Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

দরজা ঠেললেই বাবা বলছেন, সৌরভ এলি রে

ভেজানো দরজা ঠেলতেই ভিতর থেকে কাঁপা গলায় উড়ে এল উৎকণ্ঠা, “সৌরভ এলি নাকি রে!” দুপুর গড়িয়ে মেঘে মেঘে তখন বিকেল নেমেছে। গলির মোড়ে একের পর এক জটলা কাটিয়ে দত্তপুকুরের কুলবেড়িয়ার শীর্ণ গলির প্রান্তে দু-কামরার বাড়ি। ছায়াছন্ন বারান্দা। পর পর দু’টি ঘর।

শোকস্তব্ধ। সৌরভের বাবা সরোজ ও মা মিতা চৌধুরী। —নিজস্ব চিত্র

শোকস্তব্ধ। সৌরভের বাবা সরোজ ও মা মিতা চৌধুরী। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
দত্তপুকুর শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৪ ০৩:১৫
Share: Save:

ভেজানো দরজা ঠেলতেই ভিতর থেকে কাঁপা গলায় উড়ে এল উৎকণ্ঠা, “সৌরভ এলি নাকি রে!”

দুপুর গড়িয়ে মেঘে মেঘে তখন বিকেল নেমেছে। গলির মোড়ে একের পর এক জটলা কাটিয়ে দত্তপুকুরের কুলবেড়িয়ার শীর্ণ গলির প্রান্তে দু-কামরার বাড়ি। ছায়াছন্ন বারান্দা। পর পর দু’টি ঘর। বাইরের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পড়শি আর স্বজন-বন্ধুর চাক বাঁধা ভিড় দেখে তখনই কি কিছু আঁচ করে ছিলেন সরোজবাবু (চৌধুরী)?

আটপৌরে লুঙ্গি-জামা, জিওলজিক্যাল সার্ভের কর্মীর গলায় তখনও আশা, ছেলে হয়তো ফিরল! সারা দিন ওই ঘরেই ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি নিয়ে বসে আছেন তিনি। আর কেউ দরজা ঠেলে ভিতরে এলে ছুড়ে দিচ্ছেন উদ্বেগ ছেলে ফিরল?

অন্য ঘরে মা মিতাদেবী। আত্মীয়েরা ঘিরে রয়েছেন তাঁকে। জ্ঞান নেই সকাল থেকেই। পড়শিরা জানাচ্ছেন, দিন কয়েক আগেই ব্রেন-টিউমার অস্ত্রোপচারের পর থেকেই সুস্থ ছিলেন না। ছেলে না-ফেরায় সকাল থেকেই শয্যা নিয়েছেন।

ঘর-বার পাগলের মতো ছটফট করছেন সৌরভের দাদা সন্দীপ। সব জেনেও বাবা-মার কাছে আড়াল করতে হচ্ছে ভাইয়ের ছিন্ন-ভিন্ন মৃত্যুর খবরটা। বলছেন, “কী বলব বলুন তো! রাতে ছাদে উঠেছিলাম সিগারেট খেতে। তখনও দেখলাম ফোন-কানে সামনের রাস্তায় ঘুরছে ঘন্টু (সৌরভ)। শ্যামলের ছেলেরা ওকে মারতে মারতে তুলে নিয়ে গেল চোখের নিমেষে।” আফশোসটা এখনও যাচ্ছে না দাদার।

কুলবেড়িয়ার ওই ছোট্ট অপরিসর বাড়িটার সামনেই একটা বাড়ি তৈরি করছিলেন সরোজবাবু। নির্মীয়মাণ সেই বাড়ির সামনেই এক চিলতে রাস্তা। রাতে বাড়ি ফিরে সেখানেই রোজ ফোন নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে বেরতেন সৌরভ।

শুক্রবার রাতেও তেমনই বেরিয়েছিল সে। বন্ধুরা জানাচ্ছেন, জার্মানির খেলাটা তেমন মন দিয়ে দেখা হয়নি ব্রাজিল-সমর্থক সৌরভের। জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘দেখিস নেইমার একাই ব্রাজিলকে টেনে নিয়ে যাবে।’ বন্ধুদের আফশোস, “তার আগে শ্যামলের ছেলেরাই টেনে নিয়ে গেল ওকে।”

প্রতিবেশীদের অনেকেই এর মধ্যে রাজনীতির গন্ধও পাচ্ছেন। সরোজবাবু বিজেপি-র কুলবেড়িয়া অঞ্চল প্রধান। মা মিতাও গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি-র হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাহলে কী বাবা-মা বিরোধী রাজনীতি করার দায়েই ‘শাস্তি’ পেতে হল সৌরভকে?

প্রশ্নটা ঘুরে পিরে আসছে পড়শিদের আলোচনায়।

সৌরভের এক বন্ধু বলছেন, “বাবা-মা যে রাজনৈতিক মতেই বিশ্বাসী হোক না তার জন্য এমন শাস্তি পেতে হবে?”

সকাল ন’টার ট্রেন ধরে বিরাটি কলেজ। ফেরার পথে ট্রেন ধরে মধ্যমগ্রামে নেমে যেত সৌরভ। সদ্য একটা মোটরবাইক সংস্থার শো-রুমে চাকরি পেয়েছিল সে। সেখান থেকে ছুটির পরে ফিরতে প্রায় রাত সাড়ে দশটা। রোজকার এই ছিল রুটিন।

পাড়ার কচিকাঁচাদেরও বেজায় ‘বন্ধু’ ছিল ঘণ্টু। পাড়ার এক মহিলা বলেন, “বাব্বা, আঙ্কল বলা যাবে না। বললে কী রাগ। দাদা বলতে হবে। তবু আমার দশ বছরের ছেলে ও তার বন্ধুরা ঘণ্টুুদা বলতে অজ্ঞান।”

তবে দাপটও ছিল। কলেজের দুই বন্ধু বলেন, “যে কোনও ব্যাপারে এগিয়ে যেত জানেন। সব কিছুতেই নেতৃত্ব দিতে চাইত, সে ফুটবল হোক কিংবা কলেজের কোনও অনুষ্ঠান।” সব ব্যাপারেই অকপট, সরল, সোজা-সাপ্টা।

এ দিন সেই ছেলের এক টুকরো অন্ধকার ঘরে খাটের উপরে ঠায় বসে আছেন বাবা। ঘরের আলো-ছায়ায় দেওয়াল জোড়া একটা বাইকের ছবি। টেবিলময় ছড়ানো বইপত্র। ব্যাগ। ফুটবলের পত্রিকা।

বন্ধুরা বলছেন, “ঘণ্টুটা ফুটবল-অন্ধ ছিল। আর নেইমার ছাড়া ভাবতেই পারত না কিছু। আফশোস করত, চাকরিটা নেওয়ায় রাতের প্রথম খেলাটা ‘মিস’ হয়ে যাচ্ছে।” এ বার শুধু বিশ্বকাপ নয়, নিজের পাড়া, খুদে বন্ধ,ু কলেজের সহপাঠী সব কিছু থেকেই হারিয়ে গেল সৌরভ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE