Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

পর্বতের ফাটলেই কি আটকে রয়েছেন ছন্দা, চলবে খোঁজ

পা পিছলে পড়ে গিয়ে থাকলে ছন্দা গায়েনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? তাশি শেরপার মুখ থেকে দুর্ঘটনার বয়ান সামনে আসার পর এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছে ছন্দার পরিবার এবং বন্ধু-স্বজনদের মনে। তবে রাজ্য সরকারের উদ্ধারকারী দল কপ্টার থেকে দুর্ঘটনাস্থলটি যতটা দেখেছে, তাতে তাদের আশঙ্কা ছন্দারা কোনও ফাটলের মধ্যে পড়ে গিয়ে থাকতে পারেন। সেই জন্যই দুর্ঘটনার পর এক সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পরেও তাঁদের কোনও চিহ্ন মিলছে না।

বিধ্বস্ত জয়া গায়েন। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

বিধ্বস্ত জয়া গায়েন। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
কাঠমান্ডু শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৪ ০২:২১
Share: Save:

পা পিছলে পড়ে গিয়ে থাকলে ছন্দা গায়েনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? তাশি শেরপার মুখ থেকে দুর্ঘটনার বয়ান সামনে আসার পর এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছে ছন্দার পরিবার এবং বন্ধু-স্বজনদের মনে। তবে রাজ্য সরকারের উদ্ধারকারী দল কপ্টার থেকে দুর্ঘটনাস্থলটি যতটা দেখেছে, তাতে তাদের আশঙ্কা ছন্দারা কোনও ফাটলের মধ্যে পড়ে গিয়ে থাকতে পারেন। সেই জন্যই দুর্ঘটনার পর এক সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পরেও তাঁদের কোনও চিহ্ন মিলছে না।

ছন্দার দুর্ঘটনার খবর আসার পর প্রথমে জানা গিয়েছিল, আকস্মিক তুষারধসের সামনে পড়েই হারিয়ে গিয়েছেন ছন্দা ও তাঁর সঙ্গী দুই শেরপা। ২৪ মে, উদ্ধারকারী কপ্টার জায়গাটি ঘুরে এসে জানায়, ছন্দাদের দেখতে পাওয়া যায়নি। তখন অনেকেই মনে করেছিলেন, তুষারের তলায় চাপা পড়ে গিয়ে থাকতে পারেন ছন্দারা। সে কারণেই হয়তো তাঁদের কোনও চিহ্ন কপ্টারের ক্যামেরায় ধরা পড়েনি।

কিন্তু ছন্দার দল থেকে সমতলে ফিরে আসা একমাত্র সদস্য তাশি শেরপা মঙ্গলবার জানিয়েছেন তুষারধস নয়, পা ফস্কেই পড়ে গিয়েছিলেন ছন্দা। আলগা একটি দড়িতে বাঁধা ছিলেন ছন্দা, দাওয়া শেরপা এবং তেমবা শেরপা। ছন্দা পড়ে গেলে তাঁকে আটকাতে গিয়ে পড়েন তেমবা। ওই দু’জনের ওজনের হ্যাঁচকা টানে খসে আসে বরফের তাল। এবং পড়ে যান দাওয়া-ও। কিন্তু তা হলে তাঁরা এ ভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেন কী করে? সব জানার পর ছন্দা গায়েনের মা জয়া এই প্রশ্নটাই আজ করেছেন অভিযানের অন্য সদস্য দীপঙ্কর ঘোষকে।

কলকাতা থেকে কাঠমান্ডু পৌঁছনো উদ্ধারকারী দলের সদস্য, রাজ্য যুবকল্যাণ দফতরের পর্বতারোহণ বিভাগের মুখ্য উপদেষ্টা উজ্জ্বল রায় এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর কথায়, প্রাকৃতিক তুষারধস না হলেও ছন্দারা তিন জন একসঙ্গে পড়ার ফলে যে পরিমাণ আলগা বরফ ধসেছিল, তা প্রায় তুষারধসেরই সমান। তার চেয়েও বড় কথা, ওই জায়গায় পাহাড়ের নীচের অংশে অনেকগুলো বড় ‘ক্রিভাস’ বা ফাটল আছে। তারই কোনও একটাতে যদি ছন্দারা পড়ে গিয়ে থাকেন, খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। তা-ও শেষ চেষ্টা হিসেবে ‘গ্রাউন্ড সার্চ’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন উজ্জ্বলরা। পাহাড়ে নেমে পায়ে হেঁটে খুঁজে দেখা হবে, ছন্দারা কোথায়।

উজ্জ্বল বললেন, “আমরা কপ্টারে গিয়ে কাছ থেকে দেখেছি জায়গাটা। ওই গড়িয়ে যাওয়া অংশের তলাটা শেষ হয়েছে একটা গোল বাটির মতো জায়গায়। পাহাড়ি পরিভাষায় যাকে বলে ‘বেসিন’। ‘বেসিন’টা অসংখ্য ‘ক্রিভাস’ বা ফাটলে ভরা। সেগুলি কতটা গভীর কেউ জানে না।”

তবে ভারতীয় দূতাবাস ও নেপালের পর্যটন মন্ত্রকের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে আজ। গ্রাউন্ড সার্চের জন্য তিন জন দক্ষ শেরপার নামও ঠিক হয়েছে। তাঁদের মধ্যে এক জন তাশি। তবে সবার আগে দরকার, পরিষ্কার আবহাওয়া। বুধবার সারা দিনই পরিষ্কার ছিল আকাশ। কিন্তু আবহাওয়া দফতর সূত্রের খবর, প্রায় দেড় মিটার পুরু বরফে ঢেকে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা বেসক্যাম্প এলাকা। তার থেকেও উপরে ছন্দাদের দুর্ঘটনাস্থল। জায়গাটি আক্ষরিক অর্থেই ‘ডেথ জোন’। অসংখ্য খোলা ও লুকোনো ‘ক্রিভাসে’ ভর্তি। সব সময়ই পাথর খসে পড়া বা তুষারধসের আশঙ্কা থাকে ওখানে। উজ্জ্বল জানালেন, কী ভাবে কাজ হবে তা বিস্তারিত জানানো হয়েছে রাজ্য সরকারকে। আবহাওয়া সঙ্গ দিলেই শুরু হবে গ্রাউন্ড সার্চ।

২১ তারিখ দুপুরে ছন্দাদের দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পরে বিকেল পাঁচটার মধ্যেই রাজ্যের যুবকল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছিলেন উজ্জ্বল। ২২ তারিখ বিকেলে কাঠমান্ডু চলে আসেন তিনি। যুব কল্যাণ দফতরের পর্বতারোহণ বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর প্রশান্তকুমার মণ্ডল এবং এভারেস্টজয়ী পর্বতারোহী দেবদাস নন্দী ছিলেন সঙ্গে। পর দিন যোগ দেন হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষক তুষার তপাদার।

২৩ তারিখেই কপ্টার নিয়ে বেরোন উজ্জ্বলরা। এভারেস্ট বেসক্যাম্পের কাছে লুকলায় গিয়ে সুদক্ষ ইতালীয় পাইলট মরিজোঁকে সঙ্গে নিয়ে নেন। হিমালয়ের একাধিক দুর্গম অঞ্চলে উদ্ধারকাজ চালানোর জন্য কপ্টার-পাইলট হিসেবে মরিজোঁ বিখ্যাত। কিন্তু বাদ সাধল আবহাওয়া। বেশি দূর উড়তে পারল না কপ্টার।

২৪ তারিখ আকাশ পরিষ্কার থাকায় ভোর সাড়ে ছ’টার মধ্যে কাঞ্চনজঙ্ঘা বেসক্যাম্পে পৌঁছে গিয়েছিলেন ওঁরা। তাশি শেরপা ওখানেই ছিলেন। তাঁকে কপ্টারে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন উজ্জ্বল আর দেবদাস। মরিজোঁ তো ছিলেনই। দুর্ঘটনার জায়গাটা সেদিনই ওঁদের প্রথম দেখান তাশি।

ইয়ালুং কাং-এর ওই প্রচণ্ড ৮০ ডিগ্রি খাড়া অংশ থেকে নীচের সরু অংশটা লম্বা হয়ে নেমেছে হাজার মিটারেরও বেশি। উজ্জ্বলের ভাষায়, জায়গাটা দেখতে, একটা ফানেলকে লম্বালম্বি ভাবে কেটে আধখানা করলে যেমন হয়, সে রকম। তাশির কথা মতো, সেখান দিয়েই গড়িয়ে গিয়েছেন ছন্দারা। পুরো জায়গাটা জুড়ে চক্কর কাটতে শুরু করেছিল কপ্টার। কিন্তু বেসিনের মধ্যে ঢোকা সম্ভব হয়নি।

কেন? উদ্ধারকারীরা জানাচ্ছেন, বেসিনের চার পাশে ঘিরে থাকা পাহাড়ের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে যাচ্ছিল কপ্টার। গোল করে ঘোরানো যাচ্ছিল না কপ্টারের মুখ। শুধু তা-ই নয়, ওই গোলের ভিতরে হেলিকপ্টার একটু নীচে নামালেই তার কম্পনে ঝুর ঝুর করে পড়তে থাকছিল পাথর-বরফ। তাতে আরও চাপা পড়ে যাচ্ছিল ছন্দাদের পড়ে যাওয়ার সম্ভাব্য জায়গাটা। তাই যতটা সম্ভব নীচ থেকে বার পাঁচেক চক্কর কাটা হয়। কপ্টারে লাগানো ছিল ক্যামেরা। উজ্জ্বলদের সঙ্গেও ছিল ক্যামেরা আর বাইনোকুলার। উজ্জ্বল জানালেন, ফেরার সময় বারবারই মেঘের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছিল হেলিকপ্টার। “মনে হচ্ছিল, এমন কিছু ঘটে যেতে পারে, যাতে আমাদেরকেই উদ্ধার করতে আবার কাউকে আসতে হবে।”

পরের দিন, মানে রবিবার সকাল থেকে এক বারও সরেনি মেঘের পর্দা। ফলে সম্ভব হয়নি কপ্টার অভিযান। সোমবার কপ্টার উড়লেও পৌঁছতে পারেনি বেসক্যাম্প। বৃহস্পতিবার আবহাওয়া ভাল থাকলে শুরু হবে গ্রাউন্ড সার্চ। ছন্দার অভিযানের ব্যবস্থাপক মিংমা শেরপা জানাচ্ছেন, এর জন্য কম করে তিন দিন টানা আকাশ পরিষ্কার থাকতে হবে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস সে সম্ভাবনা কিন্তু দেখাচ্ছে না। বরং বর্ষা ঢুকে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে প্রায়।

চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, সাড়ে সাত হাজার মিটার উচ্চতায় খোলা আকাশের নীচে এত দিন বেঁচে থাকা অসম্ভব। কিন্তু অসম্ভবকে সম্ভব করতেই তো ছুটেছিলেন ছন্দা।

আর তাঁর সঙ্গে ছিলেন অসম্ভবের পথিক আরও দু’টি মানুষ। কোনও ম্যাজিক কি ঘটতে পারে না? খড়কুটোর মতো এই প্রশ্নটাই আঁকড়ে ছন্দার শুভানুধ্যায়ীরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

tiash mukhopahyay kathmundu chhanda gayen
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE