Advertisement
E-Paper

ঋতুবদল

গত ক’বছর তাঁর পেশাদার জীবনে কখনও ঘোর গ্রীষ্ম। কখনও কালবৈশাখী। এই শেষ আশ্বিনে কিন্তু ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত-র জীবনে ফের বসন্ত। আবিষ্কার করলেন ইন্দ্রনীল রায়গত ক’বছর তাঁর পেশাদার জীবনে কখনও ঘোর গ্রীষ্ম। কখনও কালবৈশাখী। এই শেষ আশ্বিনে কিন্তু ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত-র জীবনে ফের বসন্ত। আবিষ্কার করলেন ইন্দ্রনীল রায়

শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০১
ছবি: সোমনাথ রায়: মেকআপ: রজত-কৌশিক।

ছবি: সোমনাথ রায়: মেকআপ: রজত-কৌশিক।

ঘটনা এক: গত তিন বছর ধরে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনের দিন সকালে মুম্বই থেকে ঘনঘন এসএমএস আসে তাঁর কাছে। ‘ঋতু, সি ইউ অ্যাট দ্য ফেস্টিভ্যাল ওপেনিং’। কখনও পাঠান মুম্বইয়ের নামী অভিনেত্রী। কখনও কোনও হিরো। কিন্তু তিনি ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত বুঝে উঠতে পারেন না কী উত্তর দেবেন! তিনি নাকি সরকার-ঘনিষ্ঠ নন বলে কোনও মতে একটা পাস পাঠানো হয়েছে বাড়ির ঠিকানায়। কেউ ফোন করেও জানায়নি, তাঁকে স্টেজে তোলা হবে কি না!

‘‘এত বছর টালিগঞ্জকে রিপ্রেজেন্ট করে আমার কি এটা প্রাপ্য?’’ বলে একাধিক বার পরিচিত সাংবাদিকদের ফোন করেছেন ঋতুপর্ণা।

ঘটনা দুই: দিনের পর দিন কিছু পরিচালক ফোন করে বলেছেন তাঁর জন্য স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। সেই মানুষগুলোই পরের দিন কোনও পার্টিতে দেখে কথা না বলে এড়িয়ে গিয়েছেন!

‘‘হয়তো লজ্জায় বেরিয়ে গেছেন, আমাকে ফেস করতে পারেননি। হয়তো আমার সঙ্গে কাজ করলে ওঁদের কেরিয়ারের ক্ষতি হবে ভেবেছেন,’’ ঘনিষ্ঠ মহলে বলতেন নায়িকা।

বিগত বারো বছর এ রকম শত শত অপমান, অবজ্ঞা জুটেছে তাঁর জীবনে। এমনকী এই ক্রমাগত বঞ্চনার পর বারবার ফিরে আসার ক্ষমতাকেও অবজ্ঞা করা হয়েছে নানা মহলে। মুড়ি-তেলেভাজার আড্ডায় বলা হয়েছে, ‘‘ঋতু হল কই মাছের প্রাণ। কিছুতেই কিছু করা যায় না।’’ কেউ বলেছে, ‘‘লাস্ট সাত বছরে একটা হিট ছবির নাম বল?’’

অথচ অদম্য ঋতুকে কিছু করা যায়নি। আজ শুক্রবার তাঁর অভিনীত ‘বেলাশেষে’ ঐতিহাসিক ২৫ সপ্তাহে পড়ছে।

সেই একই দিনে সাম্প্রতিক কালে তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রোল যে ছবিতে, সেই ‘রাজকাহিনি’ মুক্তি পাচ্ছে। পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। আবার দিন পনেরোর মধ্যে শ্যুটিং শুরু হচ্ছে প্রসেনজিতের সঙ্গে। বহু প্রতীক্ষিত কামব্যাক ছবির শ্যুটিং। রাজ্য সরকার থেকেও ইদানীং তিনি স্বীকৃত। মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে অনুষ্ঠানে যান। এ বারের চলচ্চিত্র উৎসব উদ্বোধনে মুম্বই থেকে কোনও এসএমএস এলে আর তাঁর অস্বস্তির কারণ নেই।

নানা অপমান আর জ্বালা সহ্য করতে করতে আচমকা ২০১৫-টা নিজের করে নিয়েছেন ঋতুপর্ণা। অভাবিত প্রত্যাবর্তনই বলা যায়। যা কত দিন স্থায়ী হবে কেউ জানে না। পরের বছরই কী হবে কেউ জানে না। কারণ, বয়স আর ঋতুর বন্ধু নয়। কিন্তু স্রেফ সংকল্প, পরিশ্রম আর অভিনয়-ক্ষমতা— এই ত্রিভূজে ভর দিয়ে ফের টালিগ়ঞ্জের পয়লা নম্বর নায়িকার দাবিদার হয়ে গিয়েছেন ঋতুপর্ণা।

ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িত সকলে জানে, গত ক’বছর এক নম্বর নায়িকার মুকুট তাঁর মাথায় ছিল না। ঋতু যখন ক্রমশ একা একা ছবি করতে বাধ্য হচ্ছেন। বড় কোনও হিরো বা প্রযোজকের কোনও সাহায্য ইন্ডাস্ট্রিতে পাচ্ছেন না। সেই সময় জাঁকিয়ে বসেছিলেন কোয়েল মল্লিক। বাঙালি দর্শকের অনেকের কাছেই কোয়েল শুধুই সুন্দরী নায়িকা নন। গার্ল নেক্সট ডোর। আর ইন্ডাস্ট্রিতে যিনি বহু মেপেজুখে একটা পা-ও ভুল ফেলেন না। কিন্তু গত দু’বছর কোয়েল যেন স্ট্র্যাটেজি বদলানোয় মনোযোগী। বিয়ে-উত্তর তিনি চাইছেন তথাকথিত ‘নিউ এজ’ ছবিতে কাজ বাড়াতে। মানসিকতাতেও কোয়েল অনেক শান্ত ধীরস্থির। ঋতুর মতো উগ্র পেশাদার নন। কেরিয়ারের গিয়ার বদলানোর সময় অধুনা গতি কমেছে তাঁর অগ্রগমনের। যদিও জিৎকে ফের নায়ক করে তিনি বক্সঅফিসের সেই সফল চাবিটাই আবার উপুড় করেছেন। পয়লা নম্বর সিংহাসনের লড়াইয়ে ২০১৬ কোয়েলের মেক অর ব্রেক ইয়ার।

কোয়েল ছাড়াও ঋতুর প্রতিযোগী ছিলেন দু’জন। স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় আর শ্রাবন্তী। দু’জনই ভাল অভিনেত্রী। দু’জনই সুন্দরী।

স্বস্তিকার অভিনয় ‘শেষের কবিতা’তে অনেকেরই ভাল লাগলেও ছবি একেবারেই জমেনি। হিন্দি ‘ডিটেক্টিভ ব্যোমকেশ বক্সী’ও তাই। এমনকী প্রিয় পরিচালক/বন্ধু মৈনাকের সঙ্গে ‘ফ্যামিলি অ্যালবাম’ও চলেনি। চলেছে ‘এবার শবর’। সেখানে স্বস্তিকার ব্লাউজের কাট থেকে অভিনয়— সবই প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি মনে করে সিংহাসনের জন্য আরও ভাল ছবি, পেশাদার জীবনে আরও একাগ্রতার প্রয়োজন।

শ্রাবন্তী ব্যক্তিগত সমস্যা দূরে সরিয়ে রেখে কামব্যাকের প্রবল চেষ্টা করেছেন এ বছর। কিন্তু এখনও নিজের পুরনো জায়গার কাছাকাছি পৌছননি। এত ভাল অভিনেত্রী অথচ নিউ এজ ছবির জন্য ফিজ বিশেষ কাটছাঁটে বিশ্বাসী নন।

এই সব কিছু মিলেজুলে বছর যত শেষের দিকে, ততই যেন নিজের পিছনের লেন থেকে অকস্মাৎ সামনে চলে এসেছেন ঋতুপর্ণা।

আচমকা ঋতুবদলের রেসিপি কী?

‘‘ঋতুবদল কি না জানি না, তবে কাজের প্রতি আমার প্যাশনটা অনেকের চেয়ে বেশি। সেটাই হয়তো আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কাজ করতে নামলে আমার একটা অদ্ভুত অ্যাড্রিনালিন রাশ হয়, যা আমি বলে বোঝাতে পারব না,’’ বিষ্যুদবার সকালে বাড়িতে মেকআপ করতে করতে বলছিলেন ঋতু।

ঋতুপর্ণা মানেই বোধহয় সাংবাদিকের কাছে টালিগঞ্জের কঠিনতম শারীরিক চ্যালেঞ্জ। আজ দিল্লি, কাল বাংলাদেশ, পরশু সিঙ্গাপুর... নাচের প্রোগ্রাম, পুজোর উদ্বোধন... তাল রাখাটাই দুঃসাধ্য ঋতুর সঙ্গে। এত কিছুর পরেও ফোকাস রাখেন কী করে ঋতু, সেটা টালিগঞ্জের চিরকালীন জিজ্ঞাস্য। আজকের দিনে তা আরও বেড়েছে।

কিন্তু গত বারো বছর তাঁর সঙ্গে ছিলেন না প্রসেনজিৎ। হিরো হতে এতটুকু আগ্রহ দেখাননি দেব বা জিতের কেউ। তাঁর কপালে বেশির ভাগ সময় জুটত ফিরদৌস। বড়জোর কখনও যিশু। পাশে ছিল না সবচেয়ে বড় প্রোডাকশন হাউজও। জিজ্ঞেস করি, রোজ সকালে নিজেকে মোটিভেট করতেন কী ভাবে?

‘‘আমি জানতাম, যুদ্ধটা একা লড়তে হবে। এটা আমার জীবনের দীর্ঘ আর কঠিনতম লড়াই। চারিদিকে তখন শুধুই প্রবঞ্চনা আর হেরে যাওয়া। কখনও কখনও ভাবতাম এই হিরোলেস ফেজটা কাটাব কেমন করে? তার পর নিজের ছবিতে নিজেই হিরো হয়ে উঠলাম,’’ বেশ জোরের সঙ্গেই বলেন নায়িকা।

প্রবঞ্চনা এতটাই ছিল যে, বহু অভিনেতা ‘অন্য’রা চটে যাবেন এই ভয়ে তাঁর সঙ্গে কাজ করতে চাইতেন না। এমনকী ঋতুর ছবি মুক্তির সময় হঠাৎ হঠাৎ নানা ঝামেলাও শুরু হত।

যে প্রযোজকরা কোনও দিন ভাবতেও পারেনি যে ঋতু তাঁদের ছবিতে ‘হ্যাঁ’ বলবেন, এমনকী তাঁদের সঙ্গেও প্রায় বাধ্য হয়েই ছবি করেছেন ঋতু।

‘‘কেঁদেছি কত। কত বার মনে হয়েছে সব ছেড়েছুড়ে দিই। কিন্তু তারপর নিজেকে বুঝিয়েছি আমাকে আবার খেলায় ফিরতে হবে,’’ বলেন নায়িকা।

কথায় কথায় নিজেই জানান শাহরুখ খান দিল্লিতে তাঁকে একবার দারুণ মোটিভেশনাল কথা বলেছিলেন।

‘‘শাহরুখ দিল্লির আড্ডায় বলেছিল এই ইন্ডাস্ট্রি খুব নির্দয়। যেহেতু নির্দয় তাই তোমাকেও নিজের কাজের ব্যাপারে রুথলেস হতে হবে। আমাকে সাঙ্ঘাতিক অনুপ্রাণিত করেছিল কথাগুলো। এত দিন এত ঝড় সামলে এটা বুঝেছি, এক মিনিটের জন্য যদি ফোকাসটা চলে যায় তা হলে কিন্তু আপনাকে হোঁচট খেতেই হবে,’’ বলেন ঋতুপর্ণা।

কিন্তু হালফিলের উজ্জ্বলতার পিছনে কোথাও তো অন্ধকারও রয়েছে। সে দিনই এক পরিচালক বলছিলেন, ঋতুকে ডাবিং স্টুডিয়োতে দেখে উনি চিনতেই পারেননি। চোখের নীচে এত কালি পড়ে গেছে।

‘‘হা হা হা হা। চোখের নীচে কালি সবার থাকে। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তো থাকেই। অ্যাট লিস্ট কালিটা তো এটা প্রমাণ করে কী পরিমাণ আপনি খাটছেন! আমার কাছে সেটা কালি পড়ার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ,’’ সাফ জবাব দেন নায়িকা।

তিনি যখন চুলের রোলার খুলছেন তার মধ্যেও প্রশ্ন করি, কোথাও কি তিনি এই আগ্রাসী মনোভাবের জন্য প্রসেনজিৎ বা সেই প্রোডাকশন হাউজের কাছে কৃতজ্ঞ? তাঁদের এই উপেক্ষাই কি তাঁর জেদ বাড়িয়ে দিয়েছে? তাঁরা কি তা হলে পরোক্ষভাবে তাঁর সবচেয়ে বড় মোটিভেশন ফ্যাক্টর?

প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলেন ঋতু। ‘‘হতে পারে তো বটেই। ওরা আমাকে ইনডায়রেক্টলি সাহায্য করেছে,’’ বলেন তিনি।

আজ তো তাঁর হাতে বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং প্রোজেক্ট। সঞ্জয় নাগের ইংরেজি ছবি ‘গুড মর্নিং সানশাইন’, যেখানে তাঁর সহ-অভিনেতা রেবতী। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তাঁর নতুন উদ্যোগ— সিঙ্গাপুর বঙ্গ উৎসব। যেটা তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। বললেন পরের বছর নাকি তাঁর লেখা বইও বেরোচ্ছে। আর কী কী করতে চান?

‘‘আমি সব সময় সবাইকে নিয়ে চলতে চাই। আমি কিন্তু সবচেয়ে বেশি নতুন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছি। কোথাও নিজের অভিনয়ের একটা ঘরানা তৈরি করতে পেরেছি। ইন্ডাস্ট্রিও আমাকে যেমন চ্যালেঞ্জ করেছে আমিও ইন্ডাস্ট্রির ধ্যানধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছি। এই দৌড়টায় থেকে যেতে চাই,’’ বলে জুসের গ্লাসে চুমুক দেন অভিনেত্রী। আজও তিনি ড্রিঙ্কসের গ্লাসে নেই। ডিসকোতে নেই। এমনকী কফিতেও না।

কিন্তু বহু সময়ই এত কাজের ফাঁকে অনেকেরই কাজ আর ব্যক্তিগত জীবনের ব্যালেন্স থাকে না। এত কাজের মধ্যে কোথাও মনে হয় না, মেয়ে স্কুল থেকে ফিরল কিন্তু বাড়িতে থাকতে পারলাম না?

‘‘মনে হয় তো। খুব মনে হয়। চেষ্টা করি কিন্তু সব সময় হয় না,’’ নিজেই স্বীকার করেন ঋতু।

এই নিয়ে কখনও তাঁর বর সঞ্জয় চক্রবর্তীর সঙ্গে ঝগড়া হয় না?

প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ ভাবেন ঋতুপর্ণা। তার পর ধীরে ধীরে বলেন, ‘‘হয়তো রেগুলারলি টাইম ম্যানেজমেন্ট নিয়ে সমস্যা হয়। সঞ্জয় ন্যাচারেলি আরও সময় ডিম্যান্ড করে। আর আমি পারি না। আজকে বলছি ও অনেক মেনে নিয়েছে। আমি ওর জায়গায় থাকলে ঋতুপর্ণার টাইমের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে পারতাম না।’’ স্বীকারোক্তি ঋতুর।

কিন্তু এত সবের মধ্যে নিজের লক্ষ্যে স্থির, কী করে থাকলেন ঋতুপর্ণা, সেটাই আশ্চর্যের!

‘‘কাজ করে যেতে হবে বুঝলেন! শাহরুখের ব্যাপারে লোকে বলে, মুম্বই শহর ঘুমিয়ে পড়ে, শাহরুখ ঘুমোয় না। লোকে আমার ব্যাপারেও সেটা বলে। ঋতুপর্ণা ঘুমোয় না। চলে গেলে তো এটাই থেকে যাবে। তাই নতুন করে ইন্ডাস্ট্রি যে সুযোগটা আমাকে দিয়েছে সেটার সদ্ব্যবহার করতে চাই। ছাড়া নেই,’’ বলেই উঠে পড়েন ঋতুপর্ণা।

আটকাতে চাইওনি তাঁকে।

ইন্টারভিউ শেষ করেই তো ফোটোশ্যুট... সেখান থেকে রেডিয়ো চ্যানেল... তারপর পুজো উদ্বোধন... রাতে প্রিমিয়ার... বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান... বন্ধুর জন্য র‌্যাম্পে হাঁটা...

সব ঋতুর পরিবর্তন হয়, অথচ এই ঋতু আশ্বিনেও খোঁজ পায় বসন্তের।

Rituparna Sengupta Indranil Roy Ananda Plus tollywood abpnewsletters ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy