Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Hasan Suroor

উদারনৈতিক মুসলমানের খোঁজে

যাঁরা নামে-মাত্র মুসলমান, তাঁরা ধর্ম এবং ধর্ম পরিচিতির ধার ধারেন না, ইসলামি অনুশাসন অগ্রাহ্য করেন, মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের পরিবর্তে এঁরা অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষপাতী।

মিলন দত্ত
শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২০ ০০:৩২
Share: Save:

কেউ কি কখনও একই সঙ্গে উদারনৈতিক (লিবারাল) এবং মুসলমান হতে পারে? লন্ডন প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক হাসান সুরুর তাঁর বইয়ে এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছেন।

লেখক মনে করেন, মানবাধিকার, বাক্-স্বাধীনতা, ভিন্ন মত পোষণ, ব্যক্তি স্বাধীনতা সংক্রান্ত সহিষ্ণুতা এবং পছন্দের জীবনচর্যা, লিঙ্গসাম্য ইত্যাদি সাধারণ ভাবে মান্য উদারনীতির মানদণ্ডের নিরিখে উদারনৈতিক বা উদারবাদী ভারতীয় মুসলমান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ভারতীয় মুসলমানের মূলধারা যে রক্ষণশীল এবং তাঁরা যে উদারনৈতিকতার পথে নেই সে ব্যাপারে লেখক নিশ্চিত। এবং ভারতীয় মুসলমানদের রক্ষণশীল হওয়ার অনেক কারণ— শিক্ষার অভাব, নিরাপত্তাহীনতা, ‘সংখ্যালঘু মনস্তত্ত্ব’ এবং মুসলিম পরিচিতির উপর হিন্দুত্ববাদীদের ক্রমাগত হুমকি। কিন্তু একটি কারণ প্রায়শ অনুল্লিখিত থেকে যায়, তা হল, মুসলমানদের মধ্যে একটা শুদ্ধ ও নিরঙ্কুশ উদারনীতির ধারণা চাপিয়ে দেওয়ার ভীতিজনিত প্রতিক্রিয়া। উদারনৈতিকতার আভিধানিক সংজ্ঞার সঙ্গে যে অক্ষরে অক্ষরে মিলতে পারল না সে ‘অনুদার’ বলে চিহ্নিত হল। উদার মুসলমান হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার জন্য তাকে শরিয়ত ত্যাগ করে নিঃশর্ত ভাবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি স্বীকার করতে হবে এবং বাতিল করতে হবে যে কোনও রকম ধর্মীয় পরিচিতি। দাড়ি বা বোরখা মানেই তাঁদের কাছে মৌলবাদী। বামপন্থী উদারনৈতিক মুসলমানদের লেখক দেখেছেন এ ভাবেই: যাঁরা ইউরোপীয় শিক্ষার ছকে ফেলা ‘আদর্শ’ উদারপন্থী। সাধারণ মুসলমানরা এঁদের ভয় পায় । লেখকের দাবি, এঁদের জন্যই ভারতে ‘ছাঁচে ঢালা মুসলমান’-এর ধারণাটা (কেবলই কাঠমোল্লা, ধর্মোন্মাদ আর নিপীড়িত নারী) তৈরি হতে পেরেছে।

যাঁরা নামে-মাত্র মুসলমান, তাঁরা ধর্ম এবং ধর্ম পরিচিতির ধার ধারেন না, ইসলামি অনুশাসন অগ্রাহ্য করেন, মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের পরিবর্তে এঁরা অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষপাতী। তাঁরা রক্ষণশীল সমাজের ভ্রান্তি আর মন্দগুলো ধরিয়ে দিতে সদা ব্যস্ত। মূলধারার মুসলমানদের সমান্তরালে তাঁরা ভিন্ন এক গ্রহের বাসিন্দা। এই মুসলমানদের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন লেখক। লেখকের প্রশ্ন: এঁরা অবশ্যই উদারপন্থী কিন্তু মুসলমান কি? কারণ বাস্তবে তাঁদের সঙ্গে মূলধারার মুসলমানদের সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। কবি ও চিত্রনাট্যকার জাভেদ আখতার বা অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহদের এই দলে রেখেছেন লেখক। এঁরা মুসলমানের ভালর চেয়ে মন্দ বেশি করেন বলে সওয়াল করেছেন সুরুর। তাঁর মতে, ভারতে যে উদারনৈতিক ইসলামের চর্চা ছিল তা কাঠমোল্লা আর বামপন্থী নামে-মাত্র মুসলমানদের কারণে অদৃশ্য হতে বসেছে।

হু কিলড লিবারাল ইসলাম
হাসান সুরুর
৫৯৫.০০
রূপা

বইটির দুটি ভাগ। প্রথম অধ্যায়ে লেখক সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টা করেছেন। সেই সূত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। যেমন, ভারতীয় মুসলমানদের উপর বড় কোনও সংস্কার বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া কাম্য নয়। তাতে মৌলবাদীদেরই সুবিধা করে দেওয়া হবে। ইসলামি ধর্মতত্ত্বের যে সব ব্যাখ্যা সেকুলার ভাবনার পরিপন্থী সেগুলো বাদ দিতে হবে। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে সমাজের নানাবিধ সংস্কার এবং যা ইসলামের ক্ষতি করছে এমন সব বিষয় নিয়ে গবেষক, ছাত্র এবং সমাজকর্মীদের বক্তব্য ও বিবৃতি।

লেখকের মতে, ভারতে গভীর ভাবে ধর্মবিশ্বাসী সংস্কারকদের এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে। তাঁরা অনেক সময় তাঁদের সংস্কারকর্ম মানুষের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করেছেন। তাঁরা হলেন স্যর সৈয়দ আহমেদ, জাকির হোসেন এবং আবুল কালাম আজাদ।

পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে মূলধারার শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের চেয়ে মাদ্রাসার সংখ্যা বেশি। এই তথ্য দিয়ে লেখক বলেছেন, ভারতেও মাদ্রাসা ক্রমে মুসলমানদের মূলধারার শিক্ষার পরিসরে ঢুকে পড়ছে। মাদ্রাসা শিক্ষার ঘোর বিরোধী হাসান সুরুরের মতে, অশিক্ষা এবং কুসংস্কার থেকে মুক্তির পথ না খুঁজে মুসলমান ইসলামের মূল বিধান থেকে ক্রমেই বিচ্যুত হচ্ছে এবং দূরে সরে যাচ্ছে। ইসলামে যে প্রগতিশীল অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে তা মানুষকে কুসংস্কার আর নিরক্ষরতা থেকে মুক্তির আলো দেখিয়েছে। এখন সেই আদি দর্শনের সম্পূর্ণ উল্টো পথে চলেছে ইসলাম। ইসলামকে আজ সাধারণ ভাবে পশ্চাদপদতা, অসহিষ্ণুতা, স্থিতাবস্থা, নারীবিদ্বেষ এবং অবশ্যই সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত করে দেখা হয়ে থেকে। যত দিন মুসলমান এবং ইসলামকে এই সব অভিধায় সংজ্ঞায়িত করা বন্ধ না-হবে তত দিন অগ্রগতির সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সে দিন বহু দূর বলেই মনে করেন লেখক হাসান সুরুর।

তাঁর আগের বই ইন্ডিয়াজ় মুসলিম স্প্রিং: হোয়াই নোবডি টকিং অ্যাবাউট ইট-এ সুরুর বলেছিলেন, ‘ভারতের মুসলমানদের নতুন প্রজন্ম অনেক আধুনিক, সেকুলার, বাস্তবমুখী। ওদের বোরখা বা টুপি-দাড়ি দিয়ে বিচার করবেন না। সুরুরের যুক্তি হল, এই প্রজন্ম পশ্চিমি সাংস্কৃতিক পরিচিতি প্রত্যাখ্যান করে গর্বের সঙ্গে এবং প্রায় লোক দেখিয়ে ইসলামি সাংস্কৃতিক পরিচিতি গ্রহণ করেছে। এবং তাঁরা নামাজ রোজার মতো ইসলামি বিধিগুলোও নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলেন।’ বর্তমান বইয়েও এই পর্যবেক্ষণের পুনরাবৃত্তি রয়েছে। সে দিক থেকে কিছু স্ববিরোধিতাও রয়েছে তাঁর বক্তব্য এবং পর্যবেক্ষণে।

ভারতীয় মুসলমানরা ক্রমেই বিরক্তিকর হয়ে উঠছে বলে লেখক বইয়ের শেষ অধ্যায়ে শঙ্কিত হয়েছেন। কারণ কাউকে মদ্যপানের জন্য আপ্যায়ন করলে উত্তর পাবেন, ‘আমি এখন আর মদ খাই না।’ কোনও ভাল রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়ে মাংসের কোনও পদ আর বিয়ার খাওয়াতে চাইলে জানতে পারবেন তিনি নিরামিষ পদ আর ডায়েট কোক খাবেন। কারণ ওই মাংস হালাল কি না, তিনি নিশ্চিত নন। তাঁকে পার্টিতে আমন্ত্রণ জানান, বলবেন ‘আমি পার্টিতে যাই না।’ বছর কুড়ি আগে লেখক ইংল্যান্ডে চলে যান। তাঁর পর্যবেক্ষণ, ইতিমধ্যে এ দেশে মুসলমানের নান্দনিক বোধের নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে গেছে। তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে নতুন এক আত্মসচেতন ধর্মভীরুতা আর মুসলমানত্বের ধারণা। এ বইয়ে লেখকের অন্তিম আবেদন, ‘মন চাইলে দাড়ি রাখুন, ইচ্ছে হলে হিজাব পরুন, মদ্যপান থেকে দূরে থাকুন কিন্তু আল্লার দোহাই এগুলো ইসলামের নামে করবেন না। ‘ভাল’ মুসলমান হওয়ার জন্য এর কোনওটাই দরকার হয় না। আর দয়া করে রসবোধ ফিরিয়ে আনুন। বিরক্তিকর হয়ে উঠবেন না।’ শেষ পর্যন্ত লেখক উদারপন্থী মুসলমানের দেখা পেলেন কি? স্পষ্ট হল না।

গোটা বিশ্বেই সাধারণ মুসলমানের ওপর অতীতমুখী কট্টর সংস্কারবাদীদের প্রবল চাপ— তাদের ‘ভাল’ মুসলমান করে তুলতে হবে। ভারতে এবং এই বাংলায় সেই চাপ কম নয়। সঙ্ঘ পরিবার এবং নানা কিসিমের হিন্দুত্ববাদী সংগঠন যেমন বৈচিত্রময় হিন্দু সমাজকে ঠেলে নিয়ে চলেছে একমাত্রিক গোষ্ঠী-যাপনের দিকে, তেমনই মুসলমান সমাজে সেই কাজটা চলছে আরও অনেক দিন ধরে। লেখক নানা মুসলিম প্রধান দেশের ইসলামি সংস্কার আন্দোলন এবং সেই চাপের মুখে সহনশীলদের প্রতিক্রিয়া বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। হাজির করেছেন শিক্ষিত মুসলিম তরুণদের মধ্যে ধর্মের প্রতি বিরূপতার তথ্য আর সংবাদও। সুরুরের মন্তব্য, চরমপন্থীদের যত বাড়বাড়ন্ত হবে আর নরমপন্থীরা হবে কোণঠাসা, ইসলামের বাহ্যিক সঙ্কট পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকবে।

বইয়ের সবচেয়ে দুর্বল দিক হল দেশের অগণিত সহনশীল নরমপন্থী (মডারেট) বৈচিত্রে ভরা সাধারণ মুসলমানের অনুপস্থিতি। কেবল শিক্ষাবিদ, গবেষক, গ্রন্থকার ইত্যাদি সামাজিক স্তরের মানুষের মতামত এবং উদ্ধৃতি না দিয়ে বরং সাধারণ গণ-মুসলমানের সমাজ জীবন এবং দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করলে হয়তো লেখক ভিন্ন কোনও ইসলামের হদিশ পেতেন। তিনি বাংলার সহজিয়া ধারার অনুসারী পির-ফকিরদের কাছে যাননি, বিহারের যে মুসলমানরা ছট পুজোয় সূর্যদেবতার আরাধনা করেন, যে মুসলিম শিল্পীরা হিন্দুদের পুজোর জন্য মূর্তি গড়েন কিংবা পট আঁকেন তাঁদেরও বিবেচনার মধ্যে আনেননি। এঁরা হয়তো শরিয়তের বিচারে খাঁটি মুসলমানের তকমা পাবেন না। তবে এঁদের কোনও ভাবেই বিক্ষিপ্ত নজির বলে সরিয়ে রাখা যাবে না। বরং তা ভারত তথা দক্ষিণ এশীয় মুসলমানের বিচিত্র ধারার পাঁচমিশেলি চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত। এত সব মিলিয়েই গড়ে উঠেছে ভারতীয় মুসলমান সমাজ। সেই ভারতীয় মুসলমান অবশ্যই উদারপন্থী এবং সহনশীল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hasan Suroor Book Review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE