনে হয় রবির ইক্যুয়েশনটা আলাদা। কোথাও মনে হয় কোহলির মধ্যে নিজেকে দেখতে পায় রবি।

“বিরাট ইয়াং, দেখতে ভাল, চুটিয়ে জীবন কাটাতে চায়... এতে দোষের কী আছে? আসল কথা হল বিরাট মিডল অর্ডারে নেমে কত রান করল সেটা,” বলে রবি। সঙ্গে যোগ করে, “ইংল্যান্ডে ওর সময়টা ভাল যায়নি। কিন্তু সেটা ভাল। ওর কেরিয়ারের শুরুতেই সেটা হয়ে গিয়েছে। ও খুব তাড়াতাড়ি শিখে নিতে পারবে। আর আমার সবথেকে ভাল লাগে ওর জ্বলজ্বল করা চোখগুলো... জেতার খিদেটা দেখা যায়।”

কিন্তু রবির সঙ্গে আড্ডা হলে একটা বোমা তো রবি ফাটাবেই। আইপিএলয়ের প্রথম সিজনে ললিত মোদীকে বাইবেলের মোজেসের সঙ্গে তুলনা করেছিল ও। সেটা মনে করাতে রবির উত্তর স্পষ্ট। “হ্যাঁ, করেছিলাম তো। তার কারণ, অত কম সময়ে ও রকম একটা টুর্নামেন্ট আয়োজন করাটা সহজ ছিল না। সেটা দুর্দান্তভাবে করেছিল ললিত। আমি আজকে দাঁড়িয়েও একই কথা বলব,” সাফ উত্তর রবির।

এ ছাড়া এখন রবির চোখ অস্ট্রেলিয়ার দিকে। সেই ট্যুরে তার নতুন ভূমিকা নিয়ে যে এখন থেকেই ও ভীষণ উত্তেজিত সেটাও প্রতি মুহূর্তে ধরা পড়ছে ওর কথায়। সর্বক্ষণ প্লেয়ারদের সঙ্গে ট্যাকটিক্স নিয়ে ফোনে কথা হচ্ছে।

শাস্ত্রীকে প্রায় তিরিশ বছর চিনি। যতটা চিনেছি, এটা বুঝেছি, রবি অসম্ভব উদার একজন মানুষ, ওর সেন্স অব হিউমার দারুণ আর জীবনটাকে কিং সাইজ ভাবে বাঁচতেই ভালবাসে। কিন্তু কিছুতেই রবিকে কেউ বোকা বানাতে পারবে না। অসম্ভব স্ট্রিট স্মার্ট ও।

আজও এত বছর পরে ক্রিকেটের প্রতি ওর প্যাশনটা অটুট। আজকে কিন্তু ‘সিস্টেম’য়ের ভিতরে ও, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওর এক অভাবনীয় ক্ষমতা আছে আগে থেকে কিছু ঘটনা বুঝতে পারার। তাই কারও লোক না হয়েও ঠিক জায়গায় ঠিক সময় পৌঁছে গেছে ও।

শেষ যে বার কথা হল, শাস্ত্রীকে দেখেই মনে হচ্ছিল অস্ট্রেলিয়া সফরের জন্য অসম্ভব তেতে আছে ও। কথায় কথায় বুঝতে পারলাম শাস্ত্রী মনে করে ভারতের পক্ষে এ বারও ওয়ার্ল্ড কাপ জয় সম্ভব। “পরিস্থিতি সাহায্য করবে না। ডিসাইডিং ফ্যাক্টর হবে আত্মবিশ্বাসটাই। ওটাই আসল চাবিকাঠি।”

সারাজীবন সেই সব প্রতিপক্ষের সঙ্গে তো রবি লড়েছে যাদের ক্ষমতা ওর থেকে বেশি ছিল।

‘আত্মবিশ্বাসটাই যে আসল চাবিকাঠি’ সেটা রবির থেকে ভাল আর কে-ই বা জানবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE