Advertisement
১৬ মে ২০২৪

অ্যাসিড বৃষ্টিতে ঝলসাল খেত

এক রাতের মধ্যে ঝরে গেল একটি গ্রামের কয়েকশো গাছের পাতা। ঝলসে গেল তুলসী মঞ্চের তুলসী গাছও। শ্বাসকষ্ট, চোখ জ্বালা ও কাশি নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে গ্রামের শিশুরা। খুশি সর্দার নামে দশ দিনের একটি শিশুকে বসিরহাট জেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।

অ্যাসিডে ঝলসে গিয়েছে বাড়ির তুলসী গাছ। বাদুড়িয়ার ফতুল্যপুর গ্রামে।—নিজস্ব চিত্র।

অ্যাসিডে ঝলসে গিয়েছে বাড়ির তুলসী গাছ। বাদুড়িয়ার ফতুল্যপুর গ্রামে।—নিজস্ব চিত্র।

নির্মল বসু
বাদুড়িয়া শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৪ ০৩:২৪
Share: Save:

এক রাতের মধ্যে ঝরে গেল একটি গ্রামের কয়েকশো গাছের পাতা।

ঝলসে গেল তুলসী মঞ্চের তুলসী গাছও।

শ্বাসকষ্ট, চোখ জ্বালা ও কাশি নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে গ্রামের শিশুরা। খুশি সর্দার নামে দশ দিনের একটি শিশুকে বসিরহাট জেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।

এমনই ঘটল বাদুড়িয়ার ফতুল্যপুর গ্রামে। রবিবার সকালে গ্রামবাসীরা রাস্তায় বেরিয়ে পথে ঝরা পাতার স্তূপ দেখে তাজ্জব। গ্রামের এক বাসিন্দা আবদুর রসিদ বলেন, “সকালে উঠে দেখি ঝরা পাতায় গ্রামের রাস্তা ছেয়ে গিয়েছে। মাঠে গিয়ে দেখি, সব ফসল ঝলসে গিয়েছে।” শুরু হয় নানা জল্পনা। খবর দেওয়া হয় পুলিশকেও। যদিও তারা কিছু বুঝতে পারেনি।

গ্রামের মানুষ কিছু না বুঝলেও শিবপুরের বট্যানিকাল গার্ডেনের অধিকর্তা হিমাদ্রিশেখর দেবনাথের অনুমান, শনিবার রাতে অ্যাসিড বৃষ্টির জেরেই ওই ঘটনা। ষাটের দশকে লন্ডনে ঘটে যাওয়া এমন একটি ঘটনার সঙ্গে এই ঘটনার মিল পাচ্ছেন তিনি। তাঁর প্রাথমিক অনুমান, ইটভাটার ধোঁয়া বা অন্য কিছু থেকে বাতাসের সঙ্গে সালফার ডাই অক্সাইড মিশে গিয়েছিল। নিম্নচাপ থাকায় তা উপরে উঠতে না পেরে নীচ দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছিল। সেই সময়ে বৃষ্টির জলের সংস্পর্শে এসে তা সালফিউরিক অ্যাসিডে পরিণত হয়েছে। পরে তা আ্যাসিড বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ায় গাছের পাতা ঝলসে গিয়েছে, ঝরে গিয়েছে। তাঁর কথায়, “ওই অ্যাসিড বৃষ্টি গায়ে লাগলে চামড়া পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”

ইছামতীর পাশের ওই গ্রামটিতে ইটভাটা রয়েছে একটি। তবে আশপাশের কয়েকটি গ্রামে আরও বেশ কিছু ইটভাটা গড়ে উঠেছে। গ্রামের বাসিন্দাদের কেউ কেউ সেখানে কাজও করেন। বসিরহাটের মহকুমাশাসক শেখর সেন বলেন, ‘‘গ্রামবাসীদের কাছ থেকে খবর পেয়েই স্থানীয় একটি বন্ধ ইটভাটা সিল করে দেওয়া হয়েছে। পরিবেশ দফতরকে খবর দেওয়া হয়েছে।” আজ, সোমবার পরিবেশ দফতরের একটি দল গ্রামে গিয়ে বিষয়টি তদন্ত করবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

এ দিন ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, তখনও গাছের পাতা ঝরছে। সেগুলির মধ্যে রয়েছে বট, অশ্বত্থ, শিরীষ, নিম, বাবলা, কৃষ্ণচূড়া, বাঁশ, কাঠাল, আম সবরকম গাছই। ঝলসে গিয়েছে ধান, পাট, বেগুন, বরবটির খেত। রাস্তা, বাড়ি, ঘরের চাল ছেয়ে গিয়েছে ঝরা পাতায়। পাতাগুলো মাঝখান থেকে ঝলসানো। চারদিকে তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ। কারও চোখও জ্বালা করছে। শিশুরা কাশছে। আতঙ্কিত গ্রামবাসীদের বক্তব্য, এর ফলে যে কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়বেন না, তার নিশ্চয়তা কই? ইতিমধ্যেই ওই গ্রামে গিয়েছে স্বাস্থ্য দফতরের একটি প্রতিনিধি দল। তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের ওষুধ দিয়েছেন।

অসুস্থ ২০ থেকে ২২ জনের চিকিৎসা করানো হয়েছে জানিয়ে বসিরহাট জেলা স্বাস্থ্য অধিকর্তা পুষ্পেন্দু সেনের আশ্বাস, “ভয়ের কিছু নেই।”

গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রসিদ বলেন, ‘‘শনিবার দুপুরে ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে বেগুন খেতে সার দিচ্ছিলাম। তখন দেখি, একটা সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী ভেসে যাচ্ছে। অনেকটা কুয়াশার মত দেখতে। তার কিছুক্ষণ পর থেকে চোখ জ্বালা করতে শুরু করে। শ্বাসকষ্ট, কাশিও হচ্ছিল। বারুদের মত গন্ধ ছড়াচ্ছিল। কিন্তু তখন বিশেষ গুরুত্ব দিইনি। আজ সকালে মাঠে এসে দেখি পাট, ধান, বেগুন সব আধপোড়া হয়ে গিয়েছে।’’

গ্রামের বাসিন্দা তথা স্থানীয় ইটভাটার এক শ্রমিক আব্দার সর্দার বলেন, ‘‘সাধারণত চুল্লি দিয়ে ওঠা ধোঁয়া উপরের দিকে উঠে যায়। নিম্নচাপ বা জলীয় বাষ্প বা বৃষ্টি হওয়াতে তা খানিকটা নীচ দিয়ে যাওয়ায় আমাদেরও চোখ জ্বালা করছিল। পরে বুঝতে পারি, ধোঁয়া যে দিক দিয়ে গিয়েছে, সেখানকার সব গাছপালা পুড়ে ঝলসে গিয়েছে।”

গ্রামের বাসিন্দা হানিফ সর্দারের প্রায় ১৮ কাঠা জমির পাট ও ধান পুড়ে ঝলসে গিয়েছে। তিন কাঠা জমিতে বেগুন চাষ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ মণ্ডল। কার্তিকচন্দ্র বিশ্বাস পাট চাষ করেছিলেন ৩ কাঠা জমিতে, ৫ কাঠা জমিতে বেগুন চাষ করেছিলেন। সব শেষ হয়ে গিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে, কেউ পুড়িয়ে দিয়েছে সেগুলিকে। বড় বড় গাছ তো বটেই, বাড়ির তুলসী গাছও পুড়ে ঝলসে গিয়েছে। মেনকাদেবী নামে এক বৃদ্ধা বলেন, ‘‘এক রাতের মধ্যে তুলসী গাছ, এমন কি উঠোনের ঘাসও মরে শুকিয়ে কাঠ।”

হিমাদ্রিবাবু জানিয়েছেন, ষাটের দশকে লন্ডনে এক বার অ্যাসিড বৃষ্টির ফলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তাঁর কথায়, “এ বার এখানে ছোট জায়গায় এমন ঘটনা হয়েছে ঠিকই। এমন ঘটনা যাতে রাজ্যের আর কোথাও না হয়, সেই ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে প্রশাসনকে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের উচিত বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা।”

গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশের অবশ্য অনুমান, “ইটে রং করার জন্য মাঝেমধ্যে বিশেষ একটি রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। তার জেরেই হয়তো এমন ঘটনা।” কিন্তু চাষের ক্ষতি হওয়ায় বেশ উদ্বিগ্ন তাঁরা।

বাজিতপুর পঞ্চায়েতের উপপ্রধান দেলোয়ার হোসেন এবং ফতুল্যাপুর গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য সুবীর মণ্ডল জানান, কী ভাবে চাষিদের ক্ষতিপূরণ করা যায়, তা নিয়েও চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nirmal basu acid rain baduria
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE