Advertisement
E-Paper

আগুনের উপত্যকা, না কি ভগবানের খেলাঘর

আগুনের উপত্যকা দেখতে যাবে? মৃত্যু উপত্যকা থেকে ফেরার পথে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েছিলাম সহধর্মিনীর দিকে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রতি প্রশ্ন ধেয়ে এল, সেখানে কি আগুন জ্বলতে দেখা যায়? বললাম, “না! সোনার কেল্লা, সোনার বাংলা অথবা সোনার টুকরো ছেলে যেমন সোনা দিয়ে তৈরি নয়, তেমনই এই উপত্যকায় আগুনের কোনও উপস্থিতি নেই।” এখানে কোনও আগুন জ্বলতে দেখা না গেলেও গরমের সময় তাপমাত্রা প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। তা হলে কেন এমন নামকরণ?

সঞ্জীব পাল

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১

আগুনের উপত্যকা দেখতে যাবে?

মৃত্যু উপত্যকা থেকে ফেরার পথে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েছিলাম সহধর্মিনীর দিকে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রতি প্রশ্ন ধেয়ে এল, সেখানে কি আগুন জ্বলতে দেখা যায়? বললাম, “না! সোনার কেল্লা, সোনার বাংলা অথবা সোনার টুকরো ছেলে যেমন সোনা দিয়ে তৈরি নয়, তেমনই এই উপত্যকায় আগুনের কোনও উপস্থিতি নেই।” এখানে কোনও আগুন জ্বলতে দেখা না গেলেও গরমের সময় তাপমাত্রা প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি পৌঁছে যায়।

তা হলে কেন এমন নামকরণ?

আচ্ছা এই প্রশ্নের কি কোনও চটজলদি উত্তর হয়! তবুও বললাম, “সেটা জানতে গেলে পার্কে যেতে হবে যে!” ঠিক হল, লাস ভেগাসে এক রাত্তির কাটিয়ে তার পরের দিন আমরা ‘ভ্যালি অব ফায়ার স্টেট পার্ক’ বা আগুনের উপত্যকা দেখতে যাব।

লাস ভেগাস থেকে উত্তরমুখী ১৫ নম্বর জাতীয় সড়কে ৭৫ নম্বর এক্সিট নিলে ১৬৯ নম্বর রাস্তা সোজা নিয়ে যায় আগুনের উপত্যকায়। লাস ভেগাস বেড়াতে এলে হাতে অর্ধেক দিন সময় থাকলে এই পার্কটি দেখে নেওয়া যায়। শরত্ আর বসন্তে এই পার্ক অনন্যসুন্দর লাগে। আজ থেকে দেড় কোটি বছর আগে যখন ডাইনোসররা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াত, তখন প্রাকৃতিক ভাবে ভূত্বকের উত্থান এবং ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে আজকের আগুনের উপত্যকা তৈরি হয়েছে।

ধুধু তেপান্তরের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা কালো পিচের রাস্তা দিয়ে এসে পার্কের প্রবেশ দ্বারে পৌঁছলাম। প্রবেশমূল্য আট ডলার। সঙ্গে পাওয়া যায় পার্কের পরিচিতিপত্র আর মানচিত্র। পরিচিতিপত্রটিতে উদ্যানটির বিভিন্ন দ্রষ্টব্য জায়গাগুলির তালিকা রয়েছে। চার দিকে বিশাল বিশাল লাল রঙের বালিপাথর যেন দেওয়াল তুলে রয়েছে! আর মাঝে মাঝে অসংখ্য ছোট ছোট লাল রঙেরই পাথর ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে। পাথরের স্তূপের আকার, অথচ আগুনের লেলিহান শিখার মতো মাথা তুলে রয়েছে! প্রথম দর্শনে মনে হবে, যেন আগুন জ্বলছে। আর সেই কারণেই এই উপত্যকার নাম ভ্যালি অব ফায়ার বা আগুনের উপত্যকা। এই লাল রঙের কারণে আর্নল্ড আর্নল্ড সোয়ার্জেনেগার অভিনীত হলিউডের বিখ্যাত ছবি ‘টোটাল রিকল’-এ মঙ্গল গ্রহের দৃশ্যের পুরো শ্যুটিং এখানে হয়েছিল। এ ছাড়া ‘ট্রান্সফর্মার’ এবং ‘স্টার ট্রেক’ ছবির কিছু দৃশ্যের শ্যুটিং এখানে হয়। শুধু হলিউডই নয়, বলিউডও এখানে শ্যুটিং করতে এসেছে। অগ্নিভ বালিপাথর ছাড়া এই উদ্যানে প্রচুর ঐতিহাসিক, প্রাগৈতিহাসিক এবং ভৌগোলিক নির্দশন ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে।

প্রবেশপথের সামনেই বিশাল বড় মৌচাক! তবে তা সত্যিকারের নয়। বালি পাথরের উপর অসংখ্য ছিদ্র মৌচাকের চেহারা নিয়েছে। ধাপে ধাপে সাজানো। চাইলে রক ক্লাইম্বিংও করা যায়। আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এখানে যে মানু্ষ বসবাস করত, তার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। পুয়েবলো ইন্ডিয়ানরা এদের মধ্যে অন্যতম। আদিম এই ‘ইন্ডিয়ান’দের অসংখ্য পাথর খোদাই (পেট্রোগ্লিফ) নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে এই উদ্দ্যানে।

এখানকার পাথরগুলো লাল হওয়ার কারণ, আয়রন অক্সাইড। তার উপর ‘মরু ভার্নিশ’ (প্রধানত ম্যাঙ্গানিজ এবং অন্য অক্সাইডের প্রলেপ ) পড়ে সেগুলো কালো হয়ে যায়। পেট্রোগ্লিফ সাধারণত এ রকম পাথরের কালো অংশে করা হয়। মৌচাক দেখে গেলাম পার্কের অন্যতম আকর্ষণ আটল্টল পাথর দেখতে।

আটল্টল এক ধরনের যুদ্ধাস্ত্র। যেটা দিয়ে পুয়েবলো ইন্ডিয়ানরা তির বা বর্শা জাতীয় জিনিস ছুঁড়ত। বিশাল পাথরের স্তূপে এ রকমই কিছু যুদ্ধাস্ত্র খোদাই করা আছে বলে পাথরটার এই নাম । চারতলা সমান উঁচু এই পাথরের প্রায় তিনতলার কাছাকাছি চিত্রগুলি খোদাই করা রয়েছে। উপরে ওঠার জন্য লোহার সিঁড়ি বানানো আছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা সমতল জায়গা, তার পাশের দেওয়ালে রয়েছে প্রায় চার হাজার বছরের প্রাচীন পেট্রোগ্লিফ। দর্শনার্থীরা যাতে এই আঁকা চিত্রগুলি নষ্ট করতে না পারেন, সে জন্য পাথরের দেওয়াল আর লোহার ডেক-এর মাঝখানে কাচের একটা স্বচ্ছ দেওয়াল আছে। জায়গাটা উঁচু বলে দূর থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। আটল্টল রকের সামনে গাড়ি পার্কিং এবং ক্যাম্পিং-এর ব্যাবস্থা আছে।

এর পরে গেলাম আর্চ রক দেখতে। গাড়ি চালাতে চালাতে রাস্তা থেকেই আর্চটা দেখা যায়। আর্চেস ন্যাশনাল পার্কে যে সমস্ত আর্চ দেখেছি সেই তুলনায় এটা খুবই ছোট। তাই আর নামলাম না। এগিয়ে গেলাম পরবর্তী গন্তব্যের দিকে। সেখানে পেট্রিফায়েড লগস বা প্রস্তুরিভূত গাছের গুঁড়ি আছে। প্রস্তুরিভূত হয়ে পড়ে আছে বিশাল গাছের গুঁড়ি। লোহার শিকল দিয়ে বিশালায়তন সেই গুঁড়ি ঘেরা। ক্যালিফোর্নিয়া, অ্যারিজোনা, নেভাডা— অনেক জায়গাতেই পেট্রিফায়েড লগস-এর পার্ক রয়েছে। অ্যারিজোনাতে একটা পেট্রিফায়েড ফরেস্ট রয়েছে। তবে, এখানকারটা একটু আলাদা। এই উপত্যকায় ক্যাকটাস জাতীয় গুল্ম ছাড়া বৃক্ষ শ্রেণির কোনও গাছ নেই। তা সত্ত্বেও এ জায়গায় এত বড় বড় প্রস্তুরিভূত গাছের গুঁড়ি! সত্যি অবাক ব্যাপার! পরে জেনেছিলাম, আনুমানিক আড়াই কোটি বছর আগে পার্শ্ববর্তী অরণ্য থেকে ভয়ঙ্কর এক বন্যাযর সময় গুঁড়িগুলি ভেসে আসে। ধীরে ধীরে মাটির নীচে চাপা পড়ে সেগুলি পাথরে পরিণত হয়। মজার ব্যাপার, এই ঘটনাটি ঘটে উপত্যকা সৃষ্টির প্রায় এক কোটি বছর আগে!

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ভিজিটর সেন্টার। পথে যেতে যেতে চোখে পড়ে, দূরে আগুনের হলকা মতো লাল স্যান্ডস্টোন। আর তার মাঝখান দিয়ে চলেছে কালো পিচের রাস্তা। এই রাস্তাতেই একটা লাল রঙের গাড়িতে চড়েছিলেন রণবীর কপূর এবং প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, ‘আনজানা আনজানি’ ছবিতে। ‘হ্যায়রত’ গানের প্রায় সমস্ত দৃশ্যই ভ্যালি অব ফায়ার-এ শ্যুটিং করা। আমরা যখন দর্শনার্থী কেন্দ্রে পৌঁছলাম, তখন রেঞ্জাররা এডুকেশনাল সেশন নিচ্ছিলেন। প্রবেশপথের সামনেটা বেশ সুন্দর! লাল রঙের দেওয়ালের মধ্যে বিভিন্ন আকারের গর্ত।

এখানে উপত্যকায় প্রাপ্ত বিভিন্ন জিনিসের একটা ছোট সংগ্রহালয় আছে। সেখানে পুয়েবলো ইন্ডিয়ানদের ব্যবহৃত সামগ্রীও যেমন রয়েছে, তেমন এই উপত্যকার বেশ কিছু জীবজন্তুর মডেলও রাখা আছে। কাচের বাক্সে আছে জ্যান্ত দু’টি সাপ। তবে তারা বিষাক্ত নয়। উপত্যকায় যে সমস্ত সাপ পাওয়া যায় সেগুলি হল, সাইড উইন্ডার, স্পেকলেড এবং মোহাভে গ্রিন র‌্যাটল স্নেক। ভিজিটর সেন্টারে আমরা যখন ঘুরছি, বৃদ্ধ এক মেক্সিকান ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হল। পরিচয় পর্বের পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি কি আপনার মেয়ের একটা ছবি তুলতে পারি?” আট মাসের কন্যা আমার। তার ছবি তুলে উনি কী করবেন? প্রথমে একটু ইতস্তত করছিলাম। অচেনা লোক! যদিও, ভদ্রতার খাতিরে হ্যাঁ বলতে হল। ভদ্রলোক ছবি তুলে, আমার ই-মেইল ঠিকানা নিয়ে গেলেন। বললেন, “ছবিটা মেইল করে দেব খন।” পরে যদিও তিনি ছবিটা পাঠিয়েছিলেন। ভিজিটর সেন্টারে কেনাকাটা করে আমরা রওনা দিলাম মাউস ট্যাঙ্কের উদ্দেশে।


প্রস্তুরীভূত গাছের গুঁড়ি

পার্কের আর এক রত্ন এই মাউস ট্যাঙ্ক। গাড়ি পার্ক করে একাই ট্রেইল নিলাম। কারণ স্ত্রীকে গাড়িতে থাকতে হল মেয়েকে খাওয়াবেন বলে। মোটামুটি সমতল বালুময় রাস্তা। এ দিকে ও দিকে ছড়িয়ে রয়েছে ছোট ছোট কাঁটাঝোপ। দু’ধারে লাল রঙের স্যান্ড স্টোনের দেওয়াল। তার গায়ে রয়েছে অসংখ্য পেট্রোগ্লিফ। সিকি মাইল চলে এসে পৌঁছলাম মাউস ট্যাঙ্কের ধারে। পাথরের মধ্যে একটা বড় খোদল। বৃষ্টির জল জমে ছোট একটা প্রাকৃতিক জলের ডোবা তৈরি হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে হয়তো কিছু নয়, তবে বাস্তুতন্ত্রে এর গুরুত্ব অসীম।

বর্তমানে আগুনের উপত্যকায় জলের জোগান আসে দেড় হাজার ফুট গভীর নলকূপ থেকে। কিন্তু অতীতে এখানে এই ক্ষুদ্র জলের কুণ্ড ছাড়া আর কোনও জলের অস্তিত্ব ছিল না। আর এই জলের টানে আদিম যুগে আদিবাসীরা যে এই রাস্তায় খুব ঘন ঘন আসত তার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে রাস্তার দু’ধারে আঁকা অসংখ্য পেট্রোগ্লিফে। চলার পথে অনেক জায়গায় দেখা গেল, ছোট ছোট পাথর স্তূপ করে রাখা আছে। ছোটবেলায় আমরা পিট্টু বলে একটা খেলা খেলতাম, ঠিক সেই রকম। এখানে এগুলিকে বলে ‘হুডুস’। লোককথা অনুসারে এগুলি নাকি মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত করে। যে যত উঁচু স্তূপ বানাতে পারবে, সে তত ভাগ্যবান!

মাউস ট্যাঙ্ক দেখে আমরা রওনা হলাম রামধনু দর্শন পয়েন্ট বা ‘রেনবো ভিস্তা’র উদ্দেশে। রাস্তাটা উঁচু হয়ে তার পর নীচে নেমেছে। আর সেই উঁচু জায়গাটাই হল রেনবো ভিস্তা। অনেক দূর থেকে দেখা যায়। লাল রঙের পাহাড়, সবুজ রঙের গাছ আর বিভিন্ন রঙের মিশেলে সে এক অপরূপ ছবি। পথে দেখা যায় কচ্ছপের মতন দেখতে পাথর, হংস প্রস্তর বা ‘ডাক রক’ এবং সাদা গম্বুজ বা ‘হোয়াইট ডোমস’।

রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ির ভেতর থেকেই দেখা যায়। এখানে রাস্তায় যানবাহনের গতি বেঁধে দেওয়া আছে ঘণ্টাপ্রতি প্রায় ২৫ মাইল। আমি একটু জোরেই গাড়ি চালাচ্ছিলাম। হঠাৎ সাইরেনের শব্দে চমকে দেখি, পিছনে পুলিশের গাড়ি নীল আলো জ্বালিয়ে আসছে। কিন্তু আমাকে ‘ফাইন’ না করে ইশারায় আস্তে চালাতে বলে চলে গেলেন পুলিশকর্মীরা। তার পর থেকে পুরো রাস্তা গতিসীমা মেনেই চালিয়েছি। ফাইন না করায় চার-পাঁচ হাজার টাকা এ যাত্রা বেঁচে গেল !

‘ডাক রক’ এবং ‘হোয়াইট ডোমস’ দেখে আমরা গেলাম পার্কের পূর্ব দিকে। প্রথমেই সাত বোন বা ‘সেভেন সিস্টারস’। রাস্তার উপর থেকেই দেখা যায় লাল রঙের বিশাল বিশাল সাতটা বড় পাথর সাজানো রয়েছে। দেখে আমার স্ত্রীর মোক্ষম প্রশ্ন, “এদের নাম সেভেন ব্রাদারস নয় কেন?” এর পর তাঁর মহান উক্তি, “ভাই হলে কেমন সুন্দর সাত ভাই চম্পা নাম দেওয়া যেত!” সেভেন সিস্টারস দেখে আমরা গেলাম পাথুরে হাতি বা ‘এলিফ্যন্ট রক’ দেখতে।

একটা ছোট ট্রেইল আছে পার্কিং লট থেকে। কিন্তু হাতিটাকে রাস্তার উপর থেকেই দেখা যায়। পাথর ক্ষয়ে হাতির শুঁড়, চারটে পা, দেহাবব গড়ে তুলেছে। এ ছাড়াও এখানে প্রত্যেকটি পাথর দীর্ঘ দিনের রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যে বিভিন্ন আকার ধারণ করেছে, সে সবের উল্লেখ পার্কের পরিচিতিপত্রে নেই। পাথরের উপর গড়ে ওঠা এই জীবজন্তুর অবয়ব দেখে মনে হয়, এখানে ভগবান যেন শিশুসুলভ খেয়ালে গড়ে তুলেছে আপন খেলাঘর।

আদি বাড়ি বর্ধমানে। শিবপুরের বেসু-র প্রাক্তনী বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে কর্মরত।
সেই সূত্রে দেশ-বিদেশে ঘোরা। সময় পেলেই ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়া এ দিক সে দিক।

sanjib pal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy