লেখাপড়া শেষ করার আগে কিছুতেই বিয়ে নয়। বাবা-মা বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগলেও এমন সঙ্কল্পে ভর করে ১৬ বছরের কিশোরীটি সোমবার বিকেলে কান্দি থেকে সোজা পৌঁছে গিয়েছিল কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির কাছে। এবং আপাতত রেহাই পেয়েছে বাল্য বিবাহের হাত থেকে।
মেয়েটির সঙ্কল্প ও সাহস নিশ্চয়ই শাবাশির যোগ্য। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, নিকটজনেরা ধরেবেঁধে বিয়ে দিতে চাওয়ায় অসহায় নাবালিকাকে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির দোরগোড়া পর্যন্ত পৌঁছনোরই বা প্রয়োজন হবে কেন? বাংলার সব কিশোরীই তো কান্দির ওই মেয়েটির মতো নয়। যারা মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না, যারা বাড়ির লোকের জবরদস্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবে না, যারা বাড়ি থেকে বেরোনোরই সাহস পাবে না— কী হবে তাদের? বাল্য বিবাহের জুজুর হাত থেকে তাদের বাঁচাবে কে?
প্রতিকারের জন্য রাজ্যের নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতর মূলত জোর দিচ্ছে একটি টেলিফোন নম্বরের উপরেই। সেই টোল-ফ্রি নম্বরটি হল ১০৯৮। ওই দফতরের কর্তাদের বক্তব্য. নম্বরটি ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে। ফোন করলে সঙ্গে সঙ্গে যাতে সাহায্য মেলে, সেই জন্যই এই ব্যবস্থা। দফতরের দাবি অনুযায়ী ওই নম্বরে ফোন করলেই ‘চাইল্ডলাইন’-এর লোকজন পুলিশ নিয়ে দ্রুত পৌঁছে যাবেন বিপন্ন নাবালিকার কাছে। চাইল্ডলাইন হল শিশু, বালক-বালিকাদের ত্রাণ ও উদ্ধারের কেন্দ্রীয় প্রকল্প। ত্রাণ ও উদ্ধারের কাজটা করে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তাদের কাছে পৌঁছনোর নম্বর ওই ১০৯৮।
মুশকিল হল, ২০ বছর আগে ওই নম্বর চালু হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই তার অস্তিত্বের কথা জানে না। এই অবস্থায় জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে তো বটেই, সেই সঙ্গে শহর-শহরাঞ্চলেও ওই নম্বর সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারে নামছে নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতর। ঠিকঠাক প্রচার করা গেলে ওই টোল-ফ্রি নম্বরই যে ফল দেয়, তার নজির কম নেই।
সম্প্রতি খাস কলকাতার প্রগতি ময়দান এলাকা থেকে এক রাতে চাইল্ডলাইনের ওই টোল-ফ্রি নম্বরে ফোন করে নিজের বিয়ে বন্ধ করার জন্য সাহায্য চেয়েছিল বছর ষোলোর এক কিশোরী। বিয়ের পিঁড়িতে বসার কয়েক ঘণ্টা আগে এক বান্ধবীর কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে সে ফোন করে আর্জি জানায়, ‘‘আমি পড়তে চাই। কিন্তু বাড়ির লোক জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। আমাকে বাঁচান।’’
শুধু চাইল্ডলাইন বা তাদের ত্রাণ-নম্বর নয়। বালিকা বিয়ের সমস্যা থেকে নাবালিকাদের বাঁচাতে কন্যাশ্রী প্রকল্পও হাতিয়ার হতে পারে বলে জানাচ্ছেন নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতরের সচিব রোশনী সেন। তাঁর বক্তব্য, কন্যাশ্রী প্রকল্পের মাধ্যমে রাজ্য সরকার এখনও পর্যন্ত ৭০ শতাংশ নাবালিকার কাছে পৌঁছেছে। এটা ১০০ শতাংশে পৌঁছলে সমস্যার সমাধান অনেকটাই হবে। রোশনীদেবী বলেন, ‘‘কন্যাশ্রী প্রকল্পের উদ্দেশ্যই হল, স্কুলছুট আটকানো আর বাল্য বিবাহ রোধ করা। এই প্রকল্পের আওতায় আরও বেশি সংখ্যক নাবালিকাকে নিয়ে আসতে পারলেই অনেকটা কাজ হবে।’’ তাঁর দফতরের হিসেব অনুযায়ী গত তিন বছরে রাজ্যের প্রায় ৩৩ লক্ষ মেয়ে এই প্রকল্পের আওতায় এসেছে। আর সর্বভারতীয় পরিসংখ্যান বলছে, বাল্য বিবাহে দেশের প্রথম পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে আছে পশ্চিমবঙ্গ।
অর্থাৎ বালিকা বিয়ে পুরোপুরি বন্ধ করতে বাংলাকে হাঁটতে হবে আরও অনেকটা পথ।
কন্যাশ্রী প্রকল্পে অষ্টম শ্রেণি থেকে ছাত্রীদের বছরে মাথাপিছু ৭৫০ টাকা দেওয়া হচ্ছে। আর ১৮ বছর বয়স হয়ে গেলে মিলছে এককালীন ২৫ হাজার টাকা। তবে সেই সময়ে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার নাম নথিভুক্ত থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট দফতর বলছে, রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা, বিশেষ করে পরিসংখ্যান ও নথি যেখানে নাবালিকাদের বিয়ের সাক্ষ্য দিচ্ছে, সেই সব জায়গায় ‘পকেট’ তৈরি করে করে জোরদার প্রচার চালানো হচ্ছে বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে।
কিন্তু এত এত কাজ হচ্ছে বলে দফতরের এমন ফিরিস্তির মধ্যেও তো সোমবার কান্দি থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালীঘাটের বাড়িতে ছুটে আসতে হল কিশোরীকে! কেন? এমন তো অসংখ্য নাবালিকা আছে, যারা এই ভাবে বাড়ি ছেড়ে বেরোতে পারে না বলে তাদের কথা জানাই যায় না! তাদের দুরবস্থার প্রতিকারও হয় না! শুধু টোল-ফ্রি ত্রাণ-নম্বর বা কন্যাশ্রী কি তাদের বাঁচাতে পারবে?
বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বালিকা বিয়ের কুফল প্রচার করেও যে অনেক ক্ষেত্রে কোনও কাজ হচ্ছে না, নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতর সেটা স্বীকার করে নিচ্ছে। তারা বলছে, গ্রামেগঞ্জে এই ধরনের বেশ কিছু এলাকা ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করা হয়েছে। ‘‘ওই সব এলাকার বাসিন্দাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ,’’ বলছেন দফতরের আধিকারিকেরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy