Advertisement
০৩ মে ২০২৪

ওজন মাত্র ২১ তবু মাধ্যমিকে টুকটুকি

শিরদাঁড়া বেঁকে গিয়েছে। ২২ বছরের মেয়ের একুশ কেজি ওজনের শরীরটা গুটিয়ে গিয়েছে। অন্যের সাহায্য ছাড়া নড়তে চড়তে পারে না। নিজের একহাতে একটি বই তোলারও ক্ষমতা নেই। কিন্তু তবুও পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অদম্য জেদ তার।

মায়ের কোলে টুকটুকি।

মায়ের কোলে টুকটুকি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
রায়দিঘি শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৫ ০০:১৯
Share: Save:

শিরদাঁড়া বেঁকে গিয়েছে। ২২ বছরের মেয়ের একুশ কেজি ওজনের শরীরটা গুটিয়ে গিয়েছে। অন্যের সাহায্য ছাড়া নড়তে চড়তে পারে না। নিজের একহাতে একটি বই তোলারও ক্ষমতা নেই। কিন্তু তবুও পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অদম্য জেদ তার। আর এই ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মেনেছে মেয়েটির শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। বারো বছরে পড়াশোনা শুরু করেছিল সে। এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে মথুরাপুর ১ ব্লকের লালপুর শিবগঞ্জের বাসিন্দা কৃষ্ণচন্দ্রপুর হাইস্কুলের ছাত্রী টুকটুকি মোল্লা।

পেশায় রাজমিস্ত্রি বাবা জসিমুদ্দিন অসুস্থ। মা তমিনা নিরক্ষর। দুই দিদিও তাই। দরিদ্র পরিবারের সন্তান টুকটুকি জন্ম থেকেই হাড়ের জটিল রোগে ভুগছে। পরিবারের এই অবস্থার জন্য ঠিক মতো চিকিত্‌সা করানো হয়নি। গ্রামে মেয়েদের পড়াশোনার তেমন রেওয়াজই ছিল না। কিন্তু বোন করিমার পড়াশোনা শুরু হতেই পড়ার জন্য জেদ ধরে সে। দ্রুত শিখেও নেয় সব কিছু। জসিমুদ্দিন বলেন, “প্রথমে আমরা গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু একটি বেসরকারি সংস্থা ওর পড়ার জন্য হুইল চেয়ার দেয়। এরপর ওকে স্থানীয় জলঘাটা এফপি স্কুলে ভর্তি করাই।” সেই থেকে নিয়মিত মা তাকে হুইল চেয়ারে করে স্কুলে দিয়ে আসতেন।

স্কুলের দূরত্ব বাড়ি থেকে মেরেকেটে ৩০০ মিটার। বোন কারিমা চেয়ার ঠেলে দিদিকে স্কুলে নিয়ে যেত। হুইল চেয়ারে বসেই বরাবর ক্লাস করেছে টুকটুকি। প্রাথমিকের গণ্ডী সাফল্যের সঙ্গে পেরোনোর পর হাইস্কুলে পড়ানোর বিষয়ে বাবা মা ফের নিরুত্‌সাহিত হলেও টুকটুকি জেদ ছাড়েনি। শেষ পর্যন্ত বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে কৃষ্ণচন্দ্রপুর হাইস্কুলে ভর্তি হয় সে।

কিন্তু বাবা মা ও স্কুল কর্তৃপক্ষ চেয়েছিলেন টুকটুকি ক্লাস না করে শুধুমাত্র পরীক্ষা দিক। এ বারও টুকটুকির কান্না, জেদ ও যুক্তির কাছে হার মানতে হয় সকলকে। কখনও কারিমা কখনও ভাই তহিরউদ্দিনের সঙ্গে একই ভাবে স্কুলে গিয়েছে সে। প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির দাদারা তাকে চেয়ার সমেত তিনতলার ক্লাসরুমে ওঠানো নামানো করেছে। টুকটুকির কথায়, “আমার বাবা-মা-শিক্ষকেরা তো আছেনই, পাশাপাশি স্কুলের দাদারাও আমাকে একটু একটু করে সাফল্যের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে সহায়তা করেছে। আজ পর্যন্ত আর্থিক কারণে আমি টিউশন পড়িনি। ক্লাস না করলে আমি পড়া বুঝতাম শিখতাম কী করে?”

শিক্ষকতা করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এগিয়ে চলেছে টুকটুকি। নিজে পড়াশোনা শিখে দুই দিদিকে সাক্ষর করিয়েছে সে। পড়া বুঝিয়ে দেয় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া বোন আরিফাকেও। বাঁশের বেড়ায় মাটি ছিটানো দু’কামরার ঘুপচি ঘরে খড়ের ফুটো ফাটা চালা। স্যাঁতস্যাঁতে একটি ছোট্ট বারান্দায় মাদুরের উপর বসে তার পড়াশোনা। প্রিয় বিষয় ইতিহাস। পড়াশোনার ফাঁকে রেডিওতে গান, নাটক, আলোচনা শুনতে ও রঙ পেনসিলে প্রকৃতির ছবি আঁকতে ভালবাসে টুকটুকি। নজরুল গীতি গাওয়া ও শোনা তার শখ। বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে মির্জাপুর এআই হাইস্কুলে পরীক্ষা দিচ্ছে টুকটুকি। তবে তাকে চিন্তায় রেখেছে তার অশক্ত আঙুল।

প্রধান শিক্ষক চন্দন মাইতি বলেন, “আঙুলে জোর নেই বলে সে দ্রুত লিখতে পারে না। যার ফলে নম্বর কমে যায়। তবে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অনুমতি নিয়ে সে পৃথক ঘরে হুইল চেয়ারে বসেই অতিরিক্ত তিরিশ মিনিট সময় নিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে। ওর লড়াই আমাদের সকলের কাছে অনুপ্রেরণা।” টুকটুকির জন্য গর্বিত তার পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশীরাও। টুকটুকি বলে, “আমার সাফল্য দিয়েই আমি এলাকার স্কুলছুট ও পড়াশোনায় বিমুখদের স্কুলে ফেরাবো।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE