Advertisement
০৬ মে ২০২৪
Madhyamik Candidates working

মাধ্যমিকে রেজিস্ট্রেশন করিয়েও পরীক্ষায় বসছে না অনেকে, কেউ ঢুকেছে কাজে, কেউ ব্যস্ত সংসারে

শিক্ষকেরা জানাচ্ছেন, করোনা পরিস্থিতিতে প্রায় দু’বছর স্কুল বন্ধ থাকায় গ্রামাঞ্চলের পড়ুয়াদের মধ্যে পড়াশোনার অভ্যাসটাই চলে গিয়েছিল।

লেখাপড়ার ছেড়ে কাজে ব্যস্ত মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী।

লেখাপড়ার ছেড়ে কাজে ব্যস্ত মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। — ফাইল চিত্র।

সীমান্ত মৈত্র   , সমরেশ মণ্ডল
শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৮:১৪
Share: Save:

সামনেই মাধ্যমিক। রাজ্য জুড়ে এ বার কমেছে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা। দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে প্রায় ৬২ হাজার পরীক্ষার্থী। জেলা শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, সংখ্যাটা গত বছরের তুলনায় প্রায় দশ হাজার কম। নবম শ্রেণিতে ‘রেজিস্ট্রেশন’ করার পরেও অনেকে বসছে না পরীক্ষায়।

শিক্ষকেরা জানাচ্ছেন, করোনা পরিস্থিতিতে প্রায় দু’বছর স্কুল বন্ধ থাকায় গ্রামাঞ্চলের পড়ুয়াদের মধ্যে পড়াশোনার অভ্যাসটাই চলে গিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে বেড়েছে মোবাইলের আসক্তি। দু’বছর পরীক্ষা ছাড়াই দু’ক্লাস উপরে উঠে গিয়েছে পড়ুয়ারা। কিন্তু উঁচু ক্লাসের পড়া সামাল দিতে পারেনি অনেকে। তাই নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় অনেকে সফল হতে পারেনি। মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ অনেকে।

তা ছাড়া, অনেকে পড়াশোনাও ছেড়ে দিয়েছে বলে জানতে পেরেছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। বহু ছাত্র ভিন্ রাজ্যে কাজে চলে গিয়েছে। বহু ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গিয়েছে বলেও জানা যাচ্ছে।

নামখানা ব্লকের মৌসুনি দ্বীপ এলাকায় বালিয়াড়া কিশোর হাইস্কুলে নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেছিল ১০২ জন ছাত্রছাত্রী। মাধ্যমিকে বসবে ৭৯ জন। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অরিন্দম মাইতি বলেন, “লকডাউন পরবর্তী সময়ে অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। অনেক ছেলে বাড়ির আর্থিক অবস্থা খারাপ দেখে ভিন্ রাজ্যে কাজে চলে গিয়েছে।”

পাথরপ্রতিমার গোপালনগর হাইস্কুলে এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছিল ১৩০ জন। মাধ্যমিক দিচ্ছে ১০৩ জন। প্রধান শিক্ষক তরুণকুমার মিত্র বলেন, “গত দু’বছর পড়াশোনা হয়নি। যার ফলে অনেকে নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা, দশম শ্রেণির টেস্ট পরীক্ষায়ও পাশ করতে পারেনি। তাই অনেকেই এ বার পরীক্ষায় বসছে না। অনেকে আবার বাবা-মায়ের সঙ্গে দিল্লি, কেরল, গুজরাতে কাজে চলে গিয়েছে।”

সাগর ব্লকের হরিণবাড়ি যুধিষ্ঠির হাইস্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার জন্য ৫৬ জন ছাত্রছাত্রী রেজিস্ট্রেশন করেছিল। কিন্তু পরীক্ষায় বসবে ৫১ জন। প্রধান শিক্ষক দেশবন্ধু দাস বলেন, “দু’একজন মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছেলেরা কেউ কেউ পড়া বন্ধ করে কাজ করছে। ওদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তা-ও কিছু হয়নি।’’

সাগরের বামনখালি এমপিপি হাইস্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছিল ১৪৭ জন ছাত্রছাত্রী। পরীক্ষায় বসতে চলেছে ১১৭ জন। প্রধান শিক্ষক সৌমিত্র দাস জানালেন, প্রতি বছর অষ্টম শ্রেণির পর থেকে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কমতে থাকে। বিশেষ করে ছাত্রের সংখ্যা কমে যায়। অল্প বয়সে কাজ শিখতে বাইরে চলে যায়। কিছু মেয়ের মাধ্যমিক দেওয়ার আগে বিয়ে হয়ে যায়।

অভিভাবকদের একাংশ জানালেন, তাঁরা চান ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করুক। কিন্তু মেয়েদের অনেকেই বন্ধুদের দেখে পালিয়ে বিয়ে করছে। ছেলেদের মধ্যেও আশপাশের বন্ধুবান্ধব, স্কুলের দাদাদের দেখে বাইরে কাজে যাওয়ার ইচ্ছে বাড়ছে। অল্প বয়সে হাতে টাকা আসার পরে তারা আর পড়াশোনার জগতে ফিরতে চাইছে না।

পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার আহ্বায়ক অজিত নায়েক বলেন, ‘‘প্রতি বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় দু’তিন হাজার পরীক্ষার্থী বিভিন্ন কারণে অনুপস্থিত থাকে। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এ বছর সংখ্যাটা অস্বাভাবিক ভাবে কমেছে। বয়সের কড়াকড়ির জন্য অনেকে এ বছর রেজিস্ট্রেশন করায়নি। এ ছাড়া, অন্যান্য কিছু কারণ থাকতেও পারে।’’

একই সমস্যা উত্তর ২৪ পরগনার বহু স্কুলে।

বনগাঁর গাঁড়াপোতা গালর্স হাইস্কুলের ৭৬ জন ছাত্রী এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে বলে আবেদনপত্র পূরণ করেছে। যদিও নবম শ্রেণিতে নাম রেজিস্ট্রেশন করেছিল ৮৮ জন ছাত্রী। ১২ জন ছাত্রী স্কুলছুট হয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছে স্কুল। শিক্ষিকারা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন, অনেকেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তারা এলাকাতেই নেই। প্রধান শিক্ষিকা ববি মিত্র বলেন, ‘‘যে ৭৬ জন ছাত্রী আবেদনপত্র পূরণ করেছে, তাদের মধ্যেও অনেককে বাড়ি থেকে ডেকে এনে, অভিভাবকদের বুঝিয়ে পরীক্ষায় বসানো হচ্ছে।’’ তাঁর আশা, আগামী বছর থেকে এই সমস্যা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা যাবে। লকডাউনে স্কুল বন্ধ না থাকলে অনেকের বিয়ে আটকানো সম্ভব হত বলে মনে করেন তিনি।

গত বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে শিক্ষক-শিক্ষিকারা বিবাহিত ছাত্রীদের শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিলেন। স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়িকে বুঝিয়ে, নরমে-গরমে কথা বলে ছাত্রীদের স্কুলে এনে মাধ্যমিকের আবেদনপত্র পূরণ করিয়েছিলেন। কিছু ক্ষেত্রে টাকাও দিয়েছিলেন শিক্ষকেরা। তাদের অনেকে পরীক্ষায় বসে পাশও করে। গত বছরের তুলনায় এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষায় না বসা পড়ুয়ার সংখ্যা একটু কম হলেও সমস্যা পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা যায়নি বলেই মত শিক্ষকদের।

গোপালনগরের নহাটা সারদা সুন্দরী বালিকা বিদ্যামন্দির স্কুল থেকে এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসতে চলেছে ৯২ জন ছাত্রী। যদিও নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেছিল ১০২ জন ছাত্রী। প্রধান শিক্ষিকা শম্পা পাল বলেন, ‘‘করোনা ও লকডাউনের সময় ১০ জন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তারা আর পরীক্ষা দেয়নি।’’

গাইঘাটার ইছাপুর হাইস্কুল, বাগদার কোনিয়াড়া যাদবচন্দ্র হাইস্কুল, বাগদার রণঘাট অঞ্চল হাইস্কুলও ভুগছে একই সমস্যায়।

তবে এ সবের ব্যতিক্রম গাইঘাটার চাঁদপাড়া বাণী বিদ্যাবিথী স্কুল। প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘‘আমাদের স্কুলে নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেছিল ১৪৯ জন পড়ুয়া। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে ১৪৮ জন।’’

শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানালেন, করোনা পরিস্থিতি পেরিয়ে স্কুল খোলার পরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়ে বহু পড়ুয়াকেই ফের স্কুলমুখী করা হয়েছিল। তবে চিত্রটা ধূসর বেশিরভাগ জায়গাতেই। এক শিক্ষকের আফসোস করে বললেন, ‘‘একটা প্রজন্মের পড়াশোনাই অকালে শেষ হয়ে গেল!’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

madhyamik candidate South 24 Parganas
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE