Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বিরোধীদের যেন ‘ভ্যানিশ’ করে দাপট মদন-অর্জুনদের

দাদা, একটা অনুরোধ আছে! আপনাদের সভা আছে কাল। বক্তারা আসবেন। তাঁদের বলে দেবেন, মদনদা’কে নিয়ে কিন্তু কিছু বলা যাবে না! তা হলে অসুবিধা হয়ে যাবে! ঘটনা কামারহাটি পুরসভার। কামারহাটির বিধায়ক এবং রাজ্যের মন্ত্রী মদন মিত্র সারদা-কাণ্ডে অভিযুক্ত হয়ে এখনও জেলে। তবুও তিনিই পুরসভায় তৃণমূলের নির্বাচনী কমিটির দায়িত্বে! প্রার্থীরাও মন্ত্রীর সঙ্গে ছবি দিয়ে দেদার হোর্ডিং লাগিয়েছেন। এ হেন কামারহাটিতে ভোটের প্রচারের শেষ দিকে সিপিএমের এক সভার আগে লোকাল কমিটির এক নেতার বাড়িতে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন স্থানীয় এক তৃণমূল নেতা। মন্ত্রী মদনকে নিয়ে কিছু বলা যাবে না, প্রতিপক্ষের তরফে এমন অনুরোধের মানে আসলে কী, বুঝতে খুব অসুবিধা হয়নি বিরোধী দলের নেতার!

ঘরের চাবি। প্রচারে মদন মিত্রের ছবি দেওয়া চাবির রিং বিলোচ্ছেন কামারহাটি পুরসভার তৃণমূল প্রার্থী অপরাজিতা দাস। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।

ঘরের চাবি। প্রচারে মদন মিত্রের ছবি দেওয়া চাবির রিং বিলোচ্ছেন কামারহাটি পুরসভার তৃণমূল প্রার্থী অপরাজিতা দাস। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৫ ০২:৪৬
Share: Save:

দাদা, একটা অনুরোধ আছে! আপনাদের সভা আছে কাল। বক্তারা আসবেন। তাঁদের বলে দেবেন, মদনদা’কে নিয়ে কিন্তু কিছু বলা যাবে না! তা হলে অসুবিধা হয়ে যাবে!

ঘটনা কামারহাটি পুরসভার। কামারহাটির বিধায়ক এবং রাজ্যের মন্ত্রী মদন মিত্র সারদা-কাণ্ডে অভিযুক্ত হয়ে এখনও জেলে। তবুও তিনিই পুরসভায় তৃণমূলের নির্বাচনী কমিটির দায়িত্বে! প্রার্থীরাও মন্ত্রীর সঙ্গে ছবি দিয়ে দেদার হোর্ডিং লাগিয়েছেন। এ হেন কামারহাটিতে ভোটের প্রচারের শেষ দিকে সিপিএমের এক সভার আগে লোকাল কমিটির এক নেতার বাড়িতে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন স্থানীয় এক তৃণমূল নেতা। মন্ত্রী মদনকে নিয়ে কিছু বলা যাবে না, প্রতিপক্ষের তরফে এমন অনুরোধের মানে আসলে কী, বুঝতে খুব অসুবিধা হয়নি বিরোধী দলের নেতার!

শুধু কামারহাটিই নয়। এ বার প্রায় গোটা উত্তর ২৪ পরগনাতেই পুরভোট হচ্ছে এমন অদ্ভুত পরিবেশে! কোথাও পাড়ায় ভোটার স্লিপ বিলি করতে গিয়ে মার খাচ্ছেন বিরোধী দলের মহিলা কর্মীরা। কোথাও রাতে স্টেশন থেকে আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিরোধী দলের প্রার্থীর সঙ্গীদের। কোথাও আবার হামলার অভিযোগ আসছে প্রার্থীদের বাড়িতে। ভোটের দিন ঘোষণার পর থেকে চতুর্দিকে এত অজস্র গা-জোয়ারির অভিযোগ, পুলিশের খাতা পর্যন্ত সে সব নিয়ে যাওয়ার সাহসও নেই বিরোধীদের। উত্তর ২৪ পরগনায় বিরোধীদের সংগঠন শাসকের সঙ্গে সমানে টক্কর দেওয়ার মতো নয় ঠিকই। কিন্তু তার মধ্যেও অন্য বার যতটা প্রচার থাকে, তৃণমূলের দাপটে এ বার সেটুকু দাঁতও ফোটাতে পারেনি বিরোধীরা!

রাজ্যে যে ৯১টি পুরসভায় (তার মধ্যে তিনটি অবশ্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আগেই জিতে নিয়েছে শাসক দল) শনিবার ভোট, তার মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনা জেলাতেই সর্বোচ্চ ২৩টি। কলকাতার গায়ের উপরে এত পুরসভায় ভোট। তবু ভোটের হাওয়ায় এ বার সে ঝাঁঝ নেই! হোর্ডিং-ফেস্টুনে তৃণমূল ছাড়া প্রায় কিছু নেই-ই! বেশ কিছু ওয়ার্ডে বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পারেনি বা দিয়েও তুলে নিতে হয়েছে। যেখানে কাগজে-কলমে বিরোধী প্রার্থী আছেন, সেখানেও বড় করে প্রচারে নামার জো নেই! তৃণমূলের প্রচার যেখানে চলেছে শিঙা ফুঁকে, সিপিএম বা অন্য বিরোধীদের প্রচার ততটাই লুকিয়ে-চুরিয়ে! তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলছেন, ‘‘মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে নানা রকম ভাবে বাজার গরম করতে হয়। বিরোধীরা তা-ই করছেন! কিন্তু মানুষ যে এতে ভুলছেন না, ভোটের ফলেই বোঝা যাবে!’’

দু’বছর আগে এই জেলায় পঞ্চায়েত এবং এক বছর আগে লোকসভা ভোটে একচেটিয়া জিতেছিল তৃণমূলই। ভোটের দিন বেশ কিছু অভিযোগ উঠলেও প্রচার-পর্বে এমন একতরফা ছবি আগের দু’বার দেখেননি জেলার মানুষ। এ বার তৃণমূলের জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক থেকে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা অর্জুন সিংহ, সকলেই কটাক্ষের সুরে বলছেন, ‘‘হেরে হেরে বিরোধীরা হতোদ্যম হয়ে পড়ে নানা অভিযোগ করছেন! বিরোধীরা না থাকলে আমরা কী করব?’’ পক্ষান্তরে, সিপিএমের এক জেলা নেতার বিস্ময়, ‘‘ঘটনা না ঘটলে আমরা অভিযোগ করতে যাব কেন? দু’মাস আগেই তো এই জেলায় বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বিরাট জয় পেয়েছে তৃণমূল। তখন তো বিরোধীদের তেমন অভিযোগ ছিল না। তার পরেও তৃণমূলকে জবরদস্তি করতে হচ্ছে কেন?’’

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে দু’রকম ব্যাখ্যা মিলছে নানা রাজনৈতিক শিবির থেকে। প্রথমত, সব ওয়ার্ডে জেতার খিদে। কোথাও কিছু ছেড়ে রাখা যাবে না, এই মানসিকতা চেপে বসায় রীতিমতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে তৃণমূলের অন্দরে। যত দিন মুকুল রায়ের হাতে সংগঠনের সর্বময় কর্তৃত্ব ছিল, তত দিন কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণও ছিল। এখন মুকুল-হীন তৃণমূলে নানা স্তরে নানা নেতাই বেপরোয়া। গত বছর লোকসভা ভোটে যে অর্জুন নিষ্প্রভ হয়ে নিজের বিধানসভা কেন্দ্রে পিছিয়ে পড়েছিলেন, তাঁর প্রতাপেই এখন চোখে অন্ধকার দেখছে বিরোধীরা! এর পরিণাম যে ভবিষ্যতে খুব সুখকর হবে না, আশঙ্কা আছে তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের মধ্যেও। কিন্তু নিচু তলায় নিয়ন্ত্রণ না-থাকায় কোনও সতর্ক-বার্তাই কার্যকরী দেখাচ্ছে না!

আর দ্বিতীয় কারণ, বিক্ষুব্ধদের ভয়! জেলার বহু ওয়ার্ডেই এ বার তৃণমূলের বিক্ষুব্ধেরা গোঁজ বা নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। যাঁরা সরাসরি ভোটে দাঁড়াননি, তাঁদের ভূমিকাও কেমন হবে, নিশ্চিত নয় শাসক দল। বিরোধীদের চিহ্নিত করা যে হেতু সহজ, তাই আগেই তাদের ধরাশায়ী করে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। যাতে বিক্ষুব্ধ-কাঁটায় রক্তপাত হলেও বিরোধীদের ‘ভ্যানিশ’ করে দিয়ে জয়ের রাস্তাটুকু অন্তত খুলে রাখা যায়! কংগ্রেসের এক নেতার বক্তব্য, অতীতে জেলার বহু নির্বাচনে সিপিএমের তড়িৎ তোপদার বা শাসনের মজিদ মাস্টারেরা ছড়ি ঘোরাতেন। কিন্তু শহরাঞ্চলে ভোটের এমন পরিবেশ আগে দেখা যায়নি। ওই নেতার মন্তব্য, ‘‘গুরুমারা বিদ্যায় অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে তৃণমূল!’’ শাসক দলের তরফে জ্যোতিপ্রিয়বাবু যদিও বলছেন, ‘‘মজিদ মাস্টারেরা যা করতেন, করতেন! এখন ভোটে কোনও অশান্তির প্রশ্ন নেই।’’ আর বাম নেতাদের পাল্টা প্রশ্ন, অতীতে সবই যদি জোর করেই হতো, তা হলে বাম শাসনেই জেলায় এতগুলো পুরসভা তৃণমূল জিতেছিল কী ভাবে?

তড়িৎবাবুর মতো নেতারা প্রতাপ হারিয়েছেন, দলেও গুরুত্ব কমেছে। গৌতম দেব সিপিএমের জেলা সম্পাদক হওয়ার পর থেকে অন্তত ‘ভোকাল টনিকে’ কর্মীদের উদ্দীপ্ত রাখার চেষ্টা করতেন। এ বার অসুস্থ হয়ে গৌতমবাবু গৃহবন্দি। তাঁর ‘টিম’ এলাকায় এলাকায় কাজ করছে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচারের চেষ্টা চালিয়েছে ঠিকই। কিন্তু পাড়ার দেওয়াল থেকে অটো-টোটো-রিকশার গায়ে শোভিত তৃণমূলের প্রচারের তুলনায় বামেদের নিচু পর্দার জনসংযোগ নেহাতই স্তিমিত। কর্মী-সমর্থকদের মনোবল বাড়াতে বিশাখাপত্তনমে পার্টি কংগ্রেস শেষেই ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে ছুটে এসেছেন সিপিএমের নতুন পলিটব্যুরো সদস্য সুভাষিনী আলি। গত বার ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে দলের প্রার্থী হওয়ার সুবাদে তিনি জানেন, এখানে ভোট কেমন হয়! এই জেলাতেই পুরভোটের প্রচারে আক্রান্ত হয়েছিলেন মানস মুখোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়েরা। জনতার উদ্দেশে সুভাষবাবুরা এখন বলছেন, ‘‘নিজেদের ভোটটা দিতে আসুন। মার খাওয়ার জন্য না হয় আমরা আছি!’’

কী অবস্থা বিজেপি-র? এই জেলারই বসিরহাট দক্ষিণে উপনির্বাচনে জিতে বিধায়ক হয়েছিলেন শমীক ভট্টাচার্য। বনগাঁ লোকসভার উপনির্বাচনেও বিস্তর গা ঘামিয়েছিল বিজেপি। এ বার ততটা উৎসাহ চোখে পড়ছে না গেরুয়া শিবিরে। উপনির্বাচনের আগে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দেওয়া মঞ্জুলকৃষ্ণ ও তাঁর পুত্র সুব্রত ঠাকুরকে পুর-ময়দানে তেমন দেখা যায়নি। বিজেপি বরং বেশি মনোযোগ দিয়েছে বসিরহাট এলাকায় ঘাঁটি আগলাতেই। শমীক অবশ্য বলছেন, ‘‘প্রশ্নই নেই ওয়াকওভারের! মানুষ ভোট দিতে পারলে তৃণমূল বিপদে পড়বে।’’

বাদুড়িয়া ও বসিরহাট বাদে জেলায় কংগ্রেসের তেমন সংগঠন নেই। বহু আসনে প্রার্থীও দিতে পারেনি তারা। ভোটের আগে বর্ষীয়ান নেতা অসিত মজুমদারকে সরিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর নির্দেশে দলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা (গ্রামীণ) সভাপতি করা হয় তাঁর ভাই অমিত মজুমদারকে। ক্ষুব্ধ অসিতবাবু শেষমেশ কংগ্রেসের টিকিটেই ভোটে দাঁড়িয়েছেন। তবু জেলায় কংগ্রেসের ল়ড়াই আসলে অস্তিস্ত্ব রক্ষারই।

শুধু কংগ্রেসই কেন? কোনও বিরোধীরই কি কোনও অস্তিত্ব থাকবে শনিবারের পর? জ্যোতিপ্রিয়েরা হেসে বলছেন, ‘‘বিরোধীরা ল়ড়াই করতে পারলে তবে না থাকবে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE