Advertisement
১৯ মে ২০২৪

হান্সের আপন দেশে

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসে একটি কথা বারে বারে আসে: জলের ধারে বাস, ভাবনা বারো মাস। এই বাক্য একটু পাল্টে এ দেশ সম্পর্কে অনায়াসেই বলা যায়, জলের নীচে বাস, ভাবনা বারো মাস। খুব অবাক লেগেছিল। আসলে, নেদারল্যান্ডসের স্থলভাগের উচ্চতা সমুদ্রের জলতলের থেকে অনেক নিচু। তাই বাঁধ দিয়ে পুরো দেশটা ঘিরে রাখা হয়েছে। সে বাঁধ অবশ্য আমাদের দেশের মতো নয় যে, সামান্য জলচ্ছ্বাসেই ভেঙে যাবে! নাগরিকরাও বাঁধ নিয়ে খুবই সচেতন। প্রত্যেকের উপার্জনের কিছু অংশ দিয়ে বাঁধের দেখভাল করা হয়। তা ছাড়া জলতলকে সমান রাখার জন্য আরও একটি উপায় অবলম্বন করে এরা। গোটা দেশ জুড়ে প্রচুর খাল কাটা আছে। লিখছেন অর্পিতা জানা দাশ।

অর্পিতা জানা দাশ
শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

এক যে আছে মজার দেশ
সব রকমের ভাল
রাতে সেথায় বেজায় রোদ
দিনে চাঁদের আলো...

সম্প্রতি সেই রকমই একটা মজার দেশে গিয়েছিলাম। নেদারল্যান্ডস। এ দেশেরই পুরনো নাম হল্যান্ড। আমার কাছে যদিও, এ দেশ ফুটবলের। স্বামীর কর্মসূত্রেই আমার নেদারল্যান্ডস যাত্রা।

আকাশপথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম নতুন দেশে। রবি ঠাকুরের ‘তাসের দেশ’-এ রাজপুত্র এবং সওদাগরপুত্রের বাণিজ্যতরি ডুবে যাওয়ার পর, তারা এক নতুন দেশে পৌঁছয়। সে দেশে পৌঁছে তারা যেমন অবাক হয়ে গিয়েছিল, নেদারল্যান্ডস এসে আমারও একই অবস্থা। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর, এই সময়টায় এখানে গরমকাল। রাত ১০টা পর্যন্ত সূর্যের আলো থাকে। সম্পূর্ণ অন্ধকার নামতে রাত প্রায় সাড়ে ১১টা বেজে যায়। সূর্যোদয়ও হয় খুব ভোরে। শীতকাল যত এগিয়ে আসে, ততই দিনের ব্যাপ্তি কমতে থাকে।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসে একটি কথা বারে বারে আসে: জলের ধারে বাস, ভাবনা বারো মাস। এই বাক্য একটু পাল্টে এ দেশ সম্পর্কে অনায়াসেই বলা যায়, জলের নীচে বাস, ভাবনা বারো মাস। খুব অবাক লেগেছিল। আসলে, নেদারল্যান্ডসের স্থলভাগের উচ্চতা সমুদ্রের জলতলের থেকে অনেক নিচু। তাই বাঁধ দিয়ে পুরো দেশটা ঘিরে রাখা হয়েছে। সে বাঁধ অবশ্য আমাদের দেশের মতো নয় যে, সামান্য জলচ্ছ্বাসেই ভেঙে যাবে! নাগরিকরাও বাঁধ নিয়ে খুবই সচেতন। প্রত্যেকের উপার্জনের কিছু অংশ দিয়ে বাঁধের দেখভাল করা হয়। তা ছাড়া জলতলকে সমান রাখার জন্য আরও একটি উপায় অবলম্বন করে এরা। গোটা দেশ জুড়ে প্রচুর খাল কাটা আছে। সমুদ্রের সঙ্গে এই খালগুলির যোগাযোগ আছে নদীর মাধ্যমে। এ ভাবে ভৌগলিক অসুবিধাগুলিকে এ দেশের মানুষ কিছুটা হলেও অতিক্রম করতে পেরেছে। খালগুলির উপর রীতিমতো নৌবিহার করা যায়। ফলে, সমগ্র দেশে একটা পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সে ব্যবস্থা এমনই যে, গোটা দেশেই জলপথে ভ্রমণ করা যায়। কখনও খালের উপরে রাস্তা, কখনও বা সে রাস্তা খালের নীচে দিয়ে। ছোট্ট দেশ, অথচ কী সুন্দর সাজানোগোছানো!

এখানকার আন্তর্জাতিক আমস্টারডম বিমানবন্দরটিও বেশ সুন্দর। একেবারে রাস্তার ধারে। যাওয়া-আসার পথের ধারে হওয়ায়, খুব সহজেই যাতায়াতের সময় বিমানের ওঠা-নামা দেখা যায়। আর একটা জায়গা আছে, যেখানে রাস্তার উপর উড়ালপুল রয়েছে। সেই সেতুর উপর দিয়ে বিমান হেঁটে যাতায়াত করে। এক বার হল কি, নীচে দিয়ে আমরা গাড়ি করে যাচ্ছি, আর উপর দিয়ে বিমান হেঁটে চলেছে। আমি তো ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম। ভাবছিলাম, এ বার বুঝি মাথার উপর ভেঙে পড়ল! হাওড়া স্টেশনে ঢোকার মুখে ট্রেন যেমন দাঁড়িয়ে থাকে আউটারে, প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা পেলে তবেই ঢুকবে, তেমনই এখানে আকাশে বিমান অপেক্ষা করে নামবে বলে। দূর থেকে দেখা যায়, আকাশে অসংখ্য আলো মিটমিট করে জ্বলছে। কিছু ক্ষণ পরে ভুল ভাঙবে। আস্তে আস্তে সেই আলো এগিয়ে আসতে থাকে। বড় হতে থাকে সেই আলো। তার পর মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে কিছু দূরেই নেমে যায়।

জলপথে যেমন দেশটা ঘুরে নেওয়া যায়, তেমন ভাবে সাইকেলে চড়েও দেখে নেওয়া যায় প্রায় গোটা নেদারল্যান্ডস। গাড়ি যাতায়াতের পথের পাশে একটি সমান্তরাল রাস্তা আছে। সেটাই সাইকেল-পথ। এখানকার বহু মানুষই এই দু’চাকার যান ব্যবহার করে। ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও বেশ উন্নত। সাইকেল আরোহীদের মতো পথচারীদের জন্যও রাস্তা নির্দিষ্ট। রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে সব সময় পথচারীদের গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমাদের দেশে যেমন পথ-আইন ভাঙাই রেওয়াজ, এ দেশে ঠিক তার উল্টো। নিয়ম ভেঙে চলা মানুষ সত্যিই ব্যতিক্রমী এখানে।

নেদারল্যান্ডস খুবই ছোট দেশ। আয়তনে হয়তো পশ্চিমবঙ্গের সমান বা তার থেকেও ছোট। ভাষা ডাচ। তাই এখানকার নাগরিকদের গোটা বিশ্ব ডাচ নামেই চেনে। এরা ছিল প্রধানত নাবিক। ইতিহাসের পাতায় আমরা যাদের ওলন্দাজ বলে চিনি, এরাই তারা। প্রত্যেকে বেশ লম্বা। দুধ এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য তৈরিতে এই দেশ যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী। আধুনিক এবং স্বাস্থ্যসম্মত দুগ্ধজাত পণ্য তৈরি করে বলে এ দেশের আর এক নাম, পোল্ডারল্যান্ড। মানুষ যেমন দীর্ঘাঙ্গী, তেমন এখানকার গরুরাও বিশাল বপুর। একটা কথা শুনলাম, প্রত্যেক গরুর কানেই নাকি ট্রান্সমিটার লাগানো আছে! তাই রাখালের কোনও প্রয়োজন নেই। এক জায়গায় বসে নির্দেশ দিলে, সেই মতো সব গরু এগিয়ে যাবে বা পিছোবে! শুনে হাসি চেপে রাখা দায় হয়েছিল।

খুব বেশি দিন হয়নি, শপিং মল কনসেপ্টের সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি। আমাদের দেশের ছোট-বড় প্রায় সব শহরেই এখন গড়ে উঠেছে এই এক ছাতার তলায় সব পেয়েছির সম্ভার। নেদারল্যান্ডসে কিন্তু প্রায় সব দোকানই এই ঘরনের। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের পাশাপাশি সবই মেলে সেখানে। এগুলিকে বলা হয় সুপার মার্কেট। প্রত্যেক এলাকাতে একটি নির্দিষ্ট দিনে খোলা বাজার বসে। কিছুটা আমাদের হাটের মতো। তবে এ দেশে তার নাম ফ্রেশ মার্কেট। বহু দূর থেকে বিক্রেতারা আসেন, মাছ-সব্জি-জামাকাপড় থেকে অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে। তবে এ সবের অন্য দোকানও আছে। সেগুলো যদিও একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলেই অবস্থিত। একটি বিশেষ রাস্তার দু’দিকে দোকানগুলি সাজানো। সেই রাস্তার নাম ‘মেন শপিং স্ট্রিট’। সব দোকান বিকেল পাঁচটায় বন্ধ হয়ে যায়। শুধুমাত্র সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে রাত ন’টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

যে শহরটায় আমরা আছি, তার নাম হারলেম। আমস্টারডম থেকে মিনিট কুড়ি সময় লাগে। ছোট্ট শহর। টাউনহলের উল্টো দিকে একটা বাড়ির দোতলায় আমাদের আস্তানা। এ বাড়িতে অদ্ভুত সুন্দর একটা ছাদ আছে। আমার খুব পছন্দের জায়গা সেটা। সব বাড়ি গায়ে গায়ে লাগানো। সবার আলাদা আলাদা নম্বর। রাস্তার এক দিকে জোড় নম্বরের বাড়ি। আর অন্য দিকে বিজোড়ের। বাড়ির নম্বর খুঁজে পেতে তাই কোনও অসুবিধা হয় না। আমরা যে বাড়িতে আছি, তার ঠিক সামনেই একটা খাল। বহু মানুষ সে পথে যাতায়াত করেন। শুনেছি এখানে অনেকেরই ব্যক্তিগত নৌকা আছে। বাড়ি থেকে কিছুটা এগোলেই নদী। এখানকার নদীগুলো খুব একটা চওড়া নয়, তবে বেশ গভীর। বড় বড় জাহাজও যাতায়াত করে। রটারডমে সমুদ্রবন্দর আছে। এক সময়ে এই বন্দরই ছিল গোটা ইউরোপের প্রধান বন্দর। হারলেম ছাড়াও আছে ডেলফ, ম্যাসট্রিক্ট, ইউট্রেটের মতো বড় শহর। এই শহরগুলো বেশ পুরনো, কোনওটা আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে নতুন করে সেজেছে।

সমগ্র ইউরোপের মধ্যে নেদারল্যান্ডসে সংগ্রহশালার সংখ্যা সব থেকে বেশি। এদের মধ্যে অন্যতম ‘আনা ফ্রাঙ্ক হাউস’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের অত্যাচার থেকে বাঁচতে এক ইহুদি পরিবার আমস্টারডমের একটি বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেই পরিবারের এক কিশোরী, নাম আনা, তার অভিজ্ঞতার কথা একটি ডায়েরিতে লিখে রেখেছিল। খাবারের জোগান নেই, আলো নেই ঘরে। এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে লেখা হয়েছিল ‘আনা ফ্রাঙ্কস ডায়েরি’। অসুস্থ আনা যদিও জীবনযুদ্ধে বেশি দিন লড়াই করে টিকে থাকতে পারেনি। তাদের সেই পুরনো বাসস্থানই একটি আস্ত সংগ্রহশালা হয়ে উঠেছে। হিটলারের অত্যাচারের নানা চিত্র এবং সাধারণ মানুষের কষ্টকর জীবনের বিভিন্ন নিদর্শন এখানে রাখা আছে।

নেদারল্যান্ডসের নাগরিকদের ঘর সাজানো এবং ফুলের প্রতি ভীষণ আগ্রহ। শুধু ঘর নয়, রাস্তাকেও এরা ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখে। এ দেশকে তাই ইউরোপের ফুলের বাগান বলা হয়। এখানকার টিউলিপ বিশ্বখ্যাত।

হাওয়াকল এ দেশের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। এই কলকে কাজে লাগিয়ে আগে বিদ্যুৎ তৈরি, শস্য পেষাই, পাথর ভাঙার মতো কাজ করা হত। হাওয়াকলের দিন ফুরিয়েছে। এখন এগুলি শুধু পর্যটকদের দর্শনীয় এবং আকর্ষণীয় বস্তু। জানসে সান্স নামে একটা জায়গায় অনেক হাওয়াকল আছে। এখানে ডাচদের প্রাচীন জীবনধারা নিয়ে একটি খোলা সংগ্রহশালা তৈরি হয়েছে সরকারি উদ্যোগে।

নতুন আবহাওয়া। ভিন্ন ভৌগলিক পরিবেশ। ভিন্ন ইতিহাস ও সমাজ চেতনার দর্শন। নতুন দেশে বিভিন্ন জাতির মানুষের সঙ্গে পরিচয়। সব মিলিয়ে নেদারল্যান্ডস আমার কাছে এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা।

দক্ষিণ কলকাতার চেতলার মেয়ে। বিবাহের পরে দুর্গানগর, দমদমের বাসিন্দা। আলিপুর মাল্টিপারপাস রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, শাখাওয়াত মেমোরিয়াল রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলায় স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং বি এড শেষে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃত্যে স্নাতকোত্তর। পেশায় শিক্ষিকা। বর্তমানে কিছু দিনের জন্য স্বামীর সঙ্গে বিদেশে পাড়ি। আপাতত ঠিকানা নেদারল্যান্ডস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE