Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
Presents

দায়ভাগ

উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাবেন, সেটা জানেন। কিন্তু তা আদায় করার উপায় হয়তো অজানা। তা হলে আর লাভ কী? নিজের অধিকার জানুন। চিনে নিন প্রাপ্য পাওয়ার পথ। জয়ন্ত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়।সম্পত্তি আপনার বাবার। তাঁর পর সেই সম্পত্তির পুরোটা কিংবা একটা অংশ পাওয়ার কথা আপনার। আপনার বাবাও নিশ্চয়ই চাইবেন যে, তাঁর কষ্ট করে রোজগার করা টাকায় তৈরি সম্পত্তির উত্তরাধিকার সঠিক হাতে যাক। পাশাপাশি তার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে যাতে ছেলেমেয়েদের মধ্যে মারামারি, ঝগড়াঝাঁটি না হয়, তা নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ।

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৪ ০১:১৬
Share: Save:

সম্পত্তি আপনার বাবার। তাঁর পর সেই সম্পত্তির পুরোটা কিংবা একটা অংশ পাওয়ার কথা আপনার। আপনার বাবাও নিশ্চয়ই চাইবেন যে, তাঁর কষ্ট করে রোজগার করা টাকায় তৈরি সম্পত্তির উত্তরাধিকার সঠিক হাতে যাক। পাশাপাশি তার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে যাতে ছেলেমেয়েদের মধ্যে মারামারি, ঝগড়াঝাঁটি না হয়, তা নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। আর এ সব কারণেই প্রাপক হিসেবে নিজের অংশের অধিকার বুঝে নেওয়াটা আপনার জন্য অত্যন্ত জরুরি। কী ভাবে সেটা বুঝবেন, তা নিয়েই কথা বলতে বসেছি আজ।

বাবার সম্পত্তির হকদার

আপনি বাবা-মায়ের এক সন্তান কিংবা ভাই-বোন আছে, মা জীবিত আছেন অথবা মারা গিয়েছেন আপনার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, সন্তান হিসেবে বাবার সম্পত্তি বা সম্পত্তির অংশের হকদার আপনি। হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, দু’ভাবে এই উত্তরাধিকার পেতে পারেন। এক, স্বাভাবিক নিয়মে। আর দুই, বাবা উইল বা শেষ ইচ্ছাপত্র, দানপত্র, পারিবারিক নিরূপণপত্র ইত্যাদি করে তা ভাগ বাটোয়ারা করে যাওয়ার ফলে।

প্রথমে আমি ধরে নিচ্ছি, মৃত্যুর আগে আপনার বাবা উইল, দানপত্র ইত্যাদি করে অন্য কাউকে সম্পত্তি দিয়ে যাননি। সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিক নিয়মে উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্পত্তির কতটা দাবি করতে পারেন, সেটা বেশ কয়েকটি শর্তের উপর নির্ভর করবে। যেমন—

একমাত্র সন্তান: এ ক্ষেত্রে যদি পরিস্থিতি এমন হয় যে, যাবতীয় সম্পত্তি আপনার বাবারই নামে ছিল এবং মা আগেই মারা গিয়েছেন, তা হলে বাবার মৃত্যুর পর স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর সমস্ত বিষয়-আশয় আপনি পাবেন।

মা জীবিত: বাবার মৃত্যুর সময় মা জীবিত থাকলে, একমাত্র সন্তান হওয়া সত্ত্বেও আপনি পুরো সম্পত্তির হকদার নন। কারণ স্ত্রী হওয়ার খাতিরে তার উপর অধিকার বর্তায় আপনার মায়েরও। সে ক্ষেত্রে সম্পত্তির অর্ধেক পাবেন আপনি, আর বাকি অর্ধেক আপনার মা।

ভাই-বোন থাকলে: আবার সেই একই নিয়মে আপনার যদি ভাই বা বোন থাকে, তা হলে বাবার সম্পত্তির হকদার তাঁরাও। সে ক্ষেত্রে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন বলছে, ছেলে হোক বা মেয়ে, বাবার সম্পত্তিতে তাঁর প্রতিটি সন্তানের সমান অধিকার। অতএব একজন, দু’জন বা তার বেশি, আপনারা যতজন ভাই-বোন আছেন, প্রত্যেকে সম্পত্তির সমান অংশ পাবেন।

মেয়ের বিয়ে হয়েছে: পৈতৃক সম্পত্তির সমান অংশের দাবিদার বিবাহিতা কন্যা। এখনও অনেকে মনে করেন মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়া মানে, পরের বাড়ি চলে যাওয়া। কাজেই বাবার সম্পত্তিতে তাঁর আর কোনও অধিকার রইল না। যদিও বিষয়টি একেবারেই সে রকম নয়। মা এবং অন্যান্য ভাই ও বোন (অবিবাহিতা) ঠিক যতটা করে সম্পত্তির অংশ পাবেন, ঠিক ততটাই প্রাপ্য বিবাহিতা কন্যারও।

অতএব: ধরে নিচ্ছি আপনি পুত্র সন্তান। এবং আপনার বাবা মৃত্যুকালে আপনার মা, এক মেয়ে এবং আপনাকে রেখে গিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে বাবার মৃত্যুর পর, আপনারা সবাই তাঁর রেখে যাওয়া সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ করে পাবেন। বোন যদি বিবাহিতা হন, তা হলেও কিন্তু তিনি আপনার সমান অংশেরই হকদার থাকবেন। এবং তিনি এটা হলেন কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মেই।

অধিকার বুঝে নিতে

বাবা মারা যাওয়ার পর সন্তান হিসেবে সম্পত্তির কতটা আপনার প্রাপ্য, সেটা না হয় হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী স্বাভাবিক নিয়মে স্থির হয়ে গেল। এর পর তা কার্যকরও করতে হবে। এই পর্যায়ে সরল-স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হল—

মা, ভাই, বোন থাকলে, প্রত্যেককে জমি-বাড়ির ভাগ-বাটোয়ারা করে নিতে হবে পার্টিশন-এর মাধ্যমে।

কর্পোরেশন অথবা মিউনিসিপ্যালিটিতে কিংবা পঞ্চায়েতে নাম মিউটেশনের মাধ্যমে নথিভুক্ত করাতে হবে।

নিজেরটা ছাড়তে চাইলে

অনেক সময় এটা হতে পারে যে, মা বা বোন সম্পত্তির অংশ নিতে চাইলেন না। মায়ের হয়তো ইচ্ছে যে, নিজের ভাগটা ছেলে বা মেয়েকে দিয়ে যাবেন। আবার বোনেরও হয়তো মনে হল, ভাই বা অন্য কোনও বোনকে ছেড়ে দেবেন তাঁর প্রাপ্যটুকু। তবে সে ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ‘আমার প্রাপ্য অংশ আমি ছেলে/ মেয়ে/ দাদা/ ভাই-কে দিয়ে দিলাম’, এ কথা মুখে বললেই হবে না। তাঁদের অংশ (আনডিভাইডেড বা আনডিমার্কেটেড, অর্থাত্‌ অবিভক্ত ও চিহ্নিত নয় এমন অংশও) দানপত্রের মাধ্যমে দান করে দিয়ে যেতে হবে।

অস্থাবরের হাতবদল

এতো গেল স্থাবর সম্পত্তির কথা। এ বার আসি অস্থাবর সম্পত্তি প্রসঙ্গে। বাবা যদি বিভিন্ন ব্যাঙ্কে টাকা-পয়সা, শেয়ার, সোনাদানা ইত্যাদি রেখে মারা যান, তা হলে সে সব পাওয়ার জন্য আগে উপযুক্ত আদালতে নিজেদের প্রকৃত উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রমাণ করতে হবে। এ ছাড়া, তাঁর ‘ডেথ সার্টিফিকেট’, ‘লেটার অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ অথবা অন্য আত্মীয়ের কাছ থেকে ‘নো অবজেকশন’ হলেও চলতে পারে। তবে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত শংসাপত্রের (সাকসেশন সার্টিফিকেট) প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি। এ ক্ষেত্রে ওই অস্থাবর সম্পত্তির অংশ আদায়ে উত্তরাধিকারীদের সবাইকে ওই সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট এলাকা বা জুরিসডিকশনের জেলা আদালতে আবেদন করতে হবে। আবেদনে আপনার সঙ্গে মৃত ব্যক্তির (অর্থাত্‌ যাঁর সম্পত্তি আপনি দাবি করছেন) সম্পর্ক বয়ান করতে হবে। কখন, কোথায়, কী ভাবে তিনি মারা গিয়েছেন, তা বর্ণনা করতে হবে। আপনাকে মূল ‘অ্যাসেট’ বা সম্পত্তি মূল্যায়নের পরে নির্দিষ্ট ফি-ও দিতে হবে। তবে সাধারণ ভাবে কেউ উইল করে গেলে তিনি সেখানে অস্থাবর সম্পত্তির কথাও উল্লেখ করেন। অনেকে এলাকার জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে ‘ওয়ারিশন সার্টিফিকেট’ নিয়ে অনেক সময় কাজ চালাবার চেষ্টা করেন। তবে আদালতের কাছ থেকে ‘সাকসেশন সার্টিফিকেট’ নেওয়া কিন্তু সবচেয়ে বেশি আইনসম্মত।

ভাগের অধিকার

এতক্ষণ আমি বললাম সেই সব ক্ষেত্রের কথা, যেখানে আপনার বাবা উইল বা শেষ ইচ্ছাপত্র, দানপত্র ইত্যাদি না করেই মারা গিয়েছেন। সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা হচ্ছে স্বাভাবিক নিয়মে। কিন্তু তিনি যদি আগে থেকে তা ভাগ করে দিয়ে যান, সে ক্ষেত্রে? উত্তরাধিকারী হিসেবে কতটা সম্পত্তি পেলেন, কী ভাবে তা বুঝে নেবেন কিংবা আদৌ আপনাকে ভাগ দেওয়া হল কি না এবং যদি না-দেওয়া হয়, তা হলে করণীয় কী এই হাজার রকমের বিষয় নিয়ে ভাবনার দায় তখন শুধুমাত্র আপনারই।

বাটোয়ারা ইচ্ছাপত্রে: বাবা তাঁর সম্পত্তি উইল বা ইচ্ছাপত্রের মাধ্যমে স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে যেতে পারেন। ওই উইল বা শেষ ইচ্ছাপত্র কার্যকর হবে তাঁর মৃত্যুর পর। ভাগের সম্পত্তি পাওয়ার জন্য তখন সকলকেই আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে। উইলে যাঁকে বা যাঁদের সম্পত্তি বা তার অংশ দেওয়া হয়েছে, সেই এক বা একাধিক ব্যক্তিকে ওই উইল নিয়ে নির্দিষ্ট আদালতে প্রোবেট নেওয়ার জন্য মামলা দাখিল করতে হবে। সেই সময় সকলকেই নোটিস দেওয়া হবে। তা পাওয়ার পরই ওই আদালতে মামলার শুনানির সময় হাজির হতে হবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে।

এ বার ধরা যাক, আপনারা একাধিক ভাইবোন। আপনার বাবা আপনাকে তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি উইলের মাধ্যমে মৃত্যুর পর দিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আপনাকে বাবার মৃত্যুর পরে প্রোবেট নেওয়ার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হতেই হবে। আইন অনুযায়ী, আপনার অন্য নিকটাত্মীয় এ ক্ষেত্রে মা বেঁচে থাকলে মাকে, এমনকী অন্য ভাইবোনেদেরও কিন্তু প্রোবেটের জন্য নোটিস পাঠাতে হবে। তাঁদের যদি কোনও বক্তব্য থাকে, তাঁরা আদালতে এসে তা জানাবেন। আদালত নিঃসন্দেহ হলে তবেই উত্তরাধিকারী হিসেবে আপনার অনুকূলে রায় দেবে।

আপত্তির অধিকার: হতেই পারে যে, উইলে আপনাকে সম্পত্তির যে অংশ বা যতটুকু দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে বা অন্য কোনও কারণে আপনার মধ্যে প্রবল ক্ষোভ তৈরি হল। অথবা উইলের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ জাগল আপনার মনে। কিংবা মনে হল উইলকর্তার ইচ্ছা যথাযথ ভাবে প্রকাশ করা হয়নি। বা উইলে কোনও রকম কারচুপি হয়েছে উইলকর্তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে। এই সমস্ত কারণে আপনি হয়তো চান না উইলটি কার্যকর হোক। সে ক্ষেত্রে মারপিট বা ঝগড়াঝাঁটি করে নয়, বরং আপনার তীব্র আপত্তির কথা আপনি জানাতে পারেন আদালতে গিয়েই। যেখানে সম্পত্তির প্রোবেট নিতে হবে। ওই প্রোবেট মামলার শুনানির সময় হাজির হয়ে আদালতকে আপনি জানাতে পারেন, কেন আপনি ওই উইল কার্যকর করার ক্ষেত্রে আপত্তি দাখিল করছেন।

আবার এমন ঘটনাও তো আকছার ঘটে থাকে যে, উত্তরাধিকারীদের কেউ হয়তো বঞ্চিত হলেন। অর্থাত্‌ তাঁকে হয়তো সম্পত্তির ভাগ দেওয়া হল না। এমন ক্ষেত্রেও ওই প্রোবেট মামলার শুনানির সময় আদালতে হাজির হয়েই তাঁকে যুক্তিসম্মত ভাবে নিজের অধিকারের দাবি জানাতে হবে। সে ক্ষেত্রে নোটিস না-পেলেও তিনি যদি জানতে পারেন যে, বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির প্রোবেট সংক্রান্ত মামলার শুনানি হবে, তা হলে খোঁজখবর নিয়ে ওই নির্দিষ্ট দিনে হাজির হয়ে আপত্তি দাখিল করতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে আপনার সন্দেহের কারণ নির্দিষ্ট ভাবে ব্যক্ত করতে হবে।

আসলে অসন্তোষ বা বঞ্চনা, যা-ই হোক না কেন মামলায় আপত্তি দাখিল করাটাই সব থেকে বড় কথা নয়। কেন আপনি আপত্তি করছেন, সেটা আদালতকে বোঝানোটাই আসল। উইলের কোনও একটা অংশের সঙ্গে আপনি একমত না-ই হতে পারেন। আর আপনি উইলের কোনও একটা অংশের সঙ্গে একমত হলেন না মানেই যে উইল নাকচ বা বাতিল হবে, তা-ও নয়! মনে রাখবেন, আপনাকে মোটের উপর উইলের বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলতে হবে। সে ক্ষেত্রে আপনার বক্তব্য হতে পারে উইলের স্বাক্ষরটি আসল নয়। অন্য কেউ উইলকর্তার স্বাক্ষর করে দিয়েছে। কিংবা যখন উইল বা ইচ্ছাপত্রটি সম্পাদন করা হয়, তখন উইলকর্তা শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে স্বাক্ষর করার মতো অবস্থায় ছিলেন না ইত্যাদি।

দানপত্র: সম্পত্তি ভাগ করা যেতে পারে দানপত্র (ডিড অব গিফ্ট বা গিফ্ট ডিড) মারফতও। সে ক্ষেত্রে যিনি তা করছেন, তাঁর জীবদ্দশাতেই অর্থাত্‌ দানপত্র সম্পাদন করার সঙ্গে সঙ্গেই সেটি কার্যকর হয়। অর্থাত্‌ আপনার বাবা কিংবা মা দানপত্র করে আপনাকে সম্পত্তি দিয়ে থাকলে, তাঁদের জীবদ্দশাতেই আপনি সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন। দানপত্র রেজিস্টার্ড হতেই হবে। দানপত্রের মাধ্যমে সম্পত্তি পেলেও ওই সম্পত্তি কর্পোরেশন অথবা মিউনিসিপ্যালিটিতে কিংবা পঞ্চায়েতে নাম মিউটেশনের মাধ্যমে আপনার নিজের নামে নথিবদ্ধ করতে হবে। বাবা কিংবা মা উইলই করে দিন বা দানপত্র, সমস্ত ক্ষেত্রেই কম করে দু’জন সাক্ষী রাখতে হবে।

তবে একটা কথা, যিনি দানপত্র করছেন তাঁকে মনে রাখতে হবে এটা বদল করা খুব কঠিন। এবং কোনও আপত্তি তুলে দানপত্রকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে চান, তা হলে দেওয়ানি আদালতে যেতে হবে।

পারিবারিক নিরূপণপত্র: এ ছাড়াও একজন তাঁর সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বিলি-বণ্টন করতে পারেন পারিবারিক নিরূপণপত্রের মাধ্যমে (ডিড অব সেটলমেন্ট বা ফ্যামিলি সেটলমেন্ট ডিড)। এটি এক ধরনের বন্দোবস্ত দলিল। এই ধরনের দলিলের মাধ্যমেও বাবা বা মায়ের জীবদ্দশাতেই তাঁর সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ভাগ-বণ্টন হতে পারে। এই রকম ‘দলিল’ বা ‘ডিড’-এর মাধ্যমে পরিবারের অনেক দিন ধরে জমিয়ে রাখা সমস্যার সমাধান হতে পারে দলিলকর্তার জীবদ্দশাতেই। পারিবারিক সম্পত্তির সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য, পারিবারিক শান্তি ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি এড়ানোর জন্য এই ধরনের বন্দোবস্ত দলিলের প্রয়োজন হয়। এই ধরনের দলিলও রেজিস্ট্রি করতে হবে এবং তার পর আপনার ভাগের অংশ আপনি নিজের নামে করে নেবেন। যেহেতু সবাই মিলে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পারিবারিক নিরূপণপত্র সম্পাদন হয়, সেখানে এক বার সম্পাদিত নিরূপণপত্র নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া কঠিন হয়ে যায়।

মুসলিমদের উত্তরাধিকার। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষই উইলের মাধ্যমে সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন। তবে কোনও মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ তাঁর মোট সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশের বেশি উইল করতে পারবেন না। উইলকর্তার যাবতীয় ধারদেনা, অন্ত্যেষ্টির খরচ ইত্যাদি মেটানো বাবদ তাঁর সম্ভাব্য মোট যা ব্যয় হবে, তা বাদ দিয়ে যতটা পড়ে থাকবে, সেটিই মোট সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হবে। এবং তারই এক-তৃতীয়াংশ তিনি উইল করে যেতে পারবেন। তবে এক-তৃতীয়াংশের বেশি উইল করতে গেলে ওয়ারিশনদের সম্মতির দরকার হয়।

মুসলিমদের উইল বা ওয়াসিয়ত লিখিত হওয়ার দরকার হয় না। মৌখিকও হতে পারে। সাক্ষীরও প্রয়োজন হয় না। সাক্ষী ছাড়াই উইল হতে পারে।

মুসলিমদের মধ্যে ‘দানপত্র’ বা ‘হিবা’ দলিলের প্রয়োজন দেখা যায়। এবং তা শরিয়ত-স্বীকৃত। যে পদ্ধতিতে দলিল রেজিস্ট্রি করা যায়, সেই পদ্ধতিতেই ‘হিবা’ দলিল করা হয় এবং তার পরে ওই সম্পত্তি মিউটেশনও করা যায়।

ব্যবসার মালিকানা

ধরা যাক, একটি প্রোপ্রাইটারশিপ কনসার্ন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যদি আপনি উত্তরাধিকারী হন অর্থাত্‌ প্রোপ্রাইটার আপনার বাবা কিংবা মা হন, তা হলে ওই ব্যবসায় দেখানো আছে এমন জমি-বাড়ি থাকলে উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী আপনি তা পাবেন। তখন ব্যবসার মালিকানাও আপনার হবে। মনে রাখতে হবে, প্রোপ্রাইটারশিপ কনসার্নের ক্ষেত্রে প্রোপ্রাইটারের মৃত্যু হলেও তাঁর উত্তরাধিকারী বা উত্তরাধিকারীগণ সেই ব্যবসার ‘সুনাম’ বা ‘গুডউইল’ ব্যবহার করে ব্যবসা করতে পারবেন এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে মালিকানা বদলের কথা জানিয়ে নিজেদের নাম নথিবদ্ধ করতে পারবেন বা ব্যবসা সংক্রান্ত যাবতীয় লাইসেন্স পেতে পারবেন।

আবার পার্টনারশিপ ফার্মের ক্ষেত্রে একজন অংশীদার বা পার্টনারের মৃত্যু হলে ওই ফার্ম ভেঙে যেতে পারে। যদি অন্যান্য অংশীদার বা পার্টনারদের সম্মতি থাকে, তা হলে যে অংশীদার মারা গেলেন, তাঁর উত্তরাধিকারী বা উত্তরাধিকারীগণ মৃত অংশীদারের নির্দিষ্ট অংশের অংশীদার হয়ে, নতুন চুক্তির মাধ্যমে ব্যবসায় ঢুকতে পারবেন। যদি অন্য অংশীদারেরা আপনাকে বা আপনাদের সঙ্গে উত্তরাধিকারী হিসেবে নতুন করে চুক্তির মাধ্যমে ওই ফার্মের অংশীদার হিসেবে মেনে না নেন, তা হলে আপনারা ওই ফার্মে আপনার বাবার রেখে যাওয়া অংশের ‘লভ্যাংশ’, ‘সুনাম’ ও ‘মূলধন’ নিয়ে আলাদা ব্যবসা করতে পারবেন। তবে সে ক্ষেত্রে নতুন চুক্তির মাধ্যমে আপনারা আর পার্টনারশিপ ফার্মের অংশীদার থাকবেন না। পার্টনারশিপ দলিল বা ডিড-এ সাধারণত বলা থাকে যে, কোনও একজন পার্টনার মারা গেলে বাকি অংশীদারদের নিয়ে ফার্ম চলতে থাকবে না কি ফার্ম ভেঙে যাবে। অথবা যিনি মারা গেলেন তাঁর অংশ কী ভাবে উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য হবে।

এই কারণেই পার্টনারশিপ ফার্মের চুক্তিপত্রটি বারবার দেখে নেওয়া দরকার। এমন শর্ত থাকতেই পারে যে, ‘পিতার মৃত্যুর পর সন্তানেরা’ বা ‘স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী’ ওই ব্যবসার স্বাভাবিক উত্তরাধিকারী হবেন এবং ‘পার্টনারশিপ ডিড’ অনুযায়ী তখন সেই ফার্মের ভবিষ্যত্‌ নির্ধারিত হবে। অর্থাত্‌ ডিড-এর শর্ত অনুযায়ী ফার্ম ভেঙে যেতে পারে বা এক পার্টনারের মৃত্যুর পরেও চলতে পারে। তবে সমস্ত ক্ষেত্রেই লিখিত নিয়ম অনুযায়ীই ফার্ম চলবে।

যদি পার্টনারশিপ দলিলের কোনও শর্ত কেউ ভঙ্গ করে, তা হলে অনেক সময় ওই দলিলে আরবিট্রেশনে (সালিশি) যাওয়ার শর্ত আছে কি না তা দেখে, ওই পথে যেতে পারেন। অন্যথায় আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন অধিকার আদায়ের জন্য।

লেখক কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE