লক্ষ্মীর পা, রবি বিশ্বাস। চর্চাপদ, ৫০০.০০
বাংলার গ্রামদেশ বহমান জীবনধারার আকরভূমি। বড় মোহময় এই অন্তরস্পর্শী সমাজক্ষেত্র। তাই রূপান্তরের পটভূমিতেও আজও ছোঁয়া যায় দেশকালের বহুবর্ণী লোকাচার আর দেশজ সংস্কৃতির অভিমুখ।
পুরাণেতিহাস আর প্রত্নসাক্ষ্যের প্রেক্ষিতে প্রামাণিক ভারত-সংস্কৃতির ভিত্তিরূপে গ্রামজীবন যে সজীবতার সাক্ষী তাতে আছে ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান, পুজো-পার্বণ, মেলা-উৎসব, রীতিনীতি, শিল্পকলার এক সহজিয়া কাঠামো। আঞ্চলিক পরিসরে প্রাত্যহিকতার সঙ্গে তা মিশে থাকে। লোকধর্মের আঙিনায় ব্রত যেমন আত্মজনের শুভকামনার স্বরলিপি, আর তা প্রকাশ-প্রস্ফুট করতে আলপনার রেখায় গড়ে ওঠে চিত্রকল্প। এই প্রেক্ষাপটেই রবি বিশ্বাস ‘লক্ষ্মীর পা’-এর সন্ধানী হয়েছেন।
দেবী লক্ষ্মীর বহুবিস্তারি বিষয়কে কেন্দ্র করে এই চর্চার কাঠামোতে শুধু ব্রত-আলপনাই নয়, ইতিহাসের নানা অনুসারী দিকও তিনি তুলে ধরেছেন। শব্দার্থ, নামকরণ, পুজোপদ্ধতি, উপকরণ, লোকবিশ্বাস, ছড়া-প্রবাদ ইত্যাদির উপচার সাজানো হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় পাওয়া অজস্র আলপনায় ব্যবহৃত লক্ষ্মীর পা, লক্ষ্মীপ্যাঁচা, লতা ও লক্ষ্মীব্রতের রেখাচিত্রের সমৃদ্ধতর উপস্থাপন। স্বতঃস্ফূর্ততায় ভরপুর এই আলপনা তো মূলত আবহমানের বঙ্গমহিলার আত্মস্থ শিক্ষারই বহিঃপ্রকাশ।
লক্ষ্মীর পা। বাঁশের শস্যগোলা, বীরভূম (বাঁ দিকে)।
খড়ের তৈরি গোলা, বর্ধমান (ডান দিকে)।
ধনৈশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মীর আবাহন-স্তুতি কৃষিভিত্তিক জনজীবনে স্বতঃপরিচিত। গ্রামীণ দৈনন্দিনতার মধ্যে এত সহজ অধিষ্ঠান এই দেবীর যে, কৃষিকেন্দ্রিকতার অজস্র উপাদান জড়িয়ে থেকে লক্ষ্মীশ্রী বোধ তৈরি হয়। গৃহসামগ্রীর মধ্যেও আচরণধর্মের বিধি ঢুকে যায়। ধান, শস্যগোলা, বেতের ধামা, সাজি, কুলো, কড়ির সঙ্গে গৃহ-আঙিনার সৌষ্ঠববোধ গড়ে ওঠে। প্রবহমানতার এই ছোঁয়া শহুরে জনপদেও দেখা যায়। শস্য-ঐশ্বর্য-ধন, লাবণ্য-সৌন্দর্য-শ্রী-প্রাচুর্যের ধারণা দেবী লক্ষ্মীতে যে রূপ পেয়েছে তাতে রয়েছে শাস্ত্রীয় ও লৌকিকের নানা অভিব্যক্তি। হিন্দু পুরাণ থেকে বৌদ্ধ, জৈন, শৈব ও তন্ত্রশাস্ত্রেও সূত্রসন্ধান পাওয়া যায়। মূর্তি, চিত্র, ছবি, ধানছড়া, কুনকে ভর্তি ধানে, গাছকৌটো বা লক্ষ্মীর ঝাঁপিকে কেন্দ্র করে কোজাগরী লক্ষ্মী, দেওয়ালি লক্ষ্মী বা অন্য সময়ের লক্ষ্মীর ব্রতকথার মধ্য দিয়ে সার্বিক পরিচয় পাওয়া যায়।
আলোচনার এই প্রয়াসেই লক্ষ্মীর পা অঙ্কনের বৈচিত্র ও বিবর্তনের অংশটি বইয়ে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। মূল কাঠামো বা ফর্ম একই থাকলেও আলপনার রেখাটান যে সময়ের সঙ্গে বদলে যায় তা কৌতূহলোদ্দীপক। কোথাও আমূল পাল্টেছে, কোথাও অন্য রীতির সঙ্গে মিলমিশ হয়েছে। ধানশিষ ও লক্ষ্মীর পা-এর আলপনা আঁকায় সময়ের ধারায় পরিবর্তনীয় চিত্র একই পরিবারের মধ্যে প্রজন্মান্তরে যে স্বতন্ত্ররূপী হয়েছে, তা ধরা পড়েছে লেখকের আগ্রহী নজরে। লক্ষ্মীপুজোর আলপনায় ব্যবহৃত লতার রেখাচিত্রের নাম ও রঙের উপাদান উল্লেখে অনুপুঙ্খ দিকও মান্যতা পেয়েছে। কাজটির মূল ভরকেন্দ্র বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা নদিয়া তাই ও পার বাংলার ছিরিছাঁদ পাওয়া গেছে অনেকাংশে। বর্ধমান, বীরভূম ও অখণ্ড মেদিনীপুরের কিছু উল্লেখ থাকলেও এ বঙ্গের বিস্তারি সন্ধান অবশ্য এখানে নেই।
মেদিনীপুর জেলা তো এক দশকেরও আগে ‘পূর্ব’ আর ‘পশ্চিম’-এ আলাদা হয়েছে। তবু দীপলক্ষ্মী আলোচনায় শুধুু ‘মেদিনীপুর’ উল্লেখ কেন? তথ্য চয়নে সতর্ক হলে এই সমস্যা এড়ানো যেত। যেমন পুবে লক্ষ্মীঘট আর পশ্চিমে দীপলক্ষ্মীর কারিগরি কেন্দ্র আর প্রচলন-আধিক্য দেখা যায়। আঞ্চলিক নিজস্বতাই লোকঐতিহ্যের বৈশিষ্ট্য। তরুণ লেখক তথ্যসূত্রে পূর্বসূরি চর্চাকারীদেরও আলোচনা উল্লেখে এনেছেন। তাতে শুধু শিল্পীর চোখ দিয়ে দেখা নয়, গবেষণাধর্মী কাজেরও ছাপ রেখেছেন। এ সত্ত্বেও আলোচনার বাইরে থেকে গেল, গত শতকের প্রথমার্ধে হরিদাস পালিতের রাঢ় বাংলার প্রাচীন লিপি আবিষ্কার প্রসঙ্গে ‘আলিপনা চিত্র’-র বিশ্লেষণী অভিমত। প্রাসঙ্গিক ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ অথচ অনুল্লেখিত কেন সুধাংশুকুমার রায়ের দ্য রিচ্যুয়াল আর্ট অব দ্য ব্রতজ অব বেঙ্গল বা শিবেন্দু মান্নার লক্ষ্মীর পা-চালি?
এ বইতে কুটিরে আলপনার আংশিক ছোঁয়া পাওয়া গেলেও ব্যাপ্ত আঙিনায় ‘লক্ষ্মীর পা’-এর উদ্যাপনের দিকে তাকিয়ে থাকছি আমরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy