Advertisement
E-Paper

বুদ্ধজয়ন্তীতে লণ্ঠন উত্সব

এই নিয়ে দ্বিতীয় বার এসেছি দক্ষিণ কোরিয়ায়। ভারতীয় উপমহাদেশ-সহ এশিয়ার যে সমস্ত জায়গায় বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারিত হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, চিন, জাপান, তাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম-সহ পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই এই ধর্মের মানুষ রয়েছেন। গৌতম বুদ্ধের জন্ম নেপালের লুম্বিনীতে। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা সমস্ত জায়গাতেই বুদ্ধজয়ন্তী পালন করেন। দক্ষিণ কোরিয়াতেও তাঁর জন্মদিন পালিত হয় বড় ধুমধামের সঙ্গে। লিখছেন গৌতম বিশ্বাস।

গৌতম বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৪ ০০:০০

এই নিয়ে দ্বিতীয় বার এসেছি দক্ষিণ কোরিয়ায়। ভারতীয় উপমহাদেশ-সহ এশিয়ার যে সমস্ত জায়গায় বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারিত হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, চিন, জাপান, তাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম-সহ পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই এই ধর্মের মানুষ রয়েছেন। গৌতম বুদ্ধের জন্ম নেপালের লুম্বিনীতে। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা সমস্ত জায়গাতেই বুদ্ধজয়ন্তী পালন করেন। দক্ষিণ কোরিয়াতেও তাঁর জন্মদিন পালিত হয় বড় ধুমধামের সঙ্গে। এ বার এখানে এসে উঠেছি রাজধানী সোলে। সারা বছর কোনও না কোনও অনুষ্ঠান লেগেই আছে এই শহরে। এ দেশে দু’বার আসার কারণে একটা বিষয় আমার কাছে স্পষ্ট, কোরীয়রা আধুনিকতার মোড়কে নিজেদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যময় বিষয়গুলিকে খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেন।

বুদ্ধের জন্মদিন পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পালিত হয় চিনা চান্দ্রবছরের চতুর্থ মাসের অষ্টম দিনে। হিসেব মতো সেটি কখনও এপ্রিলে, কখনও বা মে মাসে পড়ে। তবে লিপ ইয়ার হলে জুন মাসে পড়ে এই দিনটি। ভারত ও তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতে বৈশাখী পূর্ণিমার দিন বুদ্ধজয়ন্তী পালিত হয়। একমাত্র জাপানে এই দিনটি পালিত হয় প্রতি বছর এপ্রিল মাসের আট তারিখে। হংকং এবং ম্যাকাওয়ের মতো দক্ষিণ কোরিয়াতে বুদ্ধজয়ন্তী জাতীয় ছুটির দিন।

এ বছর দক্ষিণ কোরিয়াতে বুদ্ধজয়ন্তী পালিত হয় ৬ মে। এক সপ্তাহ আগে থেকেই শুরু হয়েছিল প্রস্তুতিপর্ব। গোটা উত্সবটি ‘লোটাস ল্যান্টার্ন ফেস্টিভ্যাল’ নামে পরিচিত। বৌদ্ধরা লণ্ঠনকে জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে মনে করেন। সেই লণ্ঠন থেকে ছড়িয়ে পড়া আলো আসলে জ্ঞানের আলো বলেই তাঁদের বিশ্বাস। সমগ্র বিশ্বে সেই আলো ছড়িয়ে দিতেই এই উত্সবের আয়োজন। বুদ্ধকে সম্মান জানাতে লণ্ঠন জ্বালানোর এই প্রথা বৌদ্ধদের মধ্যে বেশ পুরনো। দক্ষিণ কোরিয়াতে একে ‘ইয়নডিয়ুং’ বলা হয়। এ দেশে এর সূচনা হয় গরেও (৯১৮-১৩৯২ খ্রিস্টাব্দ) এবং জসেয়ন (১৩৯২-১৯১০ খ্রিস্টাব্দ) সাম্রাজ্যের সময়ে। এখনও এই প্রথা বড় জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয় এখানে।

স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে এই উত্সবের সময় দক্ষিণ কোরিয়া খুব সুন্দর ভাবে সেজে ওঠে। রাস্তাঘাট তো বটেই, বৌদ্ধ মন্দিরের পাশাপাশি শহর সোলের বিভিন্ন জায়গা আলোকিত হয়ে ওঠে নানা রকম লণ্ঠনে। সে লণ্ঠন বিভিন্ন আকারের এবং ধরনের হয়। পদ্মফুল, পেঁচা, মানুষ, বিভিন্ন পশু, ড্রাগন— কী নেই তালিকায়! ছোট বাচ্চাদের জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্রদেরও দেখা যায় এই আলোকধারায়। প্রতিটি লণ্ঠন কোনও না কোনও অর্থ বহন করে। যেমন, কোনওটি সুস্বাস্থ্য কামনার জন্য, কোনওটি দীর্ঘায়ু কামনায়, আবার শস্যের ভাল ফলনের কামনাতেও লণ্ঠন জ্বালানো হয়। এগুলি তৈরি হয় রেশম, হানজি বা কোরীয় কাগজ দিয়ে।

দিন দশেক আগে ‘ইউলিম মাদাং’-এর মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠানের আবহ তৈরি হয়। বাদ্যযন্ত্র-সহ শহরের বিভিন্ন জায়গায় নাচ-গানের অনুষ্ঠান হয়।দূরদূরান্ত থেকে বৌদ্ধ ভক্তরা শহরে জড়ো হতে শুরু করেন এই সময়ে। সোল শহরের জগ্যেসা মন্দির দক্ষিণ কোরিয়ার বৌদ্ধদের প্রধান ধর্মচর্চা কেন্দ্র। মূল মন্দিরটি প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো। ‘ইউলিম মাদাং’-এর সময় ডংডিমুন গেট থেকে জগ্যেসা মন্দির পর্যন্ত বিশাল পদযাত্রা বের হয়। প্রত্যেকের হাতে থাকে ড্রাগন, প্যাগোডা, পদ্ম, পশু-পাখি— নানা রকমের লণ্ঠন। কোরীয় গান গাওয়া হয় এই মিছিলে। পদযাত্রা শেষ হয় বিশেষ ধরনের এক নৃত্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে। বৃত্তাকারে একে অপরের হাত ধরে, ফুলের পাঁপড়ি ছড়িয়ে সেই নাচ পরিবেশন করা হয়। মিছিল পরবর্তী এই অনুষ্ঠানের নাম ‘হোয়েহিয়াঙ্গ হানমাদাং’। মনের ইচ্ছা পূরণ করতে একটি কাগজে লিখে সেটা এই সময় পুড়িয়ে ফেলেন অনেকে।

জগ্যেসা মন্দিরের সামনের রাস্তায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। প্রাচীন কোরীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সেখানে মিলেমিশে যায় বৌদ্ধ সংস্কৃতিও। রাস্তার দু’ধারে বসে প্রচুর স্টল। সন্ন্যাসীদের তৈরি করা এই সব স্টলে পর্যটকেরা ইচ্ছে করলে নিজের হাতে লণ্ঠন তৈরি করতে পারেন। আঁকতে পারেন বুদ্ধের ছবিও। চা-কফির পাশাপাশি এখানে মেলে বিভিন্ন মন্দিরের প্রসাদও। ইচ্ছে করলে এখানে ধ্যানেও বসা যায়। চার দিকে কেমন মেলার আবহাওয়া! আমাদের দেশের মেলাগুলোর মতোই কাঠের বাসনপত্র, পোশাকআশাক, খাবারদাবার, খেলনা, গয়নাগাঁটির পসরা সাজিয়ে বসেন ব্যবসায়ীরা।

বুদ্ধজয়ন্তীর দিন সকাল থেকে বুদ্ধমন্দিরে চলে তাঁর আবাহন, স্তুতি ও প্রার্থনা। সুন্দর একটা ভক্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয় মন্দির চত্বরে। প্রসাদ হিসাবে বিতরণ করা হয় ‘বিবিমপাব’। বিবিম মানে এক ধরনের কোরিয়ান সস আর পাব মানে ভাত। স্তুতি, প্রার্থনা, আলো ও লণ্ঠন— সব মিলিয়ে সে এক মায়াবী পরিবেশ। আমাদের দুর্গাপুজোর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। তবে আমার মতো প্রবাসী বাঙালিরা, যাঁরা দেশের বাইরে থেকে দুর্গাপুজোকে অনুভব করতে পারেন না, তাঁদের কাছে বিদেশের এই বুদ্ধজয়ন্তী এক ঝলক দখিনা বাতাস।

কলকাতার বেহালায় বাড়ি হলেও কর্মসূত্রে আপাতত
দক্ষিণ কোরিয়ার সোলের বাসিন্দা। গবেষণা এবং
পড়ানোর বাইরে ভাল লাগার বিষয় বলতে ফটোগ্রাফি এবং ভ্রমণ।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy